শনিবার, ১৪ মে, ২০২২ ০০:০০ টা

পনিরেই কোটিপতি কৃষক

শাইখ সিরাজ

পনিরেই কোটিপতি কৃষক

গেল এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে কৃষি টেকনোলজিতে উন্নত দেশ নেদারল্যান্ডসে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। এর আগে ২০১৫ সালেও একবার নেদারল্যান্ডস গিয়েছিলাম। সে সময় তাদের কৃষিপ্রযুক্তি ও গবেষণার অগ্রগতি নিয়ে বেশ কিছু প্রতিবেদন ধারণ করেছিলাম। এবারের উদ্দেশ্য এ সময়ে এসে নেদারল্যান্ডস কৃষি ও কৃষি সংক্রান্ত বিষয়ে কতদূর এগিয়েছে সেটা কাছ থেকে দেখার। আরও একটি বড় কারণ ছিল নেদারল্যান্ডস তার ডেল্টা প্ল্যান কীভাবে সফল করেছে সে সম্পর্কে ধারণা নেওয়া। তারই ধারাবাহিকতায় নেদারল্যান্ডসের বিভিন্ন শহরের নানান গবেষণা প্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখেছি। এক দিন বিকালে আমরা পৌঁছলাম লুনটেরে নামের এক জায়গায়। নেদারল্যান্ডসের ঐতিহ্যবাহী গ্রামগুলো দেখতে যেমন হয়, লুনটেরেও সে রকম একটি গ্রাম। বিশাল এলাকা নিয়ে গ্রামের এক একটি গৃহস্থ বাড়ি। বাড়ির চারপাশ ঘিরে খাল। ইয়ান ডির্ক ফান ডার ভোর্ট-এর ডেইরি ফার্ম আমাদের গন্তব্যস্থল। ইয়ানের খামারের নাম রিমেকার। পুরনো ধাঁচের একটা বিশাল বাড়ি ইয়ানের। বাড়ি লাগোয়া তার গরুর খামার। খামারটিতে শিখতে আসে নেদারল্যান্ডসের বিখ্যাত কৃষিবিষয়ক বিশ্ববিদ্যালয় ভাগেনিংগেন ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা।

আমরা যখন ইয়ানের খামারে পৌঁছলাম তখন উজ্জ্বল বিকাল। বাড়ি ও খামারের সামনেই বিশাল মাঠ, মূলত গো-চারণ ক্ষেত্র। বিকালের উজ্জ্বল আলোয় সবুজ ঘাসের সে জমি চিকচিক করছে। কোথাও ফুটে আছে হলুদ রঙের ঘাসফুল। আরও দূরে একটি মাঠে বিচরণ করছে জার্সি জাতের অনেক গরু। আমরা পৌঁছতেই ইয়ান এগিয়ে এলেন। পরিচয় পর্ব শেষে তার সঙ্গে এগিয়ে গেলাম। প্রথমেই নিয়ে গেলেন গরুর খামারে। ইয়ান বলছিলেন বাড়ি খামার ও গো-চারণ ভূমিসহ মোট ৭০ হেক্টর জমিতে তার এই উদ্যোগ। শুনে অবাক হলাম তার খামারটির বয়স পৌনে ৪০০ বছর। এটি একটি পারিবারিক খামার। ভ্যান দ্য ভোর্ট পরিবারের খামার। খামারের যে চেহারা আমরা দেখছি, সেটি সর্বশেষ গড়ে তোলা হয় ১৯২৫ সালে। ইয়ান ডির্ক ফান ডার ভোর্টের দাদা খামারটি শেষবারের মতো গুছিয়ে গেছেন পরবর্তী প্রজন্মের কথা ভেবে। তিনি মারা যান ১৯৪২ সালে। পরে তার ছেলে পিটার ডির্ক দায়িত্ব নেন। তারও পরবর্তী প্রজন্ম হিসেবে খামারটি এখন চালাচ্ছেন তার নাতি ইয়ান।

অসাধারণ গতিসম্পন্ন তারুণ্যদীপ্ত এক খামারি ইয়ান। খামার পরিচালনায় অসামান্য দক্ষতা তার। পূর্ব পুরুষের শুধু ঐতিহ্যই সংরক্ষণ করছেন না, পূর্ব পুরুষের যে চেতনা তাও রয়েছে তার মাথায়। আজকের দিনের বাণিজ্য চিন্তাকে হিসাবের মধ্যে রেখেই বেছে নিয়েছেন শতভাগ শুদ্ধ প্রক্রিয়ায় খামার পরিচালনার পথ।

ইয়ান বললেন, প্রায়ই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী বেড়াতে আসে খামার দেখতে। তার খামারে রয়েছে ৯০টি জার্সি জাতের গাভী। আমাদের দেশের গবাদিপশুর খামারিদের মূল সমস্যা পশুর খাবার নিয়ে। তাই তার কাছে জানতে চাই, কী খাবার দেওয়া হয় এই গাভীদের? ‘ঘাস’-এক কথায় উত্তর দিলেন ইয়ান। তারপর একটু থেমে বললেন, শীতের সময়টায় যখন বরফ পড়ে, তখন খড় খেতে দিই। আর বাকি সময় মাঠের ঘাসই গাভীর খাদ্য।

ইয়ান আমাকে নিয়ে গেলেন গরুর চারণভূমিতে। লম্বা চওড়া ইয়ানের পায়ে বিশেষ বুট জুতা। হাতে একটা বেলচা। যেমনটা সিনেমায় ওয়েস্টার্ন কৃষকদের দেখি। গরুর পুরো চারণভূমিটা দেখলাম। মাঝখান দিয়ে সেচের পানি আসার জন্য নালাও রয়েছে। তবে সেখানে সরকারি সহযোগিতা রয়েছে। ৪০ বছর ধরে ইয়ান এই গ্রেজিং ল্যান্ডটা অর্গানিকভাবেই রেখেছেন এবং আলাদা করে কোনো কিছুই মেশাননি ঘাসের সঙ্গে। তাই গরুগুলো একদম প্রাকৃতিক খাবার পাচ্ছে। ইয়ান বলছিলেন, প্রাকৃতিক এই ঘাসেই গরুর জন্য যথেষ্ট পুষ্টি রয়েছে। এই মাটিতে কখনো চাষাবাদ করা হয় না। বেলচা দিয়ে মাটি তুলে দেখালেন মাটির গুণাগুণ। দেখলাম উর্বর মাটির নিচে প্রচুর কেঁচো রয়েছে। ইয়ান আমাকে অবাক করে দিয়ে একটা কেঁচো মুখে তুলে নিলেন। পরিষ্কার করে কেঁচোটি আমার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘প্রাকৃতিক এই লাঙল ছাড়া এই ভূমিতে আর কোনো চাষ হয় না। একেবারেই অর্গানিক এই মাটি আর ঘাস, যা আমার গাভীগুলোর জন্য আদর্শ খাদ্য জোগাচ্ছে। দেখ ঘাসগুলোর শেকড় কত পুষ্ট!’

মাঠের এক পাশে গরু আসার একটি নির্দিষ্ট পথ রয়েছে। মাঠের যে কোনো জায়গায় গরু মলত্যাগ করে। ওই গোবরই ঘাসের খাদ্য। গরু, ঘাস আর কেঁচোর প্রাকৃতিক ইকো-সিস্টেম এখানে টিকে আছে ইয়ানের তদারকিতে। ‘সার বা কোনো খাবার দেওয়া হয় না ঘাসকে’, বলছিলেন ইয়ান। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক বলতে যা বোঝায়। সম্পূর্ণ ভিন্নতর এক প্রেক্ষাপট এই ফার্মে। কোনোভাবেই গরুদের অ্যান্টিবায়োটিক দেন না ইয়ান। ইয়ান বলছিলেন, ‘আমি আমার গরুর সঙ্গে কথা বলি। আমি তাদের গতিবিধি লক্ষ্য করি। আমি বুঝতে চাই তারা আমাকে কী বোঝাতে চাইছে, বা বলতে চাইছে; আমি তাদের কাছে শিখতে চাই।’ ইয়ান আরও বললেন, গরুর শিং কাটেন না তিনি। একেকটি শিঙে না হলেও ছয়টি করে রিং আছে। আরও বড় শিঙের গরুও রয়েছে। গরুর শিং বলে দিচ্ছে গরুর বয়স। গরুর বয়স যত বাড়বে শিঙের রিঙের সংখ্যাও বাড়বে। যখন গরুর বয়স বাড়ে তখন তারা শিং থেকে মিনারেল পায়। যদি কোনো কারণে শিং কাটা হয় তাহলে তারা মিনারেল পায় তাদের ক্ষুর থেকে, এমনটাই বলছিলেন ইয়ান। মাঠের গাভীগুলো বেশ স্বাস্থ্যবান ও সুঠাম দেহের। আনন্দ নিয়ে ঘাস খাচ্ছিল। মাঠে ড্যান্ডি লায়ন নামের একটা প্রাকৃতিক ফুল রয়েছে যেখান থেকে ক্যালসিয়াম পাওয়া যায়। যদি এই ফুলটি মাঠে না থাকত তাহলে ক্যালসিয়াম আসত না, এমনটাই দাবি ইয়ানের। ইয়ান তার খামারের লাভে শতভাগ খুশি। সম্পূর্ণ কার্বন জিরো ফার্ম হলো রিমেকার। বাইরে থেকে গরুর জন্য কোনো খাবার আনা হয় না।

৯০টি গাভী থেকে প্রতিদিন কমপক্ষে ১৪৪০ কেজি দুধ আসে। দুধ কি বিক্রি করে দেন? ইয়ানের কাছে জানতে চাই। ‘এক ফোঁটা দুধও আমি কারও কাছে বিক্রি করি না। অন্য খামারিরা চিজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের কাছে তাদের খামারের দুধ বিক্রি করে। আমি নিজেই চিজ তৈরি করি। একেবারে অর্গানিক চিজ।’ উত্তর দিল ইয়ান।

এরপর নিয়ে গেল পনিরের ঘরে। পনিরের ঘর দেখে চোখ ছানাবড়া অবস্থা। তাকের পর তাক সাজানো পনিরে। গোল গোল পনিরের চাকতি একেকটির ওজন ১০ কেজি। পনির সংরক্ষণ করা হয়েছে এমনভাবে যাতে বাইরের অংশে ব্যবহার করা হয়েছে ঘি। এই বুদ্ধিটি অবশ্য ইয়ানের স্ত্রীর। যেই পনির যত বেশি পুরনো তত বেশি দামে বিক্রি হবে। আমাদের সামনেই ছিল এক বছরের পুরনো ঘি যেগুলোর দাম নতুন পনিরের চেয়ে অনেক বেশি। আমরা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে গেলাম। সেটিও আর একটি পনির ঘর। ইয়ান প্রতি দুই দিনের দুধ সংরক্ষণ করার পর পনির তৈরি করেন। ১০ কেজি পনিরের দাম প্রায় ৫০০ ইউরো। অর্থাৎ বাংলাদেশি টাকায় ৫০ হাজার টাকা। ইয়ান বলছিলেন পনিরের বয়স যত বেশি হবে, তার দাম ও চাহিদা তত বেশি। বাইরে পনিরের চেয়ে তার পনিরের দাম তিন গুণ বেশি। কারণ তার পনির শতভাগ অর্গানিক। হিসাব করে দেখলাম তার ঘরে যে পরিমাণ পনির আছে তাতে কয়েক শ কোটি টাকার পনিরই সংরক্ষণে রয়েছে তার। চিজমেকিং প্লটে নিয়ে গেলেন ইয়ান। পনির ভেজানোর জন্য কেলটিক সমুদ্রের লবণ ব্যবহার করছেন। যেখানে ঘি প্রস্তুত হচ্ছে সে জায়গাটাও দেখালেন তিনি।

২০১৫ সালে নেদারল্যান্ডসের টেসেল দ্বীপের এক কৃষক পরিবারের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। যাদের ছিল ভেড়ার খামার ও চিজের ঘরোয়া কারখানা। ভেড়ার দুধ থেকে তারা চিজ তৈরি করতেন। তখন ঘরোয়া চিজ তৈরির চিত্র দেখেছিলাম। এটাও ভিন্ন নয়। আরও বিশাল। পনিরের স্বাদ নেওয়ার সুযোগ করে দিলেন ইয়ান। মুখে দিতেই বিশেষত্ব বোঝা গেল। একবারেই অতুলনীয় স্বাদ। ইয়ান তার রিমেকার খামারের প্রদর্শনী কেন্দ্রে নিয়ে গেলেন। যেখান থেকে তিনি পনির ও ঘি বিক্রি করেন। আমার বড় ছেলে অয়ন খুব পনির খেতে পছন্দ করে। তার জন্য ৫০০ গ্রাম চিজ ১৭ ইউরো দিয়ে কিনে নিলাম।

রিমেকার নামের এই খামার সত্যিই ঐতিহ্য সংরক্ষণের নমুনা বটে। বাণিজ্যিক উৎকর্ষ থেকে নিষ্ঠার সঙ্গে এভাবে চুলচেরা নিয়মে আভিজাত্য ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা সম্ভব। ইয়ান যদি আধুনিক ও বেশি উৎপাদনমুখী কোনো খামার গড়ে তুলতে চাইতেন, তা সহজেই সম্ভব ছিল। কিন্তু তার যেমন ঐতিহ্য সুরক্ষার ক্ষেত্রে আন্তরিকতা রয়েছে, একইভাবে রয়েছে সরকারি সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা। তাই তার খামার ও উৎপাদিত পণ্য শুধু নেদারল্যান্ডসেই নয়, গোটা ইউরোপেই আলাদাভাবে সমাদৃত।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। 

 

[email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর