সেই একাত্তর থেকে ধরে একাশির মে মাস-অবধি জীবনের সমাপনী দিন পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বাংলাদেশকে নিজের জীবনের সবকিছু ভেবে, নিজের সর্বস্ব দিয়ে যত ত্যাগ ও দুঃসাহসী কর্মকান্ড চালিয়ে গেলেন তা নিঃসন্দেহে অনন্য; তাঁর অতুলনীয় দেশপ্রেম আর রাষ্ট্রের প্রকৃত কর্মবীরের ভূমিকার যে অবদান সেসব তাকে যথার্থই ‘রাষ্ট্রনায়ক’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। আজ ৩০ মে- জিয়াউর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁর জীবনকালের ৪৫ বছর অবধি দেশ-মাতৃভূমির জন্য মানুষের মুক্তির জন্য যে লড়াই তিনি করে গেছেন তাতে তাঁর সেই জীবনাবসানকে ‘শাহাদাতবরণ’ বলা কি ভুল হবে! নিশ্চয়ই নয়। ১৯৮১ সালের এ দিনটিতে সামরিক বাহিনীর একটি চক্রের রাষ্ট্র-ক্ষমতা দখলের দীর্ঘমেয়াদি ষড়যন্ত্রে চট্টগ্রামে তিনি নিহত হন।
জিয়াউর রহমানের পূর্ণাঙ্গ জীবন-কর্ম গভীর-অধ্যয়ন করলে জানা যায়-তিনি এক মেধাবী বাবা-মা-এর সন্তান ছিলেন, বলা চলে, রক্তের উত্তরাধিকারে তিনি বিশাল-মাপের নেতা হওয়ার গুণাবলি পেয়েছিলেন। তাঁর বাবা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স ডিগ্রিধারী রসায়নবিদ এবং মা একজন সংগীতশিল্পী ছিলেন। তাঁর স্কুল-কলেজে অধ্যয়নকাল থেকেই তিনি সুশৃঙ্খল ও মেধাবী জীবন-বিকাশের পথে এগোচ্ছিলেন, তাঁর পিতৃ-মাতৃ-পরিবার যেমন তাকে সহায়তা করেছে, তেমনি তিনি নিজে বাল্যকাল থেকেই সমাজ ও রাষ্ট্রের নেতৃত্বদানের পথে এগোনোর যথার্থ শিক্ষা-দীক্ষা লাভের অঙ্গীকারে আবদ্ধ হয়ে নিজেকে গড়ে তুলছিলেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল সুনির্দিষ্ট-তিনি তাঁর জাতিকে নেতৃত্ব দিবেন; তিনি সেই লক্ষ্য-পথ থেকে সামান্যতম সময়ের জন্যও লক্ষ্যভ্রষ্ট হননি।
একাত্তরের মার্চের ২৬ তারিখের শুরুতে (২৫ মার্চ দিবা-শেষে মধ্য-রাতে) তিনি তৈরি হয়েই ছিলেন। তিনি জানতেন পাকিস্তানি বর্বর সামরিক বাহিনী বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের ওপরে চালাবে-নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ, আমাদের এই মাতৃভূমি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দেওয়ার ধ্বংসযজ্ঞের সব চেষ্টাই চালাবে। জিয়াউর রহমানের সামনে পথ খোলা ছিল বিদ্রোহ করার, কিন্তু সেটি রাজনৈতিক-নেতৃত্ব অনুমোদন দিতে পারেনি; তারা বিশ্ববাসীর সামনে প্রমাণ করতে চেয়েছেন বাঙালি তার রাষ্ট্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ, সে নির্মমভাবে দুই-যুগ ধরে চূড়ান্ত শোষিত-বঞ্চিত, সে তার গণতান্ত্রিক অধিকার চায়, তার ভোটের রায়ের, ন্যায়সঙ্গত সব পাওনা বাস্তবায়ন চায়, অর্থনৈতিক স্বাধিকার চায়, কিন্তু এই জাতি নিজ-রাষ্ট্রের ভিতরে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ এই ‘বদনাম’ নেওয়ার ঝুঁকিতে কেউ যেতে চাননি। যতক্ষণ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী একটা দখলদার বাহিনীতে রূপান্তরিত না-হয় ততক্ষণ তার বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিয়ে প্রতিরোধ-যুদ্ধ শুরুর সুযোগ নেই। কারণ, জাতিসংঘসহ বিশ্ব-সংস্থাগুলো রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি মাথা চাড়া দিয়ে ওঠার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। যারা আজকে অপগন্ডের মতো বলেন যে জিয়াউর রহমান পাক দখলদার সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ মানে মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ করতে দেরি করেছিলেন, তারা নিতান্তই বোধবুদ্ধিহীন-তখনকার সামগ্রিক বিশ্ব-প্রেক্ষাপট, ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি তথা পাকিস্তানের ভিতরকার একটা প্রদেশ পূর্ব-বাংলার অবস্থানগত দশার মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণ করার কোনো যোগ্যতাই রাখেন না।তখন সেই পরিস্থিতিতে মেজর জিয়াউর রহমানের চট্টগ্রামের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হিসেবে যে দায়িত্ব পালন বর্তায় তা লঙ্ঘন করে হঠাৎ-বিপ্লবী হয়ে ওঠার মতো বিষয়টি হঠকারিতা হতে পারত!
জিয়াউর রহমান জানতেন-পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরুর মাধ্যমে পুরোপুরি দখলদার বাহিনীতে রূপান্তরিত হবে এবং তখনই তাদের প্রত্যাঘাত করতে হবে। তিনি তা-ই করেছিলেন। ঠিক সময়মতো তিনি তাঁর অধীনস্থ বাঙালি সামরিক অফিসার ও অন্যসব সেনা-সদস্যদের নিয়ে দখলদার ও হানাদার পাক-বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন এবং প্রচন্ড শক্তিতে প্রতিরোধ-যুদ্ধ শুরু করলেন। যথাসময়ে মানে ২৭ মার্চ তিনি চট্টগ্রামের কালুরঘাট স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার-কেন্দ্র থেকে জাতির প্রধান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন। এই ঘোষণা সমগ্র বাঙালি জাতিকে দখলদার সেনাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ-যুদ্ধে ব্যাপকভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল, যা পরবর্তী তিন সপ্তাহের ‘শূন্যতার’ মধ্যে (স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার কর্মতৎপর হওয়ান অবধি) ছিল যুগান্তকারী।
স্বাধানতার ঘোষণার পরে তিনি তাঁর তিন শ সেনার বাহিনী নিয়ে একটানা মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি দখলদারদের বিরুদ্ধে লড়াই চালালেন এবং পরে আরও বিশাল সেনা সদস্যদের বাহিনী সংগঠিত করে নিয়ে প্রথমে সেক্টর কমান্ডার ও পরে ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেরা-বীর-এ পরিণত হলেন। তিনি তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড়-অবদান রাখলেন মুক্তিযুদ্ধে এবং ‘বীরউত্তম’ খেতাব পেলেন।
পরবর্তীকালে ১৯৭৫ সালের আগস্টের রাজনৈতিক ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পরে তিনি আবার রাষ্ট্রের গুরুদায়িত্ব পেলেন যখন তিনি সেনাপ্রধান। তিনি ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রক্ষমতায় অংশীদার হলেন দেশবাসীর সমর্থনে। তখনকার পরিস্থিতিতে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্র-ক্ষমতার অংশীদার না-হলে, দেশে চরম নৈরাজ্য চলত, সামরিক বাহিনীতে বিশৃঙ্খলা চরম পর্যায়ে গিয়ে এই দেশটিকে একটা ‘ব্যর্থ-রাষ্ট্রে’ পরিণত করতে পারত। সেটা দেশি-বিদেশি কূটনীতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাই মন্তব্য করেছেন।
জিয়াউর রহমান দেশের ও দেশবাসীর প্রয়োজনেই প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। তিনি রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপি গড়ে তুলেছিলেন ১৯৭৮ সালে। সেটাও অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল। কারণ, ‘বাকশাল’ বিলুপ্ত হওয়ার পরে আওয়ামী লীগ চারটা গ্রুপে বিভক্ত একটা খন্ড-বিখন্ড রাজনৈতিক দলে রূপান্তরিত হয়েছিল, তারা রাষ্ট্রের নেতৃত্ব দেওয়ার অবস্থায় ছিলেন না।
জিয়াউর রহমান সফল কূটনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করে রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিচ্ছিলেন, মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক মুসলিম দেশসমূহের নেতৃত্বের কাছে বাংলাদেশের যথাযথ স্থান অর্জন করতে পেরেছিলেন। সেই সঙ্গে এই দেশ থেকে মানবসম্পদ রপ্তানির বিশাল আয়ের সড়ক উন্মুক্ত করেছিলেন তিনি। সব ধরনের শিল্পকারখানা গড়ে তোলার পরিবেশ সৃষ্টি করেছিলেন জিয়াউর রহমান। প্রেসিডেন্ট জিয়ার অপরিসীম পরিশ্রমে এই দেশের ক্ষুদ্র শিল্পোদ্যোক্তা ব্যক্তি ও গ্রুপগুলো সংগঠিত হয়ে তৈরি পোশাক রপ্তানি শিল্প গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন দ্রুততার সঙ্গে। পাশাপাশি বস্ত্রশিল্পসহ অন্যসব ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পও গড়ে উঠতে থাকে, তার কৃতিত্বও জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বের দূরদর্শিতার। বস্তুত, বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান বিকাশের মূল-ভিত্তিভূমিটি তৈরি করে দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান-সেই সত্তর দশকের শেষ-ভাগে।
জিয়াউর রহমান দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম-রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে মুসলিম-বিশ্বের একজন শক্তিমান নেতায় পরিণত হয়েছিলেন, তিনি জাতিসংঘসহ বিশ্ব-সংস্থাগুলোতে তাঁর শক্তিশালী অবস্থান উপস্থাপন করতে পেরেছিলেন। ইরান-ইরাক যুদ্ধাবসানের কূটনৈতিক কর্মকান্ডে জিয়াউর রহমানের মূল্যবান অবদানের ব্যাপারে মুসলিম-বিশ্ব একমত। ওআইসি-তে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশকে বিশিষ্ট অবস্থান লাভের সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন। পাশাপাশি তিনি চীনের সঙ্গে যেমনি, তেমনি প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গেও কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করেছিলেন। সারা বিশ্বে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশকে তার বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের আদর্শের মাধ্যমে উঁচু-অবস্থানে তুলে ধরতে পেরেছিলেন। একটা সম্মানজনক অবস্থান পেয়েছিল আমাদের এই মাতৃভূমি। প্রেসিডেন্ট জিয়া সাফল্যের রূপকার তা নির্দ্বিধায় বলা চলে।
লেখক : বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব, সাবেক সংসদ সদস্য ও ডাকসু সাধারণ সম্পাদক।