মঙ্গলবার, ১৪ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

এ অসহিষ্ণুতা কার বিরুদ্ধে এবং কেন?

খায়রুল কবীর খোকন

এ অসহিষ্ণুতা কার বিরুদ্ধে এবং কেন?

জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যেতে চেয়েছিল শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল করে। তারা ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ ও অন্যসব ছাত্রসংগঠনের পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করতে চেয়েছিল। তাদের একবার নয়, তিন দিনে তিনবার লাঠিসোঁটা এমনকি আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলার শিকার বানিয়েছে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সহযোগী ছাত্রলীগ নেতারা এবং তাদের হামলায় অনেক ছাত্র এমনকি ছাত্রীও আহত হয়েছে। এর পরে উল্টো ছাত্রদলের কর্মীদের বিরুদ্ধেই মামলা করেছে ছাত্রলীগ এবং মার-খাওয়া ছাত্রদল নেতাদের বেশ কয়েকজনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। পত্রপত্রিকায় এ বিষয়ে রিপোর্ট হয়েছে- ‘মার খেয়ে ছাত্রদল কর্মীরা মামলার শিকারও হলো’।

পাশাপাশি আওয়ামী লীগ নেতারা বিএনপি ও অন্যসব বিরোধী দলের নেতাদের সম্পর্কে কটুকাটব্যে মেতে ওঠেন; তাঁদের প্রতিটি বক্তব্যই বিরোধী দল-নেতাদের প্রতি হুমকি-ধমকি। সেসব কোনো রাজনৈতিক পরিশীলিত কথাবার্তা নয়। এমনকি ক্ষমতাবান নেতারা ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী হামলাকে সমর্থন করে তাঁদের সহযোগী ওইসব ছাত্র নামধারীর ‘এনএসএফ-মার্কা’ কর্মকান্ডকে আরও উসকে দিচ্ছেন। যেখানে তাঁদের উচিত ছিল ছাত্রদলের ওপর হামলার জন্য ছাত্রলীগের দায়ী নেতাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া এবং তাদের সুস্থ ছাত্র রাজনীতির পথে ফিরিয়ে আনা সেখানে তাঁরা উল্টো তাঁদের ‘মোনায়েমখানি পান্ডাবাহিনী’তে রূপান্তরের কী অপচেষ্টাই না চালালেন! এনএসএফ গুন্ডা-পান্ডারা কি পাকিস্তানি স্বৈরাচার আইয়ুব খান আর তাঁর চেলা মোনায়েম খানকে রক্ষা করতে পেরেছিল? ঊনসত্তরের ছাত্র-গণ অভ্যুত্থানে ভেসে যাওয়ার সময় কোথায় ছিল সেই ‘মহাশক্তিধর’ এনএসএফ গুন্ডা-পান্ডারা। এখনকার ‘নব্য এনএসএফ পান্ডারা’-ও তেমনি ভেসে যাবে তাদের মাতৃসংগঠনের কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরতন্ত্রী মহাশক্তিধর নেতাদের সঙ্গে। তবে তারা সঙ্গে পাবে এ দেশের গণমানুষের অপরিসীম ধিক্কার। তাদের সারা জীবনের রাজনীতি (যদি ভালো কিছু থেকেও থাকে) বর্জ্যাগারে চলে যাবে।

একটানা সাড়ে ১৩ বছর ক্ষমতায় থাকা সরকারের প্রচুর অর্থ অপচয়ের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো রাষ্ট্র ও এ দেশের মানুষের কতটা উপকারে লাগবে তা নিয়ে দেশবাসীর মধ্যে অসংখ্য প্রশ্ন উঠেছে। শত শত প্রকল্প নেওয়া হয়েছে যেগুলোর অবদান কতটা এ দেশের মানুষের জন্য সরাসরি কাজে লাগবে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। তথাকথিত উন্নয়ন-অংশীদারদের যন্ত্রপাতি সরঞ্জামাদি ও অন্যসব সামগ্রী জোরজবরদস্তি কিনতে বাধ্য করার মধ্যে অনেক প্রকল্প নেওয়া হয়েছে এবং এখনো সেসব তৎপরতা চলমান। পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয় যে অসম্ভব হারে বেড়েছে তার পেছনে কী যুক্তি রয়েছে সেসব নিয়ে মানুষের অনেক প্রশ্ন। এ সেতুটির চীনা ঠিকাদারদের নির্মাণকাজ নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। পদ্মা সেতুর যে ‘এক শ বছর জীবৎকাল গ্যারান্টি’ দেওয়ার কথা তা ‘৪০ বছর টেকসই’ হবে কি না সন্দেহ রয়েছে। কারণ, সারা বিশ্বে চীনা ঠিকাদারদের মতো এমন অসাধু ও দায়িত্বজ্ঞানহীন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আর দ্বিতীয়টি নেই- এ রকম একটা প্রচার আছে। চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো লুটেরা ব্যবসা-বাণিজ্য ও ঠিকাদারি মুনাফার সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত। ১০ হাজার কোটি টাকার মূল প্রকল্প এমন দ্রুততার সঙ্গে প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকার ব্যয় পরিকল্পনায় রূপান্তর একেবারেই অযৌক্তিক। চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সরকারের মধ্যকার দুর্নীতিবাজ আমলা ও রাজনীতিকদের রীতিমতো ব্ল্যাকমেলিং (হাজার হাজার কোটি টাকা ঘুষদানের মাধ্যমে) করে এভাবে নির্মাণ ব্যয় বাড়িয়ে নিয়েছে।

আর সাড়ে ১৩ বছর ধরে অগণতান্ত্রিক ও কর্তৃত্ববাদী শাসনে, দেশময় দুর্নীতির বন্যায় ভেসে যাওয়া পরিস্থিতি আর নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জীবন অতিষ্ঠ করে ছাড়ছে। যা দেশবাসীর মধ্যে ব্যাপক হতাশা সৃষ্টি করেছে। আর সামনে জাতীয় নির্বাচনটি নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের পুরনো চক্রান্ত চালানোর প্রয়াস দেখে বিএনপিসহ সব বিরোধী দল আলোচনা-সমালোচনা চালাতে বাধ্য হচ্ছে। নেতারা নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি বারবার তুলে ধরছেন। আর তাতেই আওয়ামী লীগ নেতাদের গা-জ্বালা ধরেছে। তাঁরা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠছেন। কারণটা কী? কারণ এই যে, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের ১০ শতাংশ সংসদ আসন লাভের সুযোগও তিরোহিত হবে নিশ্চিতভাবে। নির্বাচনে হারলে লাখো দুর্নীতির মামলায় তাদের আসামি হতে হবে। এসব আতঙ্কে আওয়ামী লীগ নেতারা দিশাহারা হয়ে পড়েছেন। তাঁরা জানেন, পশ্চিমা বিশ্ব এবং নিকট প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোও কূটনৈতিকভাবে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার কায়েমের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে, কেউ আর কর্তৃত্ববাদী শাসনের পক্ষে আসবে না। তাই তাঁরা বিএনপি নেতাদের, অন্যসব বিরোধী নেতাদের প্রতি মারমুখো হচ্ছেন। এখন বিএনপি এবং অন্যসব বিরোধী নেতারা যদি বলেন- আওয়ামী ভাইসাহেবরা, পুলিশ ও রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোর সমর্থন ছাড়া নিজেদের নৈতিক শক্তির ওপর ভরসা করে পুরোপুরি নিরস্ত্র অবস্থায় মাঠে-ময়দানে আসুন। আমরাও আসব। শুধু একের বিরুদ্ধে অন্যের প্রকৃত অভিযোগগুলো তুলে ধরি দেশের মানুষের কাছে। দেখি দেশবাসী কার পক্ষে দাঁড়ায়?

আছে সেই সাহস আওয়ামী লীগের বন্ধুদের? নেই, অবশ্যই নেই। থাকলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের নিরস্ত্র শান্তিপূর্ণ মিছিলে সরকার-সমর্থক ছাত্রলীগ নেতাদের হামলা চালাতে হয় না। পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিয়ে সব ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদল এবং অন্যসব ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরা কেন থাকতে পারবেন না? অবশ্যই পারবেন, যদি নিজেদের দুর্বুদ্ধি ঝেড়ে ফেলতে পারেন তারা; যদি সত্যিকার দেশপ্রেমিক হন, যদি দেশের মানুষকে তারা আসলেই ভালোবাসতে চান।

আওয়ামী লীগের বন্ধুদের বলতে চাই- নিজেদের ৭২ বছর বয়সী দলটির জনপ্রিয়তার ওপর ভরসা রাখতে শিখুন, নিজেদের শতভাগ সংশোধন করে পরিচ্ছন্ন দেশপ্রেমের রাজনীতিতে অভ্যস্ত হোন। তাহলে অহেতুক বিএনপি বা অন্য বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে বিষোদগারের অশালীন রাজনীতি করতে হবে না, দেশ-মানুষের ভালোবাসা পেলে আবার ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারবেন। তার আগে আপনাদের নিজেকে নিজে ‘পাপমুক্ত’ করতে হবে।

লেখক : বিএনপির যুগ্মমহাসচিব, সাবেক সংসদ সদস্য ও ডাকসু সাধারণ সম্পাদক।

সর্বশেষ খবর