বৃহস্পতিবার, ৩০ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা
ইতিহাস

সম্রাট বাবরের অসুস্থতা

ঘাঘড়ার যুদ্ধের বেশ কয়েক মাস আগেই, ১৫২৭ সালের ১৬ মার্চ খানুয়ার যুদ্ধে রাজপুতদের পরাজিত করে সম্রাট বাবর নিজের পরিবারের জন্য ভারতকে নিরাপদ ভাবতে শুরু করেন। তিনি কাবুল দুর্গে অবস্থানরত তাঁর পরিবারকে আগ্রা আসার অনুমতি প্রদান করেন। এর কিছুদিন পরই বাবরের পুরো পরিবার আগ্রা দুর্গে চলে আসে। নিজের স্ত্রী ও পরিবারবর্গ নিয়ে বাবর বেশ কিছুদিন শান্তিতেই কাটাতে লাগলেন।

সাম্রাজ্যসংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে বাবরকে কাজ করতে হচ্ছিল, তবে এ সময়টুকু তিনি নিজের মতো করে তাঁর পরিবারের সঙ্গে অতিবাহিত করলেন। এ সময় তিনি তাঁর প্রিয় স্ত্রী মাহাম বেগমকে নিয়ে ধোলপুর থেকেও একবার ঘুরে আসেন। কিন্তু এর তিন মাস পরই মোগল পরিবারে পারিবারিক একটি সমস্যার উদ্ভব হয়। প্রচ- পেটে ব্যথার কারণে সম্রাটের এক পুত্র অসুস্থ হয়ে হঠাৎ মারা যান। সম্রাট বাবর ও দিলদার বেগমের এই পুত্রের নাম আলোয়ার মির্জা। ঘটনার আকস্মিকতায় পুরো মোগল পরিবার হতভম্ব হয়ে যায়। মোগল রাজদরবারে নেমে আসে শোকের ছায়া। পুত্রশোকে দিলদার বেগম পাগলপ্রায় হয়ে যান।

এ শোক না কাটতেই দিল্লি থেকে মাওলানা মোহাম্মদ ফারগালি বাবরের জন্য একটি পত্র পাঠালেন। পত্রে ফারগালি দিল্লিতে বাবরের প্রিয় পুত্র হুমায়ুনের অসুস্থতার খবর জানালেন। এ পত্র পেয়ে বাবর দ্রুত হুমায়ুনকে দিল্লি থেকে রাজধানী আগ্রায় নিয়ে আসার নির্দেশ দিয়ে আগ্রার দিকে ছুটতে লাগলেন। বাবরের সঙ্গে তখন হুমায়ুনের মা মাহাম বেগম ছিলেন। পুত্রের অসুস্থতার কথা শুনে তিনি ইতোমধ্যে বেশ কয়েকবার জ্ঞান হারিয়েছিলেন। যা-ই হোক, হুমায়ুনের সঙ্গে মাহাম বেগমের মথুরার কাছাকাছি এসে দেখা হলো। পুত্রকে দেখে মাহাম বেগম নিজের আবেগ সামলে রাখতে পারলেন না। পুত্রের এরূপ অসুস্থতায় তিনি উ™£ান্তের মতো আচরণ করতে লাগলেন। এর অবশ্য কারণও ছিল। হুমায়ুন কখনই এ রকম গুরুতর অসুস্থতায় ভোগেননি। বাবরের এক পুত্র আলোয়ার মির্জা কিছুদিন আগেই মারা গেছেন। কাজেই মাহাম বেগমের মাথায় সবচেয়ে খারাপ চিন্তাটাই আগে ভর করল। উন্নত চিকিৎসার জন্য শাহজাদা হুমায়ুনকে দ্রুত নৌকাযোগে রাজধানী আগ্রা নিয়ে নিয়ে আসা হলো। আগ্রার রাজপ্রাসাদে তৎকালীন শ্রেষ্ঠ চিকিৎসকরা হুমায়ুনের চিকিৎসা শুরু করলেন। বাবরের মনে তখন আর কোনো শান্তি ছিল না। হুমায়ুনকে তিনি তাঁর অন্য যে কোনো পুত্র থেকে বেশি ভালোবাসতেন। গোটা ভারত অভিযানের সময় বাবরকে সঙ্গ দিয়েছিলেন তাঁর এই পুত্র। তাই বাবর আর হুমায়ুনের মধ্যে একটি বিশেষ আন্তরিক বন্ধন তৈরি হয়েছিল, যা বাবরের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বজায় ছিল। বাবরপুত্রের অসুস্থতায় অস্থির হয়ে ঘন ঘন পুত্রের শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নিচ্ছিলেন। হুমায়ুন প্রায় অচেতনের মতো বিছানায় শুয়ে ছিলেন। তবে পিতাকে দেখে তিনি নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেন না। হুমায়ুন সম্রাট বাবরকে আক্ষরিক অর্থেই প্রচ- ভালোবাসতেন আর শ্রদ্ধা করতেন।

হুমায়ুনের অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছিল। মাহাম বেগমের মাতৃআবেগ ধীরে ধীরে লাগামছাড়া হয়ে যাচ্ছিল। একদিন তিনি সম্রাট বাবরকে পুত্রের জন্য বিচলিত হতে দেখে বলে বসলেন, ‘আমার ছেলের জন্য আপনার আর কতটুকু দুশ্চিন্তা আছে? আপনার আরও ছেলে আছে, কিন্তু আমার ছেলে তো মাত্র একটিই।’ কিন্তু মাহাম বেগম হয়তো কখনই ধারণা করতে পারেননি, বাবর তাঁর এ পুত্রটির জন্য তাঁর মনে কতটা ভালোবাসা সঞ্চয় করে রেখেছিলেন। সম্রাট বাবর নিজে জানতেন হুমায়ুনকে তিনি কতটা ভালোবাসতেন। আর তাই পুত্রের রোগশয্যার পাশে বসে পুত্রের জন্য একমনে তিনি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতেন। তার পরও চিকিৎসা কিংবা প্রার্থনা- হুমায়ুনের জন্য এর কোনোটিই কাজ করছিল না। সুস্থতার কোনো লক্ষণই হুমায়ুনের মধ্যে দেখা যাচ্ছিল না। এ সময় বাবরের দরবারের বেশ কয়েকজন পরামর্শ দিলেন, বাবর যদি তাঁর নিজের জীবনের সবচেয়ে প্রিয় বস্তুটি উৎসর্গ করে দেন তাহলে হয়তো আল্লাহ তাঁর পুত্র হুমায়ুনের জীবন ভিক্ষা দিতে পারেন। এ কথা শোনামাত্র বাবর ভাবতে লাগলেন এমন কী আছে যা তিনি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন। হঠাৎ বাবরের মাথায় এলো প্রতিটি মানুষই তাঁর নিজের জীবনকে অন্য সবকিছুর চেয়ে বেশি ভালোবাসে। আর তাই বাবর তাঁর পুত্র হুমায়ুনের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। কারণ একজন পিতা হিসেবে বাবর তাঁর পুত্র হুমায়ুনকে তাঁর জীবন থেকেও বেশি ভালোবাসতেন।

বাবর চাইছিলেন নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও পুত্র হুমায়ুনের জীবন যেন রক্ষা পায়। এর পরই এক রাতে তিনি পুত্রের শয্যার পাশে চক্রাকারে ঘুরতে লাগলেন, আর বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, ‘হে আল্লাহ! যদি একজনের প্রাণ নিয়ে আরেকজনের প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়, তাহলে পুত্রের প্রাণের বিনিময়ে আমার নিজের প্রাণ উৎসর্গ করতে আমি প্রস্তুত।’ আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, এর কিছুদিন পরই হুমায়ুন ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠতে লাগলেন। আর বাবর ধীরে ধীরে অসুস্থ হতে শুরু করলেন। তবে হুমায়ুনের সুস্থ হয়ে ওঠা আর বাবরের অসুস্থ হয়ে মৃত্যুশয্যায় যাওয়ার মধ্যে কয়েক মাসের ব্যবধান ছিল।

                আবদুর রশিদ।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর