রূপকথার ফিনিক্স পাখির কথা অনেকের জানা। যে পাখি ভস্মের মধ্য থেকে উড়াল দেওয়ার সাহস দেখাত। বাংলাদেশকে বলা যায় রূপকথার সেই ফিনিক্স পাখির নতুন সংস্করণ। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল বাংলাদেশ। ৩০ লাখ মানুষ প্রাণ হারায় দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে। ১ কোটি মানুষ দেশ ছেড়ে প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয় নেয় ভারতে। সম্ভ্রম হারান ২ থেকে ৩ লাখ মা-বোন। বাংলাদেশে পোড়ামাটি নীতি গ্রহণ করেছিল পাকিস্তানি বর্বররা। মানুষ নয়, মাটি চাই- এ নীতিতে তারা চালিয়েছে গণহত্যা। হাজার হাজার ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেছে। ১ কোটি মানুষ দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল। দেশের অভ্যন্তরে আশ্রয়হীন হয়েছিল ৩ কোটি মানুষ। তার পরও মুক্তিযুদ্ধে জিতেছিল বাঙালিরা। পাকিস্তানি বাহিনীকে তারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করেছিল। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদদ পেয়েও পাকিস্তানিরা টিকতে পারেনি। বিশ্ব অবাক বিস্ময়ে দেখেছিল সুকান্তের কবিতার সেই সত্যি- বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি দেখে নিক দুর্বৃত্ত। যুক্তরাষ্ট্র সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েও বাংলাদেশের বিজয় ঠেকাতে পারেনি। সে ক্ষোভেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র সচিব হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে বলেছিলেন তলাবিহীন ঝুড়ি।
সেই বাংলাদেশ পশ্চিমাদের বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছে। তারা শুধু মুক্তিযুদ্ধে জেতেনি, স্বাধীনতা সুরক্ষায়ও কৃতিত্ব দেখিয়েছে। বলা হয়, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ছাড়া রাজনৈতিক স্বাধীনতা কখনো পূর্ণাঙ্গ হয় না। অনেকের মতে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ছাড়া রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্থহীন। বাঙালি বুকের রক্ত দিয়ে কিনে এনেছিল স্বাধীনতা। যারা বলত তলাবিহীন ঝুড়ি তাদের মুখে ছাই দিয়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক স্বাধীনতার দুঃসাহস দেখিয়েছে। এ দুঃসাহসের নাম পদ্মা সেতু। বাংলাদেশ ৩০ হাজার ১৯৩ দশমিক ৩৯ কোটি টাকার প্রকল্প নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন করে প্রমাণ করেছে পদ্মা মেঘনা যমুনা বুড়িগঙ্গা পাড়ের মানুষ হার মানতে জানে না। পদ্মা সেতু তৈরি করে দুনিয়ার একমাত্র পরাশক্তির তলপিবাহক সংস্থা বিশ্বব্যাংকের মুখেও চুনকালি লাগিয়েছে বাংলাদেশ। পদ্মা সেতু বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সামর্থ্যরে যেমন প্রতীক, তেমন দেশের প্রায় এক তৃতীয়াংশ অর্থাৎ সাড়ে ৪ কোটি মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের এক আলাদিনের চেরাগ।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার সাড়ে ৪ কোটি মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে কাক্সিক্ষত ভূমিকা রাখতে চালু হয়েছে পদ্মা সেতু নামের আলাদিনের চেরাগ। ওই অঞ্চলের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে জাতীয় উন্নয়নের মূল স্রোতের অংশীদার করবে। তাদের জীবনমানের উন্নয়নে অবদান রাখবে। যেমনটি রেখেছে যমুনা নদীর ওপর নির্মিত বঙ্গবন্ধু সেতু। সবারই জানা, যমুনা সেতুর আগে দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলো ছিল সব দিক থেকে পিছিয়ে। খাদ্য উৎপাদনে এগিয়ে থাকলেও প্রতি বছর ওই এলাকায় মঙ্গা নামের মিনি দুর্ভিক্ষ হতো। বঙ্গবন্ধু সেতু সে দুর্ভাগ্যের অবসান ঘটিয়েছে। উত্তরাঞ্চলকে জাতীয় অগ্রগতির ধারায় যুক্ত করেছে।পদ্মা সেতু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সৌভাগ্যের প্রতীক হয়ে দেখা দেবে অচিরেই। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের আর্থসামাজিক পরিবর্তন আনবে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। নিজস্ব অর্থায়নে এত বড় অবকাঠামোর বাস্তবায়ন করে রীতিমতো অসম্ভবকে সম্ভব করেছে বাংলাদেশ। নিজস্ব অর্থায়নে বৃহৎ এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে বিশ্বকে নিজেদের সামর্থ্যরে বার্তা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। পদ্মা সেতুর ফলে দক্ষিণের ২১ জেলার উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। জাতীয়ভাবে অন্তত ১ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি বাড়বে পদ্মা সেতু বাস্তবায়নে। ২১ জেলার ক্ষেত্রে জিডিপি বাড়বে অন্তত ২ দশমিক ৩ শতাংশ।
পদ্মা সেতু নির্মাণে লেগেছে সাড়ে সাত বছর। এ সেতুর ওপর দিয়ে প্রতিদিন বিভিন্ন রকমের অন্তত ২৪ হাজার গাড়ি চলবে। যা থেকে টোল আদায় হবে প্রতিদিন সাড়ে ৪ কোটি টাকার মতো। আনুষ্ঠানিকভাবে সেতুর কাজ শুরু হয় ২০১৪ সালের ৭ ডিসেম্বর। উদ্বোধন হয়েছে ২৫ জুন, ২০২২। পরদিন থেকে সেতুর ওপর দিয়ে চলছে যানবাহন। বাংলাদেশের স্বপ্ন, সমৃদ্ধির প্রতীক পদ্মা সেতুর মাধ্যমে রাজধানীর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হয়েছে ২১ জেলা। এতে দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটবে।
১৯৭২-৭৩ সালে বিশ্বব্যাংকের প্রধান রবার্ট ম্যাকনামারা বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশকে সব সময় বিদেশি সাহায্যের ওপর নির্ভর করেই চলতে হবে। যে কোনো রাষ্ট্রের জন্যই এভাবে টিকে থাকা অসম্ভব।’ বিশ্বব্যাংকের ১৯৭৩ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল- ‘দেখার বিষয় বাংলাদেশ কত দিন টেকে এবং কীভাবে টেকে। সবচেয়ে ভালো অবস্থায়ও বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত কঠিন উন্নয়ন সমস্যা বিদ্যমান। জনগণ দরিদ্র। মাথাপিছু আয় ৫০ থেকে ৭০ ডলার। যা গত ২০ বছরে মোটেও বাড়েনি। মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যা বাংলাদেশকে ক্রমেই অস্তিত্বের সংকটে ঠেলে দেবে।’ বিশ্বব্যাংকের সে ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যা প্রমাণ করে বাংলাদেশ মাত্র ৫০ বছরের মধ্যে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় জিডিপি প্রবৃদ্ধির দেশে পরিণত হয়েছে। পদ্মা সেতু সম্পর্কে বিশ্বব্যাংকের ভুয়া অভিযোগের কারণে বাংলাদেশের শত শত কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। প্রথমত, বিশ্বব্যাংকের কারণে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করতে কমপক্ষে দেড় বছর দেরি হয়েছে। পদ্মা সেতু দেড় বছর আগে চালু হলে প্রতিদিন সাড়ে ৪ কোটি হিসেবে দেড় বছরে ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা আয় করতে পারত বাংলাদেশ। সমালোচকরা বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণে প্রাক্কলিত অর্থের চেয়ে অনেক বেশি খরচ হয়েছে। কথাটি সত্যি হলেও কারণগুলোও স্পষ্ট। নদীশাসন ও পিলার বসানোর কাজে খরচ বেড়েছে ব্যাপকভাবে। পিলার বসাতে গিয়ে বিপাকে পড়েন প্রকৌশলীরা। একজন প্রকৌশলী বলেছেন, পদ্মা সেতুর পিলার বসাতে যে ধকল পোহাতে হয়েছে তা সত্যিকার অর্থেই নজিরবিহীন। আমরা আশা করব সরকারের পক্ষ থেকে পদ্মা সেতুর খরচের সব বিবরণ যথাসময়ে জাতির কাছে তুলে ধরা হবে। একই সঙ্গে তুলে ধরা হবে পদ্মা সেতু নিয়ে ষড়যন্ত্রের ইতিবৃত্ত।
লেখক : প্রবন্ধকার।