শিরোনাম
শনিবার, ১৬ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

সুপরিকল্পিতভাবে প্রসারিত হোক গবাদি প্রাণীর বাজার

শাইখ সিরাজ

সুপরিকল্পিতভাবে প্রসারিত হোক গবাদি প্রাণীর বাজার

নেত্রকোনার মেঘশিমুল গ্রামের মনিরা আক্তার এ বছর একটি ষাঁড় গরু বিক্রি করেছেন ১ লাখ ২৫ হাজার টাকায়। তিনি একজন গৃহিণী। স্বামী স্থানীয় বাজারের ছোটখাটো মুদি দোকানি। দেড় বছর আগে কোরবানির বাজারের কথা চিন্তা করে ২৫ হাজার টাকায় একটি ষাঁড় বাছুর কিনেছিলেন মনিরা। ঘর-সংসারের কাজের ফাঁকে বাছুরটিকে লালনপালন করে বড় করেছেন। এই কোরবানির বাজারে সেটি বিক্রি করে ১ লাখ টাকা তিনি লাভ করেছেন। যদিও গরুর খাবার খরচ এবং এর পেছনে শ্রমের মূল্য তিনি হিসাব করছেন না; তবে তিনি এ টাকায় গরুটি বিক্রি করতে পেরে খুশি। মনিরার মতো অসংখ্য মানুষের গল্প আছে কোরবানির বাজার ঘিরে। ধীরে ধীরে এমন ক্ষুদ্র থেকে মাঝারি ও বড় খামারির হাত ধরে রচিত হচ্ছে দেশের প্রাণিসম্পদ খাতের বড় বাজার। এটা বেশ আশার কথা। তবে যা হয়, একটা বাজার তৈরি হওয়ার পর বড় ব্যবসায়ীদের কাছে পরাজিত হতে থাকেন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা। যেমনটা আমরা দেখেছি পোলট্রি খাতে। কোরবানি ঘিরে শহরের কাছাকাছি গড়ে ওঠা কিছু খামার ব্যবসায়ী নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন শহরের কোরবানির বাজার। তারা গ্রাম থেকে গরু কম দামে কিনে নিজেদের খামারে সংরক্ষণ করেন। তারপর সারা বছর বেশি দামে শহরের কাঁচাবাজারগুলোয় সরবরাহ করেন। এ বিষয়গুলোয় আমাদের সতর্ক হতে হবে। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক খামারিদের বড় হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। তা হলেই এ খাতের উন্নয়ন টেকসই হবে।

প্রাণিসম্পদ অধিদফতর বলছে ঈদুল আজহায় সারা দেশে ৯৯ লাখ ৫০ হাজার ৭৬৩টি গবাদি পশু কোরবানি হয়েছে। তাদের এ পরিসংখ্যানের ভিত্তি ও নির্ভরযোগ্যতা সম্পর্কে তেমন কিছু জানি না। তবে তারা বলছেন গত বছরের তুলনায় এ বছর ৮ লাখ ৫৭ হাজার ৫২১টি গবাদি পশু বেশি কোরবানি হয়েছে। গত বছর সারা দেশে মোট ৯০ লাখ ৯৩ হাজার ২৪২টি গবাদি পশু কোরবানি হয়েছিল। কোরবানির সংখ্যা যা-ই হোক, আমি যতটুকু খোঁজখবর নিয়েছি কোরবানি নিয়ে এ বছর ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েই সন্তোষজনক অবস্থানে আছেন। কিন্তু সন্তুষ্ট নন কোরবানির পশুর চামড়ার দাম নিয়ে। এ দেশে সাধারণত কোরবানিকৃত গবাদি পশুর চামড়া বিনামূল্যে মাদরাসা ও এতিমখানায় দান করে দেওয়া হয়। একটা সময় মাদরাসা ও এতিমখানা পরিচালনার গুরুভাগ মেটানো হতো চামড়ার পয়সা দিয়ে। যে চামড়া ১২০০-১৫০০ টাকায় বিক্রি হতো সে চামড়া ৫০০ টাকায়ও বিক্রি করা যায়নি। অনেকেই চামড়ার দাম না পেয়ে মাটিতে পুঁতে ফেলেছেন। সম্পদের কী অপচয়! অথচ এ চামড়া ঘিরেই তৈরি হতে পারে দারুণ এক অর্থনৈতিক বলয়। যেখানে লাখ লাখ তরুণ বেকার সেখানে এ চামড়া করতে পারে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা। আমরা হাজার হাজার পশুর চামড়া মাটিতে পুঁতে নষ্ট করছি। অথচ ইউরোপ-আমেরিকায় চামড়ার তৈরি পণ্যের কদর অন্যরকম। সবেচয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের দেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে কমপ্লায়েন্স ইস্যুতে আন্তর্জাতিক কোনো স্বীকৃতি নেই। চামড়াজাত পণ্যের সবচেয়ে বড় বাজার ইউরোপে রপ্তানির জন্য ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড অর্গানাইজেশন ও লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের পরিবেশ স্বীকৃতি সনদের প্রয়োজন হয়। আমি যত দূর জানি এ দুটি ক্ষেত্রেই আমরা পিছিয়ে আছি। ফলে ইউরোপের সব দেশে বাংলাদেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য ঢুকতে পারছে না। অথচ এ চামড়া ঘিরে বড় অর্থনৈতিক ও শ্রম বাজার গড়ে ওঠার দারুণ একটি সম্ভাবনা রয়েছে।

লেখাটি শুরু করেছিলাম কোরবানির গরু নিয়ে। আমাদের দেশে গরু লালনপালন বাড়ছে। বলা চলে গরু লালনপালন হচ্ছে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মতো বড় বড় শেডে। বিশাল সব খামার গড়ে উঠেছে সারা দেশে। গরু লালনপালনে এগিয়ে এসেছে তরুণ প্রজন্মও। মনে পড়ে সেই আশির দশকে যখন ‘মাটি ও মানুষ’ করছি তখন কৃত্রিম প্রজনন নিয়ে বেশ কিছু প্রতিবেদন তৈরি করেছিলাম। দেশি জাতের গরুর সঙ্গে বিদেশি গরুর ক্রস করে সংকর জাতের গরু তৈরি করে দুধের উৎপাদন বেড়েছে। বেড়েছে মাংসের উৎপাদনও। আগে যেখানে একটা গাভি ২-৩ লিটার দুধ দিত, সেখানে পাওয়া গেল ১৮-২০ লিটার। কিন্তু উৎপাদিত দুধ নিয়ে কৃষক পড়ল বিপাকে। কারণ দুধ সে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করতে পারেনি। সে রকম বাজার অবকাঠামো তৈরি হয়নি। ভারত তাদের দুধের বাজারে বিপ্লব ঘটিয়েছে। আমরা তেমনটি পারিনি। বরং বিদেশ থেকে কৌটাজাত গুঁড়া দুধ আমদানি করে দেশি বাজার ফেলেছি হুমকির মুখে। গত ৪০-৪৩ বছরে আমাদের মাংসের চাহিদা মিটেছে কিন্তু দুধের চাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রে খুব একটা অগ্রগতি দেখিনি। তবে আশার কথা ডেইরি ডেভেলপমেন্ট প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। হয়তো এবার কিছু একটা পরিবর্তন আসবে। মাস চারেক আগে রাজধানীতে আয়োজিত একটি ক্যাটেল শোয় উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়েছিল। সেখানে কথা হয় প্রাণিসম্পদ বিভাগের গবেষক ড. মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানির সঙ্গে। তিনি এক অদ্ভুত সাফল্যের গল্প শোনালেন। ৯ ডিসেম্বর, ১৯৮৯-এ স্পেনের রানির দেওয়া উপহার একটা গরু বিমানযোগে বাংলাদেশে আনা হয়। গরুটির নাম ‘এফ এস সুলতান’। এফ এস সুলতান স্থানীয় জাতের গাভির গর্ভে জন্ম দেয় এফ ৬৫ নামক এক ষাঁড় বাছুরের। সে বাছুর বড় হয়ে স্থানীয় জাতের আরেক গাভির গর্ভে জন্ম দেয় জে আর ০১ নামক আর এক ষাঁড় বাছুরের। সেই জে আর ০১ ষাঁড়টি বড় হলে ২০১৩ সালে তাকে প্রুভেন কাউ হিসেবে সিলেক্ট করা হয়। তারপর প্রজেনি টেস্ট কাউ অর্থাৎ পরীক্ষিত সন্তান হিসেবে তার বীজ ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। ৪ লাখ ২৯ হাজার ৩৮০ ডোজ সিমেন বা বীজ বিক্রি হয়। এগুলোর সফলতার হার শতকরা ৫০ ভাগ ধরলেও নয় বছরে কমপক্ষে ১ লাখ গাভি ও ১ লাখ ষাঁড়ের জন্ম হয়েছে ওই জে আর ০১-এর সিমেন বা বীজ থেকে। এ হিসাবে প্রতিটি ষাঁড় থেকে গড়ে ৬০০ কেজি মাংস পেলে ১ লাখ ষাঁড় থেকে পাওয়া গেছে ৬ কোটি কেজি মাংস। প্রতি কেজি মাংসের গড় মূল্য ৪০০ টাকা দরে মোট হয় ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। আবার ১ লাখ গাভি থেকে প্রতি গাভির দুধ প্রদান কাল (ল্যাকটেশন পিরিয়ড) পাঁচটি ধরে প্রতি দুধ প্রদান কালে ৪ হাজার ৫০০ লিটার দুধ হলে মোট দুধের পরিমাণ হয় ২২৫ কোটি লিটার। প্রতি লিটার দুধের দাম গড়ে ৪০ টাকা হিসাবে ধরলে দাঁড়াবে মোট ৯ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ ওই একটি গরু থেকে ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকার মাংস ও ৯ হাজার কোটি টাকার দুধ; মোট ১১ হাজার ৪০০ কোটি টাকার বাণিজ্য হয়ে গেল। শুধু তাই নয়, ৪ লাখ ২৯ হাজার ৩৮০ ডোজ সিমেন বিক্রয়পূর্বক প্রতি ডোজ ৩০ টাকা হিসাবে ১ কোটি ২৮ লাখ ৮১ হাজার ৪০০ টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হয়েছে।

এ এক অভূতপূর্ব সাফল্যের খবর। এরই ধারাবাহিকতায় এখন জে আর ০১ থেকে জন্ম নেওয়া আটটি ষাঁড় থেকে সিমেন অর্থাৎ বীজ সংগ্রহ করে বিক্রি করা হচ্ছে। তার মানে, আমাদের দেশে গরু লালনপালনের হার দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা একদিকে যেমন আশার কথা, অন্যদিকে হতাশারও। কয়েকদিন আগে দক্ষিণ আফ্রিকার ইকো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের খেতাব জেতা কাউস্পিরেসি প্রামাণ্যচিত্রটি দেখছিলাম। চলচ্চিত্রটিতে বলা হয়েছে, গরুই মিথেন গ্যাস সবচেয়ে বেশি নিঃসরণ করছে, যার ফলে সৃষ্টি হচ্ছে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের। পানির ব্যবহারও গরুর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি। প্রায় ২ হাজার ৫০০ গ্যালন পানি লাগছে গরুর ১ পাউন্ড মাংস উৎপাদনে। সার্বিকভাবে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের পেছনে গরুর অবদান নাকি শতকরা ৫১ ভাগ। তারা আরও বলছেন, অ্যামাজন বনের ৯১ ভাগ রেইনফরেস্ট নষ্ট হয়েছে গরুর জন্য অতিরিক্ত পানির জোগান দিতে গিয়ে। বনে আগুন লাগার পেছনেও নাকি গরুরই যত দোষ। এমনকি খরা, সমুদ্রে ডেড জোন, বিভিন্ন প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার পেছনে গরুর পানি ব্যবহার, গ্যাস নিঃসরণ, মলমূত্র এসবকেই দায়ী করছেন। তবে তারা এর সমাধান হিসেবে কিছুই এখনো সামনে আনতে পারেননি। কারণ গরুর মাংস ও দুধ সারা বিশ্বেই প্রয়োজন এবং এটি অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। এ নিয়ে বাংলাদেশেও কাজ করেছেন ড. নাথুরাম সরকার, খান শহীদুল্লাহ। একেবারে মাঠ পর্যায়ে কাজ করছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানিমল নিউট্রিশন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আল মামুন। তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় অনেক আগে থেকেই। তিনি যখন জাপানে এ বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করছিলেন তখন খুব কাছ থেকে তাঁর কাজগুলো দেখার সুযোগ হয়েছিল। তিনি জানালেন, কথা মিথ্যা নয়। গবেষণায় প্রমাণিত, পৃথিবীতে যে পরিমাণ মিথেন উৎপন্ন হয় তার ৪৭% গবাদি পশু থেকে আসে। কিন্তু কার্বন ডাইঅক্সাইডের তুলনায় মিথেনের আয়ুষ্কাল খুবই কম যার নির্গমন নিয়ন্ত্রণযোগ্য। বিভিন্ন ধরনের ফিড এডিটিভ, ভালো মানের খাদ্য ও উন্নত জাতের গরুর মাধ্যমে এ নির্গমন ৩০% পর্যন্ত কমানো সম্ভব। ইতোমধ্যে সারা বিশ্বে যেমন নিউজিল্যান্ড ও আমেরিকা ২০৫০ সাল নাগাদ জিরো (০) কার্বন ইমিশন লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছে। বাংলাদেশেও তিনি এ বিষয় নিয়ে কাজ করছেন।

এ প্রসঙ্গ টানার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, গবাদি পশু লালনপালনের বিষয়টি যেভাবে বিস্তৃত হচ্ছে তা যেন হয় সুপরিকল্পিত ও নিয়ন্ত্রিত। বৈদেশিক বাজার তৈরির পাশাপাশি পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে। ভাবতে হবে সবার লাভের কথা, ভবিষ্যতের কথা।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।  

[email protected]

 

সর্বশেষ খবর