বৃহস্পতিবার, ২১ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

এক দুই তিন চার

তসলিমা নাসরিন

এক দুই তিন চার

১. ইরানের বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা জাফর পানাহিকে গ্রেফতার করা হয়েছে, ছ’বছরের কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে। কী দোষে জাফর পানাহিকে এমন শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখি, সরকারবিরোধী যে আন্দোলন হচ্ছে, সেই আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলেন জাফর পানাহি। মোহাম্মদ রাসুলফ এবং মোস্তফা আল-এ আহমেদ নামের আরও দুজন চলচ্চিত্র নির্মাতাকেও গ্রেফতার করা হয়েছে, তাঁরাও সরকারবিরোধী আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। গত মে মাসে আবাদান নামের এক শহরে ১০ তলা বিল্ডিং ধসে গিয়ে ৪০ জন লোক মারা গিয়েছিল। এই ঘটনার প্রতিবাদ করছে লোকেরা। প্রতিবাদকে সমর্থন করলেই জেল হচ্ছে দেশের গুণীজনদের। রাষ্ট্রব্যবস্থার সমালোচনা করার জন্য ২০১০ সালেও জাফর পানাহিকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তখনও ছ’বছরের কারাদন্ড দেওয়া হয়েছিল তাঁকে, ২০ বছরের জন্য দেশের বাইরে তাঁর ভ্রমণ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। বাকস্বাধীনতাহীন কী অদ্ভুত দেশ এই ইরান! এই দেশ কি জানে না জাফর পানাহি প্রচুর আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন? ২০১৫ সালে বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে তাঁর ‘ট্যাক্সি’ ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্থাৎ গোল্ডেন বেয়ার পুরস্কার পেয়েছেন, কান থেকে শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যের জন্যও পুরস্কার পেয়েছেন ২০১৮ সালে। ভেনিস আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের গোল্ডেন লায়ন পুরস্কার পেয়েছেন তাঁর ‘দ্য সার্কেল’ ছবির জন্য, ২০০০ সালে। মোহাম্মদ রাসুলফও কিন্তু বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসব থেকে তাঁর ‘কোথাও কোনও শয়তান নেই’ ছবির জন্য ২০২০ সালে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পেয়েছেন। কান চলচ্চিত্র উৎসব থেকে ২০১১ সালে পেয়েছেন তাঁর ‘বিদায়’ ছবির জন্য। ইরান সরকারের নিশ্চয়ই কিছু যায় আসে না কোন শিল্পী দেশের নাম কতটা উজ্জ্বল করেছেন, তা নিয়ে। আলোকিত মানুষদের অন্ধকার কূপে ছুড়ে ফেলতে চিরকালই ধর্মান্ধ রাষ্ট্রনায়কেরা সিদ্ধহস্ত। দেশের ভালো নিয়ে যাদের কোনও মাথাব্যথা নেই, তারাই আজ দেশের হর্তাকর্তা।

ইসলামী বিপ্লবের পর মানবাধিকার বলতে কিছু নেই ইরানে। যারাই মুখ খুলে কিছু অপ্রিয় সত্য বলতে চেয়েছে, সরকারের সমালোচনা করেছে, মৌলবাদের অবসান চেয়েছে, নারীর প্রাপ্য অধিকার দাবি করেছে, তাদের অকথ্য নির্যাতন করা হয়েছে, কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে, মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, সমকামী, রূপান্তরকামী, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তি, সচেতন শিল্পী সাহিত্যিক আজও নির্যাতন সইছে, তাদের চাবুক মারা হয়, আগুনে পোড়ানো হয়, হাত কেটে ফেলা হয়, পাথর ছুড়ে হত্যা করা হয়, ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। আশির দশকে অগুনতি মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছিল। এখন আন্তর্জাতিক আদালতে সেই হত্যাকান্ডের বিচার চলছে।

গণতন্ত্র, মানবাধিকার, নারীর সমানাধিকার, বাকস্বাধীনতা এসব ধ্বংস করতে হলে যেটা সবচেয়ে বেশি দরকার সেটা হলো রাষ্ট্রকে নিরপেক্ষতা থেকে সরিয়ে এনে ধর্মে বিশ্বাসী করা, রাষ্ট্রকে বিশেষ কোনও ধর্মের অনুসারী বানানো। যে কোনও ধর্মই আজ অথবা কাল গণতন্ত্র, মানবাধিকার, নারীর সমানাধিকার, আর বাকস্বাধীনতার বিরুদ্ধে যাবে। সে কারণে যে দেশগুলো ধর্মনিরপেক্ষ নয়, সেসব দেশে এই সমস্যাগুলো প্রকট। অধিকাংশ মুসলিম দেশেই লক্ষ করছি সংবিধান সমানাধিকার আর মানবাধিকারের প্রতিশ্রুতি দিলেও ধর্মের নামে জনগণকে সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে, আর রাষ্ট্রনায়ক বা নায়িকারা সংখ্যাগরিষ্ঠ ধার্মিকের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার উদ্দেশে ধর্মকে প্রধান করে তুলছেন, ধর্মের আইনকে অন্য সব আইনের ওপরে স্থান দিচ্ছেন।

পৃথিবীতে যত ধর্মীয় রাষ্ট্র আছে, তার অধিকাংশই ইসলামি রাষ্ট্র। অমুসলিম দেশগুলো সাধারণত ধর্মনিরপেক্ষ। শুধু ইরানে নয়, সচেতন শিল্পী সাহিত্যিকরা আজ প্রায় সব মুসলিম রাষ্ট্রে মানবাধিকার বঞ্চিত। যাঁদের গায়ে কোনও আঁচড় লাগছে না, তাঁরা নিঃসন্দেহে আপোস করে চলছেন। জাফর পানাহি এবং অন্য চলচ্চিত্র নির্মাতাকে আজ নির্যাতন সইতে হচ্ছে ইরানে, এর কারণ তাঁরা দেশের অন্যায় আর অবিচারের বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ হচ্ছে, সেই প্রতিবাদকে সমর্থন করেছেন। বাংলাদেশে যে সংখ্যালঘু হিন্দুর বিরুদ্ধে নিরন্তর অন্যায় আর অবিচার চলছে, তার বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ করছে গুটিকয় সচেতন মানুষ, কোনও চলচ্চিত্র নির্মাতা বা কোনও শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী সেই প্রতিবাদে তাঁদের সমর্থন জানিয়েছেন? আমি যতদূর জানি, জানাননি। এত আপোসকামী বুদ্ধিজীবী আমার মনে হয় না অন্য কোনও দেশে আছেন। আফগানিস্তানেও আছেন প্রতিবাদী মানুষ। আসলে বাংলাদেশ আজ আফগানিস্তান হয়ে উঠবে, পরশু পাকিস্তান হয়ে উঠবে, তরশু শ্রীলংকা হয়ে উঠবে বলার দরকার নেই। বাংলাদেশ দিন দিন বাংলাদেশই হয়ে উঠছে। সত্যিকার বাংলাদেশ। একাত্তরে যে দেশ স্বাধীন হয়েছিল, সে দেশের নাম বাংলাদেশ ছিল বটে, সে দেশ ছিল ঝাঁক ঝাঁক তরুণের সাময়িক আবেগের সমুদ্রে সাঁতরানো একখন্ড দিকনিশানাহীন ভূমি। দেশের মানুষেরা দেশটিকে গড়ে তুলেছে গত পঞ্চাশ বছরে, এর আসল চেহারা ফুটে উঠেছে এতদিনে। ধর্মনিরপেক্ষতাকে এ দেশ থেকে সাততাড়াতাড়ি ছুট্টি দেওয়া হয়ে গেছে। মানুষ যা চায়, তা-ই পেয়েছে। মানুষ ইসলামী আইন চাইছে, ইসলামী পোশাক চাইছে, ইসলামী নিয়মনীতি চাইছে, মসজিদ মাদ্রাসা চাইছে, ওয়াজ চাইছে, চাইছে বলেই সহজেই সব পেয়েছে।

২. ভারতে নানা সমস্যা। হিন্দুত্ববাদীদের এখন পোয়াবারো, মুসলমানরা কোণঠাসা হয়ে আছে, এরকম শুনি। সত্যতা যে একেবারে নেই তা নয়। এইসবের মধ্যেই কিন্তু উদয়পুরের দুই মুসলমান লোক দিন দুপুরে এক হিন্দু দরজির দোকানে ঢুকে প্রকাশ্যে খুন করে এসেছে। ধরা যাক বাংলাদেশে কোনও হিন্দুর প্রচন্ড রাগ হলো মুসলমানের ওপর, কোনও হিন্দুই কিন্তু কোনও দোকানে ঢুকে কোনও মুসলমানকে খুন করে আসবে না। খুন তারাই করে, যারা পরোয়া করে না, অথবা গভীরভাবে বিশ্বাস করে ওপরওয়ালা তাদের অধিকার দিয়েছে খুন করার। ভারতের সমস্যা পরতে পরতে কিন্তু একটা জিনিস বেশ ভালো লাগে। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুর দেশ এটি, কিন্তু রাষ্ট্রপ্রধান মুসলিম, শিখ, নারী, দলিত, নাস্তিক, আদিবাসী-যে কেউ হতে পারেন। বিশ্বের অনেক উদার দেশও হয়তো এখনও এতটা উদার হতে পারেনি। ভারতের কাছ থেকে অন্তত এই উদারতাটুকু তো অন্যরা শিখতে পারে।

৩. আমার মনে হয় গত এক বা দুই দশকে বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর সবচেয়ে বেশি অত্যাচার হয়েছে। কোনও হিন্দুর ফেসবুক পোস্ট মুসলমানের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে, এই অভিযোগ করে হিন্দুদের বাড়িঘরে আগুন জ্বালানো, মন্দির ভেঙে ফেলা এখন হিন্দুবিদ্বেষী মুসলমানদের দৈনন্দিন কর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সময় যাঁর উচিত রুখে দাঁড়ানো, অনুভূতির রাজনীতি সমূলে ধ্বংস করা, সাম্প্রদায়িকতার কবর দিয়ে দেওয়া-তিনি নিরোর মতো বাঁশি বাজাচ্ছেন, নিজের গুণকীর্তন গাইছেন, পদ্মা সেতুর আনন্দে সদলবলে নৃত্য করছেন। নড়াইলে আবার মানুষের ঘর পুড়লো, সহায়সম্পদ পুড়লো, মন পুড়লো, প্রতিবেশীর ওপর বিশ্বাস পুড়লো, সরকারের ওপর আস্থা পুড়লো। পুড়ে ছাই হয়ে গেল।

মানুষগুলোর দোষ, মানুষগুলো মুসলমান নয়। আর কতকাল এই অন্যায় চলবে? প্রতিবাদ আর কতকাল করতে হবে? আর কতকাল মুসলমানরা এমন হিংস্র হয়ে উঠবে?, আর কতকাল সরকার চোখে ঠুলি পরে আর কানে তুলা গুঁজে বসে থাকবে? উত্তর আমরা কেউই জানি না।

৪. লখনউএর লুলু মলে তো চমৎকার ঘটনা ঘটে গেল। নতুন মল। কয়েকজন মুসলমান বলা নেই, কওয়া নেই সেই মলে নামাজ পড়তে শুরু করলো। কিছু মুসলমান তো সারা পৃথিবীকেই নিজের ব্যক্তিগত জায়নামাজ ভেবে বসে আছে, যেখানে সেখানে যখন খুশি নামাজের জন্য দাঁড়িয়ে যায়। মুসলমানের নামাজ পড়া দেখে কিছু হিন্দু এসে হনুমান চালিশা পাঠ করতে শুরু করলো। আর যায় কোথায়, পুলিশ এসে হনুমান চালিশা পাঠরত কয়েকজনকে ধরে নিয়ে গেল। এই নিয়ে হৈ চৈ। শেষ অবধি লুলু মলের কর্মকর্তারা নোটিশ টাঙিয়ে দিলেন, ‘এই মলে কোনও প্রকার ধর্মীয় প্রার্থনা চলিবে না।’

এরকম প্রতিটি মলে, মার্কেটে, মিউজিয়ামে, রাস্তায়, ঘাটে, স্কুলে, কলেজে, অফিসে, আদালতে, নৌকোয়, লঞ্চে, বাসে, ট্রেনে, জাহাজে, উড়োজাহাজে নোটিশ টাঙিয়ে দেওয়া হোক, ‘এইখানে ধর্মীয় প্রার্থনা নিষিদ্ধ। আইন ভাঙিলে ৫০০০ টাকা জরিমানা এবং ৫ মাসের জেল।’

 লেখক : নির্বাসিত লেখিকা। 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর