বৃহস্পতিবার, ২১ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

নতুন প্রজন্মকে জানতে হবে নাজিরপুর যুদ্ধের ইতিহাস

সাজ্জাদুল হাসান

নতুন প্রজন্মকে জানতে হবে নাজিরপুর যুদ্ধের ইতিহাস

সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের কবিতা দিয়েই শুরু করি- ‘আমি জন্মেছি বাংলায়/

আমি বাংলায় কথা বলি।/...

এসেছি বাঙালি রাষ্ট্রভাষার লাল রাজপথ থেকে/এসেছি বাঙালি

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর থেকে।

আমি যে এসেছি জয় বাংলার বজ্রকণ্ঠ থেকে/আমি যে এসেছি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে।’

এই হচ্ছে আমার পরিচয়। এ জনপদের মাটি ও মানুষের আত্মপরিচয়। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল বাঙালির আত্মপরিচয়ের সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা ঘোষণার মধ্য দিয়েই আত্মপরিচয়ের এ সংগ্রাম আত্ম-আবিষ্কার ও আত্ম-অধিকারের লড়াকু পথে ধাবিত হয়। স্বাধীনতা ও মানচিত্রের অধিকারে ‘তোমার আমার ঠিকানা/পদ্মা মেঘনা যমুনা’ এ সেøাগানে সমগ্র দেশের মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচন, ’৭১-এর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণই ছিল বাঙালির প্রত্যয়, প্রেরণা ও লড়াই করার শক্তি। ১৯৭১ সালে বাঙালি যোগ দিয়েছিল জীবনপণ সংগ্রামে। অনেকেই নিয়েছিল অনেক রকম ঝুঁকি। সেদিন সবারই লক্ষ্য ছিল চূড়ান্ত বিজয় না আসা পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা যে ফলপ্রসূ হয়েছিল, তা বলাই বাহুল্য। বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলের রয়েছে এ সমৃদ্ধ ইতিহাস। নতুন প্রজন্মের কথা ভেবে নেত্রকোনার মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো নিয়ে লেখার চেষ্টা করছি।

গত বছরের ২৭ জানুয়ারি নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলার লেঙ্গুরায় গিয়েছিলাম। এখানে পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে নিহত সাত বীর শহীদের সমাধিস্থল রয়েছে। লোকমুখে ‘সাত শহীদের মাজার’ হিসেবেই পরিচিত। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নতুন প্রজন্ম যেন সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারে এবং পূর্বপুরুষের গর্বগাথা চেতনায় ধারণ করে সেজন্য আমার ছেলেকেও সঙ্গে নিয়ে যাই। সেখান থেকে ফিরে এসে ঘটনার বর্ণনা করে দৈনিক জনকণ্ঠে একটি লেখা দিয়েছিলাম যা ২০২১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি প্রকাশ পায়। যেখানে পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে কীভাবে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল তা সবিস্তার বর্ণনা করেছিলাম। তাই আজ বিস্তারিত না লিখে পাঠকদের সুবিধার্থে যা না বললেই নয় তা সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরছি।

মূল ঘটনা হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালের ২৬ জুলাই কলমাকান্দার নাজিরপুরে পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে সাতজন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছিলেন। পরে তাঁদের লেঙ্গুরা ইউনিয়নের ফুলবাড়ী নামক স্থানে সমাহিত করা হয় যা সাত শহীদের মাজার নামে পরিচিত। সাত শহীদ হলেন- ডা. আবদুল আজিজ, (নেত্রকোনা), মোহাম্মদ ফজলুল হক (নেত্রকোনা), মোহাম্মদ রিয়াদ মাহমুদ (মুক্তাগাছা, ময়মনসিংহ), ভবতোষ চন্দ্র দাস (মুক্তাগাছা, ময়মনসিংহ), মো. নুরুজ্জামান (মুক্তাগাছা, ময়মনসিংহ), দ্বিজেন্দ্র চন্দ্র বিশ্বাস (মুক্তাগাছা, ময়মনসিংহ) ও মো. জামাল উদ্দিন (জামালপুর)। প্রত্যেকের সমাধি চিহ্নিত রয়েছে এবং পুরো জায়গাটি প্রাচীরঘেরা। বিভিন্ন গাছের সমারোহে শীতল ছায়ায় তাঁরা শায়িত। এ ছাড়া নাজিরপুর মোড়ে রয়েছে একটি স্মৃতিসৌধ।

আমার আজকের লেখার মূল উদ্দেশ্য বীর মুক্তিযোদ্ধা, যাঁরা যুদ্ধ করে আমাদের দেশ স্বাধীন করেছেন তাঁদের অবদান নতুন প্রজন্মের কাছে সঠিকভাবে তুলে ধরা। তাঁদের ত্যাগের বিনিময়েই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম। তাই তাঁদের বারবার স্মরণ করতেই হবে। পূর্বজনদের ইতিহাস জানা ও সংরক্ষণ করাই নতুন প্রজন্মের কাজ। আমাদের নতুন প্রজন্ম হয়তো আমাদের জিজ্ঞাসা করতে পারে- আমাদের কি তোমরা মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বের ইতিহাস সম্পর্কে জানিয়েছ?

প্রতি বছর ২৬ জুলাই নাজিরপুর দিবস পালন করা হয়। বরাবরের মতোই এ দিবসটি সামনে রেখে এ বছরও বীর মুক্তিযোদ্ধা, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল, বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, জেলা প্রশাসনসহ অনেকেই দিবসটি পালনের বিষয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমার একটা অনুরোধ থাকবে এই বীরত্বপূর্ণ, গৌরবগাথার স্থানগুলো ছাত্রছাত্রীদের যেন আরও বেশি করে দেখার সুযোগ তৈরি করা হয়। আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্দীপ্ত যে উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশের যে পথনকশা প্রণয়ন করেছেন তা কিন্তু ওদের হাত ধরেই এগোবে। আজকের শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ।

বীর মুক্তিযোদ্ধা যাঁদের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা, তাঁরাও একদিন পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবেন তাঁদের মশালটি কিন্তু এই নতুন প্রজন্ম বহন করবে। এই তো সেদিন ২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি যখন নাজিরপুরের লেঙ্গুরা সাত শহীদের মাজারে গিয়েছিলাম আমার সঙ্গে সাবেক উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম ভাই ছিলেন। তিনি আজ পৃথিবীতে নেই। এতগুলো কথা কেন শুরুতে একসঙ্গে বললাম নিশ্চয়ই অনেক পাঠক প্রশ্ন করতে পারেন। বলার কারণ হচ্ছে আমার একটি অভিজ্ঞতা। আরও একটু স্পষ্ট করেই বলি। নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ উপজেলার মোহনগঞ্জ পাইলট সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের আমি প্রাক্তন ছাত্র। মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে এ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী কেউ শহীদ হয়েছিলেন কি না তা জানার চেষ্টা করি। জানতে পারলাম তিনজন শহীদ হয়েছেন। জানার পর আমি সিদ্ধান্ত নিলাম- তাঁদের স্মৃতি ধরে রাখা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। যথাযথ উদ্যোগ নিলাম। এ চেতনা থেকেই সরকারি অর্থায়নে পাইলটি উচ্চবিদ্যালয় প্রাঙ্গণে তাঁদের স্মরণে কিছুদিনের মধ্যে স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করা হলো। তাঁদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কীভাবে শহীদ হলেন তার সংক্ষিপ্ত ঘটনা সংগ্রহ করলাম এবং যথারীতি শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. ফজলুর রহমান, শহীদ দবির উদ্দিন আহমেদ ও শহীদ আনোয়ার উল আলম চৌধুরী (কামাল)-এর সংক্ষিপ্ত জীবনবৃত্তান্ত শ্বেতপাথরে লেখা হলো।

নাজিরপুরের স্মৃতিসৌধ ও লেঙ্গুরার সমাধি : শহীদদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভের ফলক উন্মোচনে এবং এ বিষয়ে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হককে প্রধান অতিথি ও প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনকে প্রধান আলোচক হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। ২০১৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি মাননীয় মন্ত্রী স্মৃতিস্তম্ভের ফলক উন্মোচন করেন এবং আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ও প্রধান আলোচক উভয়েই উপস্থিত ছিলেন।

মনে একটা স্বস্তি পেলাম, যাক এই শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা সম্পর্কে বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকারা এবং অধ্যয়নরত ছাত্রছাত্রীরা দেরিতে হলেও নিশ্চয়ই তাদের সম্পর্কে আরও ভালো করে জানার সুযোগ পাবে এবং কৌতূহল বাড়বে। যেহেতু আমি বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র যখনই বাড়ি আসা-যাওয়ার পথে স্মৃতিকাতরতায় বিদ্যালয়ের ভিতরে একটু যাই, বিদ্যালয়টিতে কি উন্নয়নমূলক কাজ চলছে, ছাত্রছাত্রীরা ফলাফল কেমন করছে তা-ও জানার আগ্রহ থাকে। শিক্ষক বা ছাত্রদের সঙ্গে দেখা হলে তাদের সঙ্গে কথা বলি। এমনি এক দিনে সম্মানিত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কমনরুমে বসে তাঁদের সঙ্গে মতবিনিময় করছিলাম। আলোচনা প্রসঙ্গে স্বাধীনতাযুদ্ধে শহীদ এ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন তিনজন বীরের জন্য যে স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করা হয়েছে তাঁদের বীরত্বগাথা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য, অনেকেই কিছু বলতে পারেননি। অথচ সংক্ষিপ্তভাবে তাঁদের জীবনী স্মৃতিস্তম্ভে লেখা রয়েছে। অনেক ছাত্রছাত্রীকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম তাদের কাছ থেকেও ভালো উত্তর পাইনি। মনে খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। অবশ্য পরবর্তীতে জিজ্ঞাসা করা হলে তাদের বেশির ভাগই উত্তর দিতে সক্ষম হয়। ছাত্রছাত্রীদের অনুসন্ধিৎসু মন সৃষ্টি করার জন্য তো শিক্ষক-শিক্ষিকাদের এগিয়ে আসতে হবে।

এবার নাজিরপুরের মূল আলোচনায় আসি। নাজিরপুরের সাত শহীদের বীরগাথা নিয়ে এবারও প্রতিবারের মতো ঘটা করে কর্মসূচি পালন করা হবে। শ্রদ্ধাঞ্জলি দেওয়া হবে, আলোচনা সভা হবে। এটা অবশ্যই মন থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন। কিন্তু চেতনার এ দার্শনিক সত্যতা ও ইতিহাস যাতে বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ জাগ্রত থাকে তার জন্য নতুন প্রজন্মকে এ আয়োজনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা খুব জরুরি।

এখনো বীর মুক্তিযোদ্ধা যাঁরা বেঁচে আছেন, গ্রামে যাঁরা বয়স্ক আছেন তাঁদের স্মৃতিতে সেটা জ্বলজ্বল করে জ্বলছে কিন্তু তাঁরা তো চিরদিন থাকবেন না। আমি অনেক ছাত্রছাত্রীকে জিজ্ঞাসা করেছি, নতুন প্রজন্মের অনেক তরুণ-তরুণীকে জিজ্ঞাসা করেছি তারা এ বিষয়ে এতটা ওয়াকিবহাল নয়। সে ক্ষেত্রে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান যাতে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে নাজিরপুর স্মৃতিসৌধ ও লেঙ্গুরা সাত শহীদের মাজারে যান সে ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করা জরুরি। ইতিহাস জানা ও হৃদয়ে ধারণ করা দুটিই প্রয়োজন। তবে এটা সত্য, যাতায়াতের সুবিধা করে দেওয়া আমাদের দায়িত্ব। গতবার আমি যখন গিয়েছিলাম তখন চলাচলের সুবিধার্থে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতিসহ কিছু স্থাপনা নির্মাণ জরুরি মনে হলো। নেত্রকোনা থেকে শিধলি হয়ে নাজিরপুর বাজারের ভিতর দিয়ে লেঙ্গুরা পর্যন্ত রাস্তাটি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে দ্রুত সংস্কার প্রয়োজন। রাস্তা সমস্যা ছাড়াও দর্শনার্থীদের বিশ্রামাগার, টয়লেটের ব্যবস্থা, যাত্রীছাউনি নেই। সমাধিস্থলে আসার রাস্তাটিও জরাজীর্ণ। এবার তো ভয়াবহ বন্যায় অনেক ক্ষতি হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসসংবলিত এ স্থানটিতে দূরদূরান্ত থেকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে অনেকেই আসেন এবং ক্লান্তিবোধ করেন। এখানে সাময়িক যাত্রাবিরতির জন্য প্রয়োজনমাফিক সামান্য আহারের জন্য দু-একটি মানসম্মত ছোট ছোট রেস্টুরেন্ট বা রেস্ট হাউসের ব্যবস্থা থাকলে অনেক সুবিধা হতো। যাতায়াতটা এখনো খুবই কষ্টকর। অবশিষ্ট কী কী কাজ করা দরকার তা নির্ধারণ করে জেলা প্রশাসন নেত্রকোনা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে জরুরি ভিত্তিতে সংস্কারের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এ প্রত্যাশা রইল। এর মাধ্যমেই মুক্তিযুদ্ধের ১১ নম্বর সেক্টরের ইতিহাসসমৃদ্ধ, স্মৃতিবিজড়িত এ স্থানটি সারা দেশের মানুষের কাছে আরও পরিচিত হয়ে উঠবে। নতুন প্রজন্ম স্বাধীনতার ইতিহাসসংবলিত এ স্থানটিতে যেতে আরও আগ্রহী হবে। শহীদদের আত্মা শান্তি পাবে। পরিশেষে নাজিরপুরে সাত বীর মুক্তিযোদ্ধা যাঁরা শহীদ হয়েছেন তাঁদের আত্মার শান্তি কামনা করছি।

 

লেখক : চেয়ারম্যান, পরিচালনা পর্ষদ

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস।

সর্বশেষ খবর