১. বলিউডের অভিনেতা রণভীর সিং কিছুদিন আগে উলঙ্গ কিছু ছবি তুলেছেন একটি ম্যাগাজিনের জন্য। সেইসব ছবি সোশ্যাল মিডিয়াতে ছড়িয়ে গেছে। ছবিগুলো তাঁর স্ত্রী দীপিকা পাড়ুকোনের উপস্থিতিতেই তোলা হয়েছে। দীপিকার বেশ ভালো লেগেছে ছবিগুলো। রণভীর সিং-এর ব্যায়াম করা শরীর। আজকাল সিক্স প্যাকের কদর বেশ। যদি সিক্স প্যাক না থাকতো তাঁর, তাহলে কি তিনি ফটোশ্যুটটা করতেন? করতেন না। পৃথিরাজ কাপুর, রাজকাপুর, রণধীর কাপুর, শশীকাপুর, ঋষি কাপুর-কোনও কাপুরই তাঁদের স্থূল শরীর নিয়ে উলঙ্গ হয়ে ফটোশ্যুট করতেন না। কিন্তু তাঁদেরই বংশধর রণভীর কাপুরই ছবিতে সম্পূর্ণ না হলেও অনেকটাই উলঙ্গ হয়েছেন। হয়েছেন কারণ তাঁরও ব্যায়াম করা শরীর, তাঁরও সিক্স প্যাক। একসময় পত্রপত্রিকা মেয়েদের উলঙ্গ ছবি পাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকতো। সেই দিন এখনও চলে যায়নি। যে দিনটি ছিল না এই উপমহাদেশে, সেটি হলো পুরুষের সুঠাম শরীরের ছবির জন্য ক্রেজ। এটি একদিক থেকে ভালো। নারীর শরীর দেখে পুরুষ যেমন পুলকিত হয়, পুরুষের শরীর দেখেও নারী পুলকিত হয়। পুলকিত হওয়া, উত্তেজিত হওয়া, আনন্দ পাওয়া, সুখ পাওয়ার অধিকার শুধু পুরুষের নয়, নারীরও আছে। পুরুষের উলঙ্গ শরীরের ছবি ছাপিয়ে ম্যাগাজিন যে বের হয় না, তা নয়, হয়, তবে সেসব সমকামী পুরুষদের যৌন-আনন্দের জন্য। আজকাল হাতে হাতে মুঠোফোন। এক ক্লিক দূরত্বে পর্নো। নারী-পুরুষের পর্নোগ্রাফিও নিতান্তই পুরুষের যৌন-আনন্দের জন্য। সেসবে নারীকেই দেখা যায় পুরুষ যেভাবে আনন্দ চায়, সেভাবে পুরুষকে আনন্দ দিতে। নারীকে শারীরিক যন্ত্রণা দিয়ে পুরুষ আনন্দ পায়, সুতরাং শারীরিক যন্ত্রণা পেতে পেতে নারীর যখন নো নো বলার কথা, তখন ইয়েস ইয়েস বলে। কারণ পর্নোগ্রাফির পরিচালক বলে দিয়েছেন, নো নো না বলে ইয়েস ইয়েস বলতে। এই ইয়েস ইয়েস পুরুষকে দ্বিগুণ উত্তেজিত করে। নারীর যৌন-আনন্দকে তো পুরুষশাসিত সমাজ স্বীকার করে না। সমাজের লোকেরা মনে করে যৌন-আনন্দ মন্দ মেয়েদের দরকার হলেও হতে পারে, ভালো মেয়েদের দরকার হয় না। ভালো মেয়েরা সন্তান উৎপাদনের জন্য স্বামী সহবাস করে, সন্তান জন্ম নেওয়ার পর তাদের প্রধান কাজ, সন্তানকে লালন পালন করা। এসব নতুন কোনও তথ্য নয়, এই তথ্য সকলের জানা।
আমাদের এও জানা আজ যারা রণভীর সিং-এর সম্পূর্ণ উলঙ্গ শরীর দেখে যারা ব্রাভো বলে লাফালো, তারাই আলিয়া ভাট বা ক্যাট্রিনা কাইফ বা কারিনা কাপুর বা ঐশ্বর্য রাই-এর সম্পূর্ণ উলঙ্গ ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়লে চুক চুক করে দুঃখ করবে। বলবে, কী করে তাদের স্বামী রণভীর কাপুর বা ভিকি কৌশাল বা সইফ আলি খান বা অভিষেক বচ্চন এই কাজটি করতে স্ত্রীদের ‘এলাও’ করলেন। কোনও স্বামী কি দীপিকার মতো বলবেন যে, ওঁদের উলঙ্গ ছবি আমার কাছে দারুণ লেগেছে। আলিয়া ভাট, ক্যাট্রিনা কাইফ, কারিনা কাপুর, ঐশ্বর্য রাই-কারও শরীরই স্থূল নয়। তাহলে রণভীর সিং যা পারেন, তা তাঁর সহনায়িকারা পারেন না কেন? কোথায় সমস্যা?
সমস্যা কোথায়, সে আমরা সকলেই জানি।২. বোল্ড শব্দটা এ দেশে দেখলাম কিছুটা স্তন দেখা যাওয়া মেয়েদের বেলায় ব্যবহার করা হয়। অবশ্য সেই মেয়েদের সিনেমা থিয়েটার মিউজিক ইত্যাদির অর্থাৎ শোবিজের মেয়ে হতে হবে, অথবা ফ্যাশন সচেতন উচ্চবিত্ত বা উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণির মেয়ে হতে হবে। হ্যাঁ মেয়ে হতে হবে, ছেলে হলে হবে না। শার্ট খুলে সিক্স প্যাক দেখালেও হবে না। অবশ্য সব মেয়ের শরীর দেখা গেলেই বোল্ড বলা হয় না। রাস্তার দরিদ্র ভিখিরি মেয়েদের হাড্ডিসার শরীর উন্মুক্ত হয়ে থাকলে কেউ তাকে বোল্ড বলবে না।
বোল্ড শব্দটার মিসইউজ দেখলে খারাপ লাগে। স্তন দেখাতে সাহস লাগে নাকি? যত তার স্তন দেখা যাবে, তত তার শোবিজের বাজার রমরমা হবে। এতে সাহসের চেয়ে বেশি আছে বাণিজ্য-কৌশল।
বোল্ড তো আসলে তাদের কাজ যারা সত্যিকার সাহসী। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যারা এমন কাজ করে, যে কাজ করলে মু-ুটা কাটা পড়বে, অথবা জীবনযাপনে বিস্তর সমস্যা হবে। আমি কাদের কাজকে বোল্ড বলি, তার দু-একটা উদাহরণ দিচ্ছি। যারা ভিন্ন ধর্মের, ভিন্ন বর্ণের, ভিন্ন জাতের কাউকে ভালোবেসে বিয়ে করে এবং সমাজের বাধা সত্ত্বেও নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থাকে; যে সমকামীরা, রূপান্তরকামীরা ঘোষণা দিয়ে ক্লোজেট থেকে বেরিয়ে আসে; যে মেয়েরা স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে একা থাকে; যারা ধর্মান্ধ কট্টরপন্থি আর উগ্রবাদী সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে একা যুদ্ধ করে; স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়; ...।
দুঃখ এই, তাঁদের কাজকে আমাদের আঁতেল এবং মিডিয়া গোষ্ঠী বোল্ড বলার বদলে বলে ‘বিতর্কিত’।
৩. আমি কাঁদলে লোকে বলে, কাঁদা নাকি আমাকে মানায় না। কেন মানায় না? আমি স্ট্রং, তাই। স্ট্রং হলে দুঃখে কষ্টে কাঁদতে নেই, এই ধারণা থেকেই মানুষ পুরুষলোক কাঁদছে এই দৃশ্য দেখতে চায় না। বলে ‘ছিঃ ছিঃ, পুরুষ হয়ে মেয়েদের মতো কাঁদছে কেন!’ স্ট্রং মেয়েরা, জীবনে যা কিছুই ঘটুক, কাঁদবে না। কাঁদলে তাকে আর স্ট্রং মনে হয় না। আর পুরুষ মাত্রই, যেহেতু বিশ্বাস করা হয়, সবাই স্ট্রং। তাই কোনও পুরুষ কাঁদলে তাকে আর ‘পুরুষ’ বলে মনে হয় না। কাঁদাটা কাদের জন্য? নরম কোমল সেন্সিটিভ মেয়েদের জন্য।
দুঃখে কষ্টে যন্ত্রণায় বেদনায় কোমল এবং কঠিন মানুষ কাঁদে, লিঙ্গ নির্বিশেষে কাঁদে, কাঁদাটা স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের সমাজে ছোটবেলা থেকেই ছেলেরা না কাঁদতে শেখে। বাবা মারা শেখায়। ছেলে হয়ে জন্ম নিলে নাকি কাঁদতে হয় না।
যারা কাঁদে না, তাদের আমার খুব ভয়ংকর মানুষ বলে মনে হয়। আবেগ কি পুরুষের নেই? নিশ্চয়ই আছে। যে আবেগ থেকে রাগ ঘৃণা প্রতিশোধস্পৃহা, হাসি খুশি আনন্দ ইত্যাদি উৎকটভাবে প্রকাশিত হয়, সে আবেগ থেকেই তো মানবিক ক্রন্দন উঠে আসার কথা।
অন্যের জন্য কাঁদার মতো সুন্দর কী আছে জগতে! পরিচিতদের অনেকেই দেখলাম কাঁদার বিরুদ্ধে। আমার মা যখন মারা গেল, লক্ষ্য করলাম, যারা মা’কে হারিয়ে চিৎকার করে কাঁদছিল, তাদের থামিয়ে দেওয়া হলো। তাদের ভাষ্য, ‘আল্লাহর বান্দাকে আল্লাহ দুনিয়াতে পাঠিয়েছিলেন, আল্লাহ এখন নিয়ে যাচ্ছেন। শব্দ করে কাঁদলে আল্লাহ নারাজ হবেন, যদি নিতান্তই কাঁদতে হয়, নীরবে কিছুটা চোখের জল ফেলো, ব্যস।’
ধর্মের নামে, পুরুষতন্ত্রের নামে, মানুষের ভালোবাসা আর আবেগের মতো গুণগুলোকে বিদেয় করার চেষ্টা চলছে, মানুষকে পাথর বানাবার চেষ্টা চলছে। যে যত পাথর সে তত পুরুষ সে তত স্ট্রং! যুক্তিবাদীদের কাঁদতে নেই কে বললো! আবেগে কাঁদার পর মানুষের ব্যথা বেদনা কম হয়, টেনশন কমে, মন ভালো হয়, চোখের স্বাস্থ্যও ভালো থাকে। যুক্তিবাদীরা এই বেনেফিটটা বোকার মতো হারাবে কেন?
আমি যখন মা’কে নিয়ে আমার ‘নেই কিছু নেই’ বইটি লিখছিলাম, লেখার সময় আমি প্রতিদিন মা’র জন্য কাঁদতাম, মা’র না থাকার কষ্টে কাঁদতাম। বইটি লেখার পর আমার কী যে ভালো লেগেছে তা বোঝাতে পারবো না। কান্না আমাকে সেই ভালো লাগা, সেই প্রশান্তি দিয়েছে।
৪. তাইওয়ানের একটি স্কুলে ছেলেদের এবং মেয়েদের জন্য যে পোশাক নির্ধারিত, তার বাইরেও তারা যেতে পারে, এমন একটি জেন্ডার নিউট্রাল ইউনিফর্ম প্ল্যান করা হয়েছে। ছেলেদের ইউনিফর্ম ট্রাউজার আর শার্ট, মেয়েদের ইউনিফর্ম স্কার্ট আর শার্ট। কিছু ছেলে স্কার্ট পরতে চায়। ওদের আগ্রহ দেখে স্কুলটিতে নতুন নিয়ম আসছে, যার যে ইউনিফর্ম পরতে ইচ্ছে, সে সেটা পরতে পারবে। মেয়েরা চাইলে ছেলেদের ট্রাউজার পরতে পারবে, ছেলেরা চাইলে মেয়েদের স্কার্ট পরতে পারবে। মেয়েরা তো ট্রাউজার পরেই, তাতে কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। কিন্তু অনেক ছেলেই দিব্যি স্কার্ট পরতে শুরু করেছে। আমি ওদের ছবি টুইটারে দিয়েছি। ও মা। কী ছি ছি শুরু হয়ে গেল। বমি করে দিচ্ছে কেউ কেউ। কেন, ছেলেরা স্কার্ট পরবে কেন? স্কার্ট তো মেয়েদের পোশাক। তাই বুঝি? ইতিহাস বলে, আবহমান কাল ধরে ছেলেরা স্কার্ট পরছে। প্রাচীন মিসর বা প্রাচীন গ্রিসের লোকেরা কী পরতো? স্কার্ট। স্কটল্যান্ডের পুরুষদের জাতীয় পোশাক হলো কিল্ট। ওটাও স্কার্ট। আলবেনিয়াতেও পুরুষেরা স্কার্ট পরতো। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার লোকেরা স্কার্ট পরছে। ধুতি, লুঙ্গি, সারং। এসব তো স্কার্টই। শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, বার্মা, থাইল্যান্ড, মালদ্বীপ, ভারত-এসব দেশেও পুরুষেরা স্কার্ট পরে। কেরালা আর তামিল নাড়ুতে লম্বা স্কার্টগুলো ভাঁজ করে যখন পুরুষরা পরে, রীতিমতো মিনিস্কার্ট। ওদের স্কার্টের নাম মুন্ডু। ওদিকে আফ্রিকায় পুরুষের স্কার্টের নাম কাঙ্গা, চিতেঞ্জে, কিকয়, লাপ্পা। মাদাগাস্কারে পুরুষদের স্কার্টের নাম লাম্বা, সামোয়য় নাম লাভালাভা, ফিজিতে ভাকাতাগা, জাপানে হাকামা, ভুটানে ঘো। প্রাচীন চীনে পুরুষেরা যে স্কার্ট পরতো, তার নাম ছিল চাং।
তাহলে কেন আমাদের উপমহাদেশের লোকেরা স্কুলের ছেলেদের স্কার্ট পরা মেনে নিতে পারে না? তবে কী এই কারণ যে স্কুলের ছেলেরা যদি স্কার্ট পরে, সেই স্কার্ট আর ছেলেদের পোশাক নয়, সেটা মেয়েদের পোশাক, সে কারণেই ছিঃ ছিঃ। কেরালার রাস্তায় যদি কোনও মেয়ে মুন্ডু পরে হাঁটে বা মুন্ডু ভাঁজ করে পরে হাঁটে, তাকে কী রকম অপদস্থ হতে হবে, ভাবা যায়? পুরুষেরা স্কার্ট পরে ঠিকই, তবে সেটা যেন মেয়েদের স্কার্ট না হয়। আর মেয়েরা স্কার্ট পরুক, পুরুষের স্কার্ট যেন না পরে। কোনটা পুরুষের স্কার্ট, কোনটা মেয়েদের স্কার্ট-এটা পুরুষেরা নিজেদের মতো করে বুঝে নিয়েছে। মেয়েরা পুরুষের পোশাক পরলে জাত যায় না। কিন্তু পুরুষেরা মেয়েদের পোশাক পরলে শুধু জাত নয়, অনেক কিছুই যায়। মানসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকাই দুরূহ হয়ে ওঠে। মেয়েরা সমাজে নীচু শ্রেণির। তাই তার পোশাক পরা মানে, অনেকের মতে, নীচুতে নেমে যাওয়া। ছেলেরা আর যেখানেই নামুক, মেয়েদের লেভেলে নামতে চায় না।
পৃথিবীর সব স্কুলের ইউনিফর্ম এরকম জেন্ডার নিউট্রাল করে দিলে চমৎকার হয়। প্রথম প্রথম ছেলেদের স্কার্ট নিয়ে লোকের অস্বস্তি হবে, ধীরে ধীরে ও সয়ে যাবে। আমি বুঝি না, ছেলেরা শাড়ি পরে না কেন, শাড়ি এত সুন্দর পোশাক!
৫. ভারতের রাষ্ট্রপ্রধান দ্রৌপদী মুরমু একজন আদিবাসী নারী। নিশ্চয়ই এ খবর পেয়ে নারীরা, বিশেষ করে যারা নারী পুরুষের সমতায় বিশ্বাস করে, প্রচ- খুশি। রাষ্ট্রপ্রধানের শাসনক্ষমতা না থাকলেও অনেক নারীই ভারতের বা উপমহাদেশের বিভিন্ন রাজ্য বা দেশ শাসন করেছেন। এখন দুই বাংলা শাসন করছেন নারী। দুই নারীর শাসনামলেই দুর্নীতি খুব বেশি হচ্ছে, পুরুষের শাসনামলে যত দুর্নীতি হয়, তার চেয়ে কিছু কম নয়, বরং বেশিই। এই তো কিছুদিন আগে পশ্চিমবাংলার খ্যাতনামা মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে ২১ কোটি টাকা পাওয়া গেল। ধারণা করা হচ্ছে, শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালীন তিনি যাদের চাকরি দিয়েছেন, তাদের কাছ থেকে ঘুষ নিয়েছেন। কেউ কেউ মজা করে বলছিল “মহাভারত পাল্টে যাচ্ছে, হিসাব কী আর মেলে? দ্রৌপদী আজ রাষ্ট্রপ্রধান, পার্থ (অর্জুন) এখন জেলে।” ঘুষ যে নারীরা একেবারেই নিতে পারে না, তা কিন্তু নয়। আসলে, নারী-পুরুষ দুজনই সমান। তারা যেমন ভালো, তেমন খারাপ। পুরুষ হিংস্র হতে পারে, বর্বর হতে পারে, সুযোগ পেলে নারীও হিংস্র আর বর্বর হতে পারে।
লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।