শিরোনাম
বুধবার, ৩ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা

সংকটের জন্য ক্ষমতাধররা দায়ী

খায়রুল কবীর খোকন

সংকটের জন্য ক্ষমতাধররা দায়ী

ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থ ব্যবস্থাপনায় বেশ অভিজ্ঞ এবং একজন বিশিষ্ট হিসাববিদ আমাদের অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল নিজের যোগ্যতায় সফল ব্যবসায়ী। তাই অর্থ-বিত্তবান, সেটা দেশবাসী প্রায় সবারই জানা। তাঁর কাছে তাই দেশবাসীর প্রত্যাশা একটু বেশিই বলতে হবে। ২০ জুলাই তিনি একটি সংবাদ সংস্থার (বিডিনিউজ২৪) সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন : ‘যদি প্রয়োজন হয় আমরা (ঋণ) নেব। কিন্তু এ মুহূর্তে আমাদের প্রয়োজন নেই’। প্রায় এক দশক বাদে বাংলাদেশ বাজেট সহায়তার জন্য ইন্টারন্যাশনাল মনিটরি ফান্ড (আইএমএফ)-এর ঋণের জন্য ওই বিশ্ব সংস্থার দ্বারস্থ হচ্ছে বলে সংবাদ প্রকাশিত হলে অর্থমন্ত্রী এ রকম প্রশ্নের সামনে পড়েছিলেন। অর্থমন্ত্রী কিন্তু তাঁর চার দিনের মধ্যেই আইএমএফের কাছ থেকে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ চেয়ে বিশ্ব সংস্থাটির কাছে চিঠি দেওয়ার কথা স্বীকার করতে বাধ্য হন। তাতেই প্রমাণ হয়, বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী মোটেই দেশের অর্থনীতির সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে ওয়াকিবহাল নন। এরই মধ্যে পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সি (জাইকা)-এর কাছে বাংলাদেশের অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঋণের অনুরোধ জানানোর পরিপ্রেক্ষিতে সংস্থাটি বাজেট-সহায়তা হিসেবে ৫০ কোটি মার্কিন ডলার দিতে রাজি হয়েছে। এর ওপরে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি)-এর কাছে ১০০ কোটি ডলার ও বিশ্বব্যাংক থেকে ৭০ কোটি ডলার ঋণ চাওয়ার প্রস্তাব রয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনায়। রাষ্ট্রের এমন অর্থ-সংকট পরিস্থিতি দরজায় করাঘাত করার মুহূর্তেও সবকিছুই দেরি করে করা হচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস পেয়েছে। ইতোমধ্যে খোলাবাজারে প্রতি মার্কিন ডলার ১১২ টাকায় উঠে গেছে। তাতে প্রমাণিত, বাজারে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়তেই থাকবে এবং দেশের নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও দরিদ্র মানুষ যাদের মোট সংখ্যা প্রায় ১৫ কোটি, তাদের জীবনযাপন আরও দুর্বিষহ হয়ে পড়বে। সাকল্যে ৩ কোটির মতো মানুষ এ দেশে আছেন- এসব বাজারমূল্য বৃদ্ধি সামাল দিয়ে সহজ-স্বাভাবিক জীবনযাপনে বাধাহীন থাকতে সক্ষম হবেন। তারাই এ সমাজের সুবিধাভোগী, তাদের প্রায় ৯০ শতাংশ রাজনৈতিক ক্ষমতাধর গোষ্ঠীর দুর্নীতির লুটপাটের অর্জিত অর্থের উচ্ছিষ্টভোজী, ঘুষখোর রাজনীতিক আর আমলাগোষ্ঠীর সদস্য তাদের বেশির ভাগ। তারা সবাই উন্নয়ন কাজের ব্যয়-তৎপরতার দুর্র্নীতির অর্থের ভাগীদার। ১৮ কোটি জনসংখ্যার বাকি ১৫ কোটির জীবন তো মরণদশায় পতিত। মনে রাখতে হবে, দেশের জনসংখ্যা এখন কোনো অবস্থাতেই ১৮ কোটির নিচে নয়, জনশুমারির লোকজন অদক্ষতা ও ফাঁকিবাজির শুমারি করেছে আর সরকার ইচ্ছা করেই মাথাপিছু বার্ষিক আয় (জিডিপি) বেশি প্রমাণ করার অপচেষ্টায় এ অপকর্মে সায় দিয়েছে। (বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যথার্থই সে অভিযোগ করেছেন)। এবারের জনশুমারিতে অন্তত দেড় কোটি লোক বাদ পড়ে গেছে সেটা জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞদের অভিমত থেকে সুস্পষ্ট। শীতকালে জনশুমারি না করে বর্ষাকলে এমনকি বন্যা পরিস্থিতিতে এ শুমারি করাটাই সরকারের মতলববাজির প্রমাণ দেয়। অথচ সবারই জানা, দেশের জনসংখ্যার সঠিক চিত্র না পাওয়া গেলে কোনো অর্থনৈতিক পরিকল্পনাই সফল হতে পারে না। বর্তমান সরকারের সব মিথ্যাচার ও অসাধু তৎপরতার লক্ষ্য একটাই- দেশ ও দেশবাসীকে ‘ভুয়া-উন্নয়নের জোয়ারে ভাসানো।’ এ পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস তান্ডব এবং তারপর রাশিয়ার ইউক্রেনে যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়ার ইবলিশপনায় সারা দুনিয়ার বেশির ভাগ রাষ্ট্রের অর্থনীতি পর্যদুস্ত হয়ে পড়ছে। তার প্রচ- প্রভাব বাংলাদেশে পড়তে পারে তা বুঝতে আমাদের অভিজ্ঞ-ব্যবসায়ী অর্থমন্ত্রীর এত সময় লাগছে কেন? দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির জন্য দায়ী কালোবাজারি সিন্ডিকেট, তাকে সামাল দেওয়ার সফল উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। সাধারণ মানুষ অবধি সবারই জানা গ্রামের কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের দাম পায় না, অথচ গ্রামের উৎপাদকের দামের ২-৩ গুণ দামে কৃষিপণ্য কিনতে হয় রাজধানী ও বড় শহর-নগরের লোকজনের। আর আমদানিকৃত পণ্যগুলোর যেমন ভোজ্য তেল, চিনি, আটা, ময়দা ইত্যাদির কালোবাজারির সক্রিয় সিন্ডিকেট তৎপরতা তো ওপেন সিক্রেট। কালোবাজারি প্রতিরোধে যেসব আইন রয়েছে তা কার্যকর হয় না যথাযথভাবে, কারণটা কী? সেটা সবারই জানা, একদিকে কৃষিপণ্য গ্রাম থেকে নগর ও শহরগুলোয় আনার পথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও অন্যসব ক্ষমতা-উচ্ছিষ্টভোজী গোষ্ঠীর চাঁদাবাজি আর রাজনৈতিক ক্ষমতাধরদের সহযোগিতায় বড় আমদানিকারক কোম্পানিগুলোর মালিকদের অসাধু মুনাফাখোরি।

২৬ জুলাই ঋণ-জালিয়াতি সংক্রান্ত একটি মামলায় হাই কোর্ট মন্তব্য করেছেন, ‘সবচেয়ে সাংঘাতিক ক্রাইম হচ্ছে ব্যাংকে। ব্যাংক খাতে বড় বড় অপরাধ হচ্ছে। দেশটাকে পঙ্গু করে দিচ্ছে। এভাবে চললে দেশ এগোবে কীভাবে?’ বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্ট বেঞ্চ এ অভিমত দেন। ঋণ-জালিয়াতি সংক্রান্ত এ মামলায় ইসলামী ব্যাংকের চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ শাখার চার কর্মকর্তার উপস্থিতিতে এ মামলার শুনানিকালে হাই কোর্ট বলেন, ‘আপনাদের ভিতরে (জেলে) পাঠাতাম, টাকার পরিমাণ কম হওয়ায় আত্মসমর্পণের (নিম্ন-আদালতে) সুযোগ দেওয়া হচ্ছে।’ এর আগেও ব্যাংক-খাতের নৈরাজ্য নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে সতর্কবার্তা উচ্চারিত হয়েছে, কিন্তু ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর মধ্যে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ সোয়া লাখ কোটি ছাড়িয়েছে বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। এর আগে হলমার্কসহ অন্যান্য অর্থ লুটপাট ঘটনায় কোনো বিচারকাজ সম্পন্ন হয়নি। দুর্নীতির চক্রান্তে একাধিক বেসরকারি ব্যাংকের মালিকানা পরিবর্তিত হয়েছে যা অর্থ খাতের ভয়ানক অপরাধ। কিন্তু সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয় নির্বিকার, তারা দেশের অর্থনীতির মেরুদন্ড ভেঙে দিচ্ছে; সেসব কি অভিজ্ঞ অর্থবিত্তবান ব্যবসায়ী অর্থমন্ত্রীর অজানা?

ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলটির একটানা সরকার পরিচালনার সাড়ে ১৩ বছরের গণতন্ত্রহীন দশায় বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন ধস নামার মারাত্মক হুমকির মুখে। অন্তত ৭ লাখ কোটি টাকার অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসী প্রকল্প নিয়ে মাতামাতিতে দেশের অর্থনীতির আসল উন্নয়ন ভয়ানক ব্যাহত হয়েছে। এবং অতি-প্রয়োজনীয় প্রকল্পগুলোর প্রতি অপরিসীম অবজ্ঞা প্রদর্শনের ফলে ভিতরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসমূহের পর্যাপ্ত উৎপাদন মারাত্মক পর্যুদস্ত হয়েছে। আর অর্থনীতির লুটেরাদের সঠিক নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর চাটুকার-মোসাহেব-উচ্ছিষ্টভোজী পোষণ ইবলিশপনায় গণমানুষের অর্থসম্পদ মুষ্টিমেয় ৪ শতাংশের কাছে আরও বেশি হারে জমা হচ্ছে, আর ১৫ কোটি মানুষ ক্রমে ‘দরিদ্র এবং আরও বেশি দরিদ্র’ হচ্ছে। তাই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য এখন গণমানুষের ১৫ কোটি জনসংখ্যার কাছে সহনক্ষমতার চেয়ে অনেক দুর্বহ, বেশি কঠিন-দশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে সবার জীবনযাপন। সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য কয়েকদিন আগে এক বিশেষ আলোচনায় বলেছেন, ২০টি মেগা প্রকল্পসহ বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় বা কম জরুরি প্রকল্পে বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক ঋণ রয়েছে যা পরিশোধ করতে অচিরেই বাংলাদেশ বিপদে পড়তে পারে। তিনি বলেছেন, এখনো বিষয়টা অত কঠিন হয়ে পড়েনি, তবে অচিরেই সংকট তৈরি হতে পারে এমন আশঙ্কা অমূলক নয়। আমরা মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করতে চাই- বর্তমান সরকারের অপরিণামদর্শী কর্মকান্ডের জন্য বাংলাদেশ যেন অচিরেই শ্রীলঙ্কা পরিস্থিতি দাওয়াত করে না আনে। সেই সতর্কতা কোথায়?

লেখক : বিএনপির যুগ্মমহাসচিব, সাবেক সংসদ সদস্য ও ডাকসু সাধারণ সম্পাদক।

সর্বশেষ খবর