আগস্টে যাঁর কথা বারবার মনে পড়ে তিনি আমার এবং আরও অনেকের বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের পরম বন্ধু শেখ কামাল। আগস্টেই তাঁর জন্ম ও মৃত্যু। ১৯৪৯ সালের ৫ আগস্ট তাঁর জন্ম; ঘাতকের বুলেটে তিনি শহীদ হন ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট। বন্ধুবৎসল, নিরহংকার, পরোপকারী, স্পষ্টবাদী ও প্রাণবন্ত মানুষ ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠপুত্র শেখ কামাল। তাঁর সঙ্গে যে আমার সখ্য নিবিড় হয়ে উঠবে তা কখনো ভাবিনি। তাঁকে কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। তাই নির্দ্বিধায় বলি, কামাল আমাদের নিষ্কলুষ এক বন্ধু, যাঁকে নিয়ে গর্ব করা যায়।
আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হই ১৯৭৩ সালে। একই বিভাগে পড়তেন শেখ কামাল। শেখ কামাল কিছু বন্ধুকে নিয়ে একাট্টা হয়ে ক্লাসে খুব উচ্ছল থাকতেন। রসিকতা আর খুনসুটিতে তাঁরা সবাইকে মাতিয়ে রাখতেন। তাঁদের এ স্বভাব উচ্ছলতায় মুগ্ধ হই। কারণ আমার প্রকৃতিও ও রকমই। বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন আমাদের সহপাঠী ছিলেন। তিনিও ছিলেন উচ্ছল প্রকৃতির। আরেক সহপাঠী সৈয়দ মোফাজ্ঝেল মওলা, যিনি পেশাজীবনে সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদে উন্নীত হয়েছিলেন। ভালো ফুটবল খেলতেন। মওলা ও আমি ছিলাম সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের আবাসিক ছাত্র।
বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন আন্তবিভাগ ফুটবল প্রতিযোগিতা হতো। ১৯৭৩ সালে এ রকম খেলার মৌসুমে আমাদের বিভাগের নোটিস বোর্ডে দেখি ফুটবল খেলতে আগ্রহী ছাত্রদের নাম জমা দিতে বলা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠে খেলোয়াড় বাছাই করা হবে। এজন্য খেলার মাঠে দুই দিন উপস্থিত থাকতে বলা হয়। আমি বাছাই প্রতিযোগিতায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হই। ফুটবল দলের অধিনায়ক ছিলেন কাদের ভাই (পুরো নাম মনে পড়ছে না)। শুনলাম, আমাদের সমাজবিজ্ঞান আগে কখনো অর্থনীতি বিভাগের সঙ্গে জিততে পারেনি। তাই ফুটবলার হিসেবে আমরা যারা নির্বাচিত হয়েছি, তারা খেলায় নিজের সেরাটা দেওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকি। খেলার দিন আমি, সহপাঠী মওলা ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের আমার বাল্যবন্ধু আলাউদ্দিন আলা মাঠে হাজির হলাম। খেলা আনুষ্ঠানিকভাবে শুরুর আগে আমি ও মওলা অনুশীলন করছি; শেখ কামাল মাঠে এলেন। আমাদের বললেন, তোমরা মাঠের বাইরে যাও। আমরা মাঠের বাইরে গেলাম। আমাদের মন খারাপ। তখনো অধিনায়ক আসেননি। অধিনায়ক এলে কামাল বললেন, ‘তুই এটা কী করলি! মফস্বলের ছেলেদের সিলেক্ট করলি! এরা কি পারবে?’ অধিনায়ক বললেন, ‘ওটা আমার ওপর ছেড়ে দে। আমি অধিনায়ক। আমি ওদের অনেক বাজিয়ে দেখেশুনে সিলেক্ট করেছি।’ শেখ কামাল অভিমানাহত কণ্ঠে বললেন, ‘কর তোর যা ইচ্ছা কর। হারলে কিন্তু দায়দায়িত্ব তোর।’কামাল এরপর মাঠের বাইরে বসে থাকা আমাদের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, ওরা তো ওখানে বসে আছে। অধিনায়ক ছুটে এসে আমাদের বললেন, ‘ভাই, ভুল হয়ে গেছে।’ আমাকে নিয়ে কামালের কৌতূহল শেষ হয় না । আমার সম্পর্কে তথ্যাদি সংগ্রহ করে একদিন তিনি আমাকেই শুনিয়ে দিলেন।
ঝিনাইদহ শহরে আমাদের বাড়ির সামনে খুব বড় একটা খেলার মাঠ ছিল, ফলে আমরা ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলায় খুব উৎসাহী ছিলাম। আমার মেজো চাচা, ছোট চাচা ও ছোট দুই ভাই খুব ভালো ফুটবল খেলতেন। আমি ইন্টার স্কুল ফুটবল প্রতিযোগিতায় পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পর্যায়ে খেলেছি। কলেজে ফুটবল, ক্রিকেট ও হকিতে পারদর্শী ছিলাম। আমি আমার কলেজের ‘ব্লু’ ছিলাম (যারা লেখাপড়ার সঙ্গে খেলাধুলায় দক্ষ তখন তাদের ‘ব্লু’ সম্মান দেওয়া হতো)। আমি সাধারণত সেন্টার ফরোয়ার্ড বা স্ট্রাইকার পজিশনে খেলি। শেখ কামাল গভীর মনোযোগে আমার বল গ্রহণ, কিক করা আর ছোটার গতি পর্যবেক্ষণ করছিলেন। ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যেই দলের স্ট্রাইকার আমি গোল করে দলকে এগিয়ে নিলাম। ব্যস, আর যায় কোথায়! উল্লসিত কামাল ‘লতিফ দোস্ত আমার। কী জাদু দেখাইলা!’ বলতে বলতে মাঠে ঢুকে পড়লেন। মাঠের মধ্যেই আমাকে নিয়ে নাচানাচি শুরু করলেন। যতক্ষণ খেলা চলছিল ততক্ষণ তিনি মাঠের মধ্যেই বারবার আমার কাছে আসেন আর বলেন, ‘ওয়ানমোর। ওয়ানমোর।’ (তার প্রত্যাশা আরেকটা গোল করি)। আমাদের দল ৩-১ গোলে জয়ী হয়। খেলা শেষে কামাল আমাকে আর ছাড়েন না। আমাকে তাঁর পাশে বসিয়ে এটাওটা সুস্বাদু খাবার খাওয়ান। সেই যে বন্ধুত্বের শুরু তা দিন দিন শুধু গাঢ়ই হয়েছে। আমাদের ক্লাসে মেয়েদের মধ্যে খেলাধুলায় নাম করেন সুন্দরী সুলতানা। ছাত্রী হিসেবেও তিনি মেধাবী। আমরা জানতে পাই, সুলতানার সঙ্গে শেখ কামালের বিয়ে হবে। একদিন কামালকে বললাম, ‘দোস্ত, নিলে তো নিলে একেবারে সেরাটারে বেছে নিলে।’ কামাল শুধু মুচকি হাসলেন। লাজনম্র কণ্ঠে বললেন, ‘দোয়া কোরো ভাই।’
কোকিলকণ্ঠী গায়িকা রুনা লায়লা ১৯৭৪ সালে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে চলে এলেন পাকাপাকি। আমরা বেশ কজন বন্ধু কামালকে ধরলাম, ‘ব্যবস্থা কর। রুনা লায়লার গান শুনব।’ কামাল বললেন, ‘অবশ্যই শুনবি। দেখি কী করা যায়।’ এর কয়েকদিন পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টিএসসিতে রুনা লায়লা ও সাবিনা ইয়াসমিনের সংগীতানুষ্ঠানের ব্যবস্থা হলো। অনুষ্ঠান শেষ হওয়া পর্যন্ত উপস্থিত ছিলেন উপাচার্য ড. আবদুল মতিন চৌধুরী। শেখ কামালের একক প্রচেষ্টায় বিরাট ওই আয়োজন সম্ভব হয়েছিল। শেখ কামাল একবার অসুস্থ হয়ে পড়লে আমি তাঁকে দেখতে তাঁদের বাড়ি যাই। শেখ কামাল আমায় দেখে খুব খুশি। কামালের শয্যাপাশে বসা ছিলেন খালাম্মা (কামালের মা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব)। আজকাল শেখ কামালের বড়বোন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে যখন টিভি পর্দায় দেখি তখন চোখে ভেসে ওঠে খালাম্মার সেই মুখাবয়ব যা সেদিন কামালের পাশে দেখেছিলাম। মা-মেয়ের চেহারায় বেশ মিল।
শেখ কামাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে আবাহনী ক্লাব গড়ে তোলেন। এতে দেশে আধুনিক ফুটবল খেলার সূত্রপাত ঘটে। কামাল একদিন আমায় প্রস্তাব দেন, ‘তুমি আবাহনীর হয়ে খেলতে পার দোস্ত। সেজন্য ধানমন্ডি খেলার মাঠে রোজ সকালে অনুশীলনে নামতে হবে।’ শেখ কামাল বন্ধু হিসেবে যে সম্মান আমায় দিয়েছেন, ছেলের বন্ধু হিসেবে খালাম্মা যে গভীর মমতায় আদর-আপ্যায়ন করেছেন তা আমার জীবনে অক্ষয় স্মৃতি।
লেখক : সাবেক উচ্চপদস্থ ব্যাংক কর্মকর্তা।