আবহাওয়া হঠাৎ হঠাৎ বিরূপ আচরণ করে বসছে। আবহাওয়া দফতর বলছে, এ বছর জুলাইয়ে গড় বৃষ্টিপাত ইতিহাসে সবচেয়ে কম, শতকরা ৫৭.৬ ভাগ বৃষ্টিপাত কম হয়েছে, এমনকি আগস্টেও বৃষ্টিপাতের তেমন পূর্বাভাস তারা দিতে পারছে না। উত্তরবঙ্গের অনেক জায়গায় খরা দেখা দিচ্ছে, অথচ বর্ষা শুরুর আগেই অকস্মাৎ ভীষণ বৃষ্টিতে সেসব অঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে গিয়েছিল বন্যা।
মনে পড়ছে বছর সাতেক আগের কথা। অক্টোবর হবে। মানিকগঞ্জের সিংগাইরের গ্রামে গ্রামে আমন মৌসুমের ধান কাটা ও ফলন বিষয়ে কাজ করে বেড়াচ্ছিলাম। দুপুরে তীব্র গরম। এরই মধ্যে মাঠে মাঠে কৃষক ধান কাটছিল। গরমে ঘেমে তারা ভিজে যাচ্ছিল। টপ টপ করে ঝরছিল ঘাম। হেমন্ত ঋতুতে বা কার্তিকে এমন গরম ছিল না। এখন ক্রমেই আবহাওয়া বৈরী হয়ে উঠছে। বেশ ক্ষুধার্ত ছিলাম আমরা। আশপাশে রেস্তোরাঁ খুঁজে না পেয়ে গাড়ি টেনে চলে গিয়েছিলাম ধল্লার ভূম-দক্ষিণে। সড়কসংলগ্ন সেতু পেরিয়ে কয়েকটি দোকান। এর মধ্যেই কোনোরকম ভাঙাচোরা টিনের ছাউনি আর দুটি টেবিল পাতা একটি হোটেল। খাওয়া পাওয়া যাবে কি না খোঁজ নিতেই কয়েকজন বলেছিলেন, ‘এটা মুন্নির মার হোটেল। এলাকায় এই হোটেলই সেরা। খুব ভালো খাবার।’ দেখলাম, জীর্ণকায় পঞ্চাশোর্ধ্ব এক ব্যক্তি এবং তাঁর স্ত্রী হোটেলটি চালান। হোটেলের কোনো নাম লেখা নেই কোথাও। খেতে বসে দেখলাম মুন্নির মা সত্যিই যত্ন করে খাবার পরিবেশন করেন। রান্নার স্বাদও ভালো। কথায় কথায় জানা গেল তাঁদের বাড়ি মানিকগঞ্জে নয়, সাতক্ষীরা উপকূলে। লবণপানিতে জমিজিরাত সব গ্রাস করার কারণে তাঁরা এলাকা ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছেন এখানে। মুন্নির মায়ের মতো পরিবারগুলোকেই বলা হয় জলবায়ু উদ্বাস্তু। একটি দুটি পরিবার নয়, এমন শত শত পরিবার প্রতিদিন জলবায়ু উদ্বাস্তু হচ্ছে। উপকূলের বিপর্যস্ত জীবন ছেড়ে তাঁরা পাড়ি জমাচ্ছেন অন্যত্র। পৃথিবীর দেশে দেশে এ জলবায়ু উদ্বাস্তুর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এক দেশ থেকে অন্য দেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। যুদ্ধ ও সংঘাত যেমন যুগ যুগ ধরে টিকে থাকা জনপদ থেকে বিতাড়িত করছে, একইভাবে তাড়া করছে বৈরী জলবায়ুর প্রভাবও। আমার গ্রামীণ অর্থনীতি, কৃষি এবং গ্রামীণ জীবন নিয়ে কাজের অভিজ্ঞতা ৪০ বছরের ওপরে। চোখের সামনে কৃষির বহুমুখী পরিবর্তন ও কৃষিজীবী জনগোষ্ঠীর নানারকম জীবন-যন্ত্রণা দেখলাম। এর মধ্যে আগামীর কৃষি কোন দিকে এগোচ্ছে তা নিজের অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়েই আঁচ করতে পারি। আগামীর কৃষির প্রশ্নে প্রধান চ্যালেঞ্জ জলবায়ুর পরিবর্তন। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের ১৭ শতাংশ স্থলভাগ তলিয়ে যেতে পারে। এমনটা হলে ব্যাপক পরিমাণে চাষযোগ্য জমি যেমন ধ্বংস হবে, তেমন সাড়ে ৩ কোটির মতো মানুষ হবে গৃহহারা।
আমাদের দেশে এখনো ৮৮ শতাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। জিডিপিতে এ খাতের অবদান প্রায় ১৬ শতাংশ। কৃষি মূলত আবহাওয়ার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। আবহাওয়ার যে-কোনো পরিবর্তন, তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, মৌসুমের সময় ও কাল, বন্যা, মাটি ও পানিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি কৃষি উৎপাদন সরাসরি ব্যাহত করে। গবেষকরা আশঙ্কা করছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমাদের কৃষক প্রায় ৫৫ শতাংশ প্রাকৃতিক সম্পদের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে পারে। কৃষিজমির পরিমাণ কমে গিয়ে খাদ্যশস্য উৎপাদন প্রায় ৩০ শতাংশ কমে যেতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের অন্যান্য ক্ষেত্রের তুলনায় কৃষি, মৎস্য, প্রাণী সম্পদ তথা গোটা খাদ্য নিরাপত্তায় প্রভাব পড়বে সবচেয়ে বেশি। জলবায়ু পরিবর্তন এবং এর ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, জলোচ্ছ্বাস-বন্যা ও সামুদ্রিক ঝড় বেড়ে যাওয়ার ফলে দ্রুতগতিতে সমুদ্রোপকূলবর্তী এলাকা থেকে ভিতরের অঞ্চলগুলোর মাটিতেও লবণাক্ততা বাড়ছে। মাটিতে লবণাক্ততা বেড়ে গেলে তার উর্বরতা কমে যায়, শস্যের ফলন ব্যাহত হয়। সেখানে বাংলাদেশের কৃষিজমির ৩০ শতাংশই উপকূল এলাকায়। বাড়তে থাকা লবণাক্ততার কারণে উচ্চফলনশীল ধানের ফলন ১৫.৬ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে বলে এক গবেষণায় আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক।বিজ্ঞানীদের মতে, ২১০০ সালের মধ্যে সমুদ্রের পানির স্তর ৫০ থেকে ১৩০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত ওপরে উঠতে পারে। বর্তমানে বাংলাদেশের অর্ধেকের বেশি অংশ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ৫ মিটার উঁচু। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলবাসী অনেক বড় ঝুঁকিতে রয়েছে। বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশের মানুষ বন্যা, খরা, দুর্ভিক্ষ ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো বিপর্যয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে এত দূর এসেছে। পরিবর্তিত জলবায়ুর সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করাই আপাতত সবচেয়ে বড় সমাধান মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। আমি নেদারল্যান্ডসে দেখেছি জলবায়ু পরিবর্তনকে মাথায় রেখে তারা কীভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তাদের অনেক উদ্যোগ দেখে মনে হতে পারে অপ্রয়োজনীয় ও ব্যয়সাপেক্ষ। যেমন ভাসমান ক্যাটেল ফার্ম। এত এত জমি থাকতে কেন যাব নদীর পানিতে ভাসমান খামার গড়তে! কিন্তু এটা তাদের এক ধরনের পূর্বপ্রস্তুতি। যে-কোনো বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে তারা নানাভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিশেষ করে যান্ত্রিক ও প্রযুক্তির কৃষির প্রাধান্য দিচ্ছে তারা। একদিকে যেমন মাটি ও পানির গুণগত মানের কথা ভাবছে। অন্যদিকে ভাবছে প্রতিকূলীয় পরিবেশেও কীভাবে উৎপাদন ঠিক রাখা যায়।
আমাদের দেশের মানুষ দুর্যোগে তার নিজস্ব শক্তি, সাহস আর অভিজ্ঞতা পুঁজি করেই পরিস্থিতি মোকাবিলা করে। ষাটের দশকে বিশ্বব্যাপী যখন সবুজ বিপ্লব সূচিত হয় তখনকার জন্য তা ছিল অপরিহার্য এক উদ্যোগ। তার ফলেই সারা পৃথিবীর একাংশের মানুষ খাদ্য নিরাপত্তার এক স্বস্তির সন্ধান পায়। অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো অনেকাংশেই খাদ্যের জোগান পায়। টানা প্রায় ৬০ বছর ওই সাফল্যই এখনো বিশ্ববাসীর জন্য আশীর্বাদ হয়ে আছে। ব্যতিক্রম নেই তা নয়। শুরুতে যে বিষয়ের অবতারণা করেছিলাম, অনুন্নত দেশগুলোয় জলবায়ু উদ্বাস্তু বাড়ছে। আফ্রিকার মরু অঞ্চলে তীব্র খরায় মানুষ ও পশুপাখি মারা যাচ্ছে। এ মুহূর্তে বিশ্বের বহু দেশের মানুষকে ভয়ংকর দাবদাহে পুড়তে হচ্ছে, কোথাও আবার চলছে বন্যা। যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের একটি অংশে গত মাসে থার্মোমিটারের পারদ সব রেকর্ড ভেঙে উঠে গেছে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে। তাতে যানবাহন চলাচলে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে, তৈরি হয়েছে পানির সংকট। অধিকাংশ ঘরবাড়ি কাঠের তৈরি বলে অধিক তাপে আগুন লাগার ঘটনাও ঘটছে। ১৯ জুলাই যুক্তরাজ্যের তাপমাত্রা ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠে যায়। যুক্তরাজ্যের আবহাওয়া দফতর বলছে, এ রকম তীব্র দাবদাহের প্রবণতা সাম্প্রতিক সময়ে অন্তত ১০ গুণ বেড়েছে এবং আগামীতে অবস্থা এর চেয়েও বাজে হতে পারে। গত সপ্তাহে আবহাওয়া দফতরে গিয়ে জানতে পারি জুলাইয়ে আমাদের দেশেও সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। রাজশাহীতে ৩৯.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা এর আগে কোনো বছর জুলাইয়ে রেকর্ড করা হয়নি। তাপমাত্রা বৃদ্ধির বিরূপ প্রভাব পড়েছে চীনেও।
প্রচ- গরমে অতিষ্ঠ হয়ে চীনের বিভিন্ন বাসাবাড়ি, অফিস ও কারখানায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের ব্যবহার বেড়েছে। এতে আশঙ্কা করা হচ্ছে, গ্রীষ্মকালজুড়ে বিদ্যুতের চাহিদা মেটানো কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। চীনের জরুরি ব্যবস্থাপনাবিষয়ক মন্ত্রণালয় বলেছে, উ™ূ¢ত পরিস্থিতিতে নিরাপদে কার্যক্রম পরিচালনার বিষয়টি বড় ধরনের পরীক্ষার মধ্যে পড়তে পারে। এ মাসে সাংহাইয়ের তাপমাত্রা ৪০.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছেছে। এগুলো পৃথিবীর জন্য এক ধরনের সতর্ক সংকেত। আমাদের দেশ বন্যা, লবণাক্ততার মতো জলবায়ুর বৈরী পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে। একই সঙ্গে ঋতু পরিবর্তনের প্রভাব তো রয়েছেই। এ পরিবর্তনগুলো মাথায় রেখে বর্তমান ও আগামীর প্রশ্নে নতুন করে জ্ঞান, প্রযুক্তি ও কৌশলের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। যতই দুর্যোগ ও জলবায়ুগত পরিবর্তন আসুক না কেন, তা মোকাবিলা করেই টিকে থাকতে হবে। দুর্যোগে টিকে থাকার ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের কৃতিত্ব রয়েছে। এ সহনশীলতা ধরে রাখার জন্যই প্রয়োজন সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিজ্ঞান ও কৌশলের ব্যবহার। বিশেষ করে টিকে থাকার প্রশ্নে কৃষিকে আধুনিকায়ন করার উদ্যোগ এখনই নিতে হবে।
লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব