চার দিনের সফরে প্রধানমন্ত্রী ভারত গিয়েছিলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ সফর। ৬ সেপ্টেম্বর দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে আনুষ্ঠানিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে জ্বালানি এবং খাদ্যে সহায়তার অঙ্গীকারসহ দুই দেশের মধ্যে সাতটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। ভারত বাংলাদেশকে বিনাশুল্কে ট্রানজিট সুবিধা দিয়েছে। ২০২০ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। রীতি অনুযায়ী সে সময়ই তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ভারত সফরে আমন্ত্রণ জানান। এ ধরনের বৈঠকের আগে দুই দেশের মধ্যে আলোচ্যসূচি নিয়ে নানা ধাপে নানা বৈঠক হয়। এসব বৈঠকের চূড়ান্ত রূপ হলো দুই নেতার শীর্ষ বৈঠক। এসব বৈঠকে দেওয়া-নেওয়ার কিছু থাকে না। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে বিভিন্ন অমীমাংসিত বিষয় রয়েছে। এর অনেকটির সমাধান হয়েছে। অনেক বিষয় নিয়ে দুই দেশের আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশ-ভারতের ’৭৫-পরবর্তী যেসব সমস্যা ছিল তার মধ্যে গঙ্গার পানি বণ্টন, স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন, বিচ্ছিন্নতাবাদী দমন, সীমান্ত হত্যা, সমুদ্রসীমা বিরোধ, অভিন্ন নদীর পানির হিস্সা নির্ধারণ ইত্যাদি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। গত এক যুগে এসব অনিষ্পন্ন বিষয়ের অনেকটিরই সমাধান হয়েছে। এখনো সীমান্ত হত্যা, তিস্তার পানি চুক্তির মতো কিছু বিষয় রয়ে গেছে। এর মধ্যে সীমান্ত হত্যা অনেকখানি কমে এসেছে। এবারের সফরেও সীমান্ত হত্যা বন্ধে অঙ্গীকার করেছে দুই দেশ। তিস্তার পানি চুক্তি আটকে আছে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির আপত্তির কারণে। কিন্তু দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সম্পর্কের মাপকাঠি কখনো দেওয়া-নেওয়ার হিসাবে হয় না। একটি দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের অনেকখানি নির্ভর করে প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্কের ওপর। প্রতিবেশী বড় না ছোট তা মুখ্য বিষয় নয়। দুটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস ও সহযোগিতা দুই দেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। দুটি দেশের সম্পর্ক ভালো হলে একে অন্যের উন্নয়নের পরিপূরক হতে পারে। প্রতিবেশীর সঙ্গে বৈরিতা কখনই একটি রাষ্ট্রকে স্বস্তি দেয় না। ভারত বাংলাদেশের ঐতিহাসিক বন্ধু। দুই দেশের সম্পর্ক রক্তের বন্ধনে আবদ্ধ। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তির সংগ্রামে ভারতের সর্বাত্মক সহযোগিতা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। বাংলাদেশে যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করে, তারা এজন্য ভারতের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশে কার্পণ্য করে না কখনো। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ’৭১-এ ভারত এবং শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর অকৃপণ সহযোগিতাকে স্মরণ করেছিলেন গভীর শ্রদ্ধায়। পাশাপাশি তিনি এক আত্মমর্যাদাশীল বাংলাদেশ বিনির্মাণের ব্যাপারে ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ভারতের অনুগত নয় বরং জাতির পিতা চেয়েছিলেন একটি সম্মান ও মর্যাদাপূর্ণ সম্পর্ক। এ কারণেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার পরপরই ভারতীয় সেনা প্রত্যাহারকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। ১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি জাতির পিতা ভারত সফর করেন। এ সফরেই তিনি শ্রীমতী গান্ধীকে সেনা প্রত্যাহারের অনুরোধ করেন। ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুর অনুরোধ রক্ষা করেন। জাতির পিতার জন্মদিনে, ১৯৭২-এর ১৭ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরের আগেই ১৫ মার্চ ভারতীয় সেনাবাহিনী ফেরত নেওয়া সমাপ্ত হয়। বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে ঐতিহাসিক মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বাংলাদেশ সফরের সময় ১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ এ ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষর হয়; যা দুই দেশের সম্পর্কের ভিত্তিমূল। ১৯৭৪ সালের ১৬ মে বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এসব চুক্তির মাধ্যমে জাতির পিতা বাংলাদেশের ‘স্বাধীনতা’ নতুন উচ্চতায় উপনীত করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু দুই দেশের পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও মর্যাদাপূর্ণ সম্পর্কের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। ’৭১-এ যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, বিজয়ের পর তারাই বাংলাদেশে সস্তা জনপ্রিয়তার আশায় ভারতবিরোধিতার জিকির শুরু করে। ’৭৫-এ যে অপশক্তি জাতির পিতাকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল তারাই ভারতবিদ্বেষ ছড়িয়ে বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তান বানানোর ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করেছিল। ’৭৫-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতি ‘ভারতবিরোধিতা’ ছিল সস্তা এক প্রবণতা। ‘ভারত জুজু’র ভয় দেখিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিপরীত ধারার পুনর্বাসন হয়। ভারতবিরোধিতা, আওয়ামী লীগ-বিরোধিতা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-বিরোধিতা ধীরে ধীরে পরিকল্পিতভাবে একবিন্দুতে মেলানো হয়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই বাংলাদেশ ভারতের অঙ্গরাজ্যে পরিণত হবে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই মসজিদে উলুধ্বনি শোনা যাবে। ফেনী পর্যন্ত ভারত হবে। মসজিদে আজান হবে না। ইত্যাদি বক্তব্য গোয়েবলসীয় কায়দায় ছড়ানো হয়। জিয়া, এরশাদ এবং বেগম জিয়া লাগাতারভাবে এসব সস্তা বুলি আওড়িয়েই জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চালিয়েছেন। এসব বক্তব্য দিয়ে ধর্মান্ধ, মৌলবাদী ও স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির ডালপালা মেলার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।
১৯৭৫ থেকে ’৯৬ পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে চটকদার ইস্যু ছিল ‘ভারত’। এমনকি ’৯৬-এর নির্বাচনী প্রচারণায় বেগম জিয়া ফেনীর এক জনসভায় বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জিতলে ফেনী ভারতের দখলে চলে যাবে।’ (সূত্র : দৈনিক ইত্তেফাক ৩০ মে ১৯৯৬)। কিন্তু ভারত জুজু ওই নির্বাচনে কাজে আসেনি। ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়ে শেখ হাসিনা গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি করতে সক্ষম হন। পার্বত্য শান্তিচুক্তি ছিল তাঁর আরেকটি অনন্য অর্জন। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক আবার একটি স্বাভাবিক সড়কে এগোতে থাকে। এ সময় ভারত প্রতিবেশী দেশগুলোর ব্যাপারে ‘নতুন কূটনীতি’ শুরু করে। ‘শুধু এক দলের সঙ্গে সম্পর্ক নয়’ এ নীতিতে ভারত বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে আগ্রহী হয়। এ আগ্রহ থেকেই বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে নৈকট্য বাড়ায় ভারত। ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপির উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল ভারত সফর করে। সে সফরে একগুচ্ছ প্রতিশ্রুতির ডালি সাজিয়ে নিয়ে যায় বিএনপি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর একাধিক বক্তৃতায় সোজাসাপটা এসব কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘বিএনপির সঙ্গে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা র-এর বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে র নির্বাচনে বিএনপিকে সহযোগিতা করতে সম্মত হয়।’
২০০১ সালের নির্বাচনে এক ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে। ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে বিরল এক ঐক্য হয় বিএনপির পক্ষে। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান আদালতে জবানবন্দিতে স্বীকার করেন, ওই নির্বাচনে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই বিএনপিকে টাকা দিয়েছিল। কিন্তু নির্বাচনের পর ভারতের মোহভঙ্গ ঘটে। পাকিস্তানি মদদে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত অঞ্চল হয়ে ওঠে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অভয়ারণ্য। ১০ ট্রাক অস্ত্রের ঘটনার পর ভারত বুঝতে পারে ‘লোভী, অবিশ্বস্ত বন্ধুর চেয়ে ভয়ংকর আর কিছু হতে পারে না।’ বিএনপি এ সময় টাটা নাটক করে। টাটা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করছে বলে উল্লাসে পাগলের মতো চিৎকার করতে থাকেন তৎকালীন জ্বালানি উপদেষ্টা। টাটা এলো, টাটা এলো বলে বিএনপি নেতারা কোরাস গাইতে থাকেন। কিন্তু হঠাৎ করে টাটার বেলুন চুপসে গেল। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পক্ষ থেকে বলা হলো, ‘গ্যাসের দাম নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় টাটার সঙ্গে চুক্তি হচ্ছে না।’ কিন্তু ভারতের প্রভাবশালী সাময়িকী ফ্রন্টলাইন হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিল। তারা এক এক্সক্লুসিভ রিপোর্টে জানাল, ‘বিএনপি সরকারের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং তার বন্ধু টাটার কাছে বিপুল পরিমাণ উৎকোচ দাবি করেন। টাটার বিনিয়োগ গাইডলাইনে এ ধরনের উৎকোচ দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এজন্য বাংলাদেশে বিনিয়োগ থেকে টাটা সরে এসেছে।’অর্থাৎ বিএনপি ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থ বিবেচনা করেনি। নিজেদের ক্ষমতায় টিকে থাকার স্বার্থে তারা ভারতবিদ্বেষ ছড়িয়েছে। আবার ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ভারতের কাছে নিজেদের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছে।
এবার প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের শুরু থেকেই বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তারস্বরে চিৎকার করেছেন। মির্জা ফখরুল বলেছেন, ‘প্রতিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সফরে গিয়ে দিয়ে আসেন, কিন্তু নিয়ে আসতে পারেন না।’ বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর নিয়ে কোনো কথা বলতে চাই না। আমাদের পেছনে একটা তিক্ত এবং হত্যাশার অভিজ্ঞতা রয়েছে। আমরা প্রতিবার আশা করেছি যে এবার বুঝি তিনি কিছু নিয়ে আসবেন। প্রতিবার দেখেছি দিয়ে এসেছেন, নিয়ে আসেননি।’ বন্ধুত্ব মানে কি দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্ক? আপনি আপনার বন্ধুর বাসায় গেলেন, গিয়ে বললেন, আমার টিভি নেই, তোমার টেলিভিশনটা দাও। কিংবা আমার পকেটে টাকা নেই। কিছু টাকা দাও। এ রকম গিভ অ্যান্ড টেকের সম্পর্কে আর যা হোক বন্ধুত্ব হয় না। মির্জা ফখরুলের চেয়ে আর এক কাঠি সরস বিএনপির সিনিয়র যুগ্মমহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তিনি বললেন, ‘শেখ হাসিনা ভারতে গিয়ে সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দিয়ে এসেছেন।’ রুহুল কবির রিজভী বাংলাদেশের রাজনীতিতে অপার বিনোদন। তাঁর কথায় হাস্যরস করা যায়। সিরিয়াস চিন্তা করা যায় না। মির্জা ফখরুল একজন জ্ঞানী মানুষ। রাজনীতিতে আসার আগে শিক্ষকতা করেছেন। এমপি ছিলেন, মন্ত্রী ছিলেন। কাজেই তাঁর মন্তব্য তো আমাদের ভাবাবেই। জাতির পিতা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে একটা সম্মান এবং সমতার ভিত্তি দিয়েছিলেন। কিন্তু ’৭৫-এর পর বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও ফখরুদ্দীন-মইন উ আহমেদের সরকার ভারত থেকে কী কী এনেছিল? আমি খানিকটা খুঁজে দেখার চেষ্টা করলাম।
জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে প্রথম ভারত সফর করেছিলেন ১৯ ডিসেম্বর, ১৯৭৭। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে এ সফর সম্পর্কে বলা হয়েছিল, ‘প্রতিবেশীর সঙ্গে সর্বোত্তম সম্পর্ক উন্নয়ন’। দুই দিনের এ সফরে কোনো চুক্তি স্বাক্ষর হয়নি। কোনো সমঝোতা স্বাক্ষরও হয়নি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাইয়ের সঙ্গে জিয়া এক চা চক্রে মিলিত হন। সেখানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জিয়াকে একটি স্যুট পিস উপহার দেন। এ নিয়ে ২০ ডিসেম্বরের ‘আনন্দবাজার’ একটি চমৎকার ইঙ্গিতবাহী প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ‘জিয়াকে উর্দি ছাড়তেই স্যুট পিস দিলেন মোরারজি’। জিয়া তখন একাধারে সেনাপ্রধান, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং রাষ্ট্রপতি। তুখোড় রাজনীতিবিদ দেশাই স্যুট পিস দিয়ে তাঁকে বুঝিয়ে দিলেন উর্দি পরা স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা হয় না। জিয়া তাঁর শাসনামলে আরও দুই দফা ভারত সফর করেছিলেন। ১৯৮০ সালের ২১ জানুয়ারি ইউনিডো সম্মেলনে যোগ দিতে জিয়া ভারত সফরে যান। জিয়ার ভারত সফরের মাত্র সাত দিন আগে ১৪ জানুয়ারি ভোট বিপ্লবের মাধ্যমে রাজসিক প্রত্যাবর্তন ঘটে ইন্দিরা গান্ধীর। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে তিনি আবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন। এ সময় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শত চেষ্টা করেও মিসেস গান্ধীর সঙ্গে জিয়ার একটি সৌজন্য সাক্ষাতের ব্যবস্থা করতে পারেনি। জিয়ার শেষ ভারত সফর ছিল ৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৮০। আঞ্চলিক কমনওয়েলথ সম্মেলনে যোগ দিতে জিয়া ভারতে যান। এবার তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একটি ফটোসেশনে অংশ নিতে সক্ষম হন। গঙ্গার পানি, সীমান্ত হত্যা ইত্যাদি কোনো বিষয়েই জিয়া টুঁশব্দ করেননি।
জিয়ার মৃত্যুর পর ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ ক্ষমতা দখল করেন তৎকালীন সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এরশাদ ক্ষমতায় এসেই ভারতের মনজয়ের চেষ্টা করেন। ৬ অক্টোবর, ১৯৮২ সালে রওশন এরশাদকে সঙ্গে নিয়ে ভারত সফরে যান এরশাদ। ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’র খবর অনুযায়ী এরশাদের সামরিক আইন জারি এবং তাঁর ক্ষমতা গ্রহণের যৌক্তিকতা তুলে ধরেন ভারত সরকারের কাছে। ‘আনন্দবাজার’ জানায়, ভারতের পক্ষ থেকে এরশাদকে এক জোড়া গাভি উপহার দেওয়া হয়। পরের বছর জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে এরশাদ আবার দিল্লি যান। এবার তিনি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে একটি বৈঠক করতে সক্ষম হন। কিন্তু বাংলাদেশের অমীমাংসিত ইস্যু আলোচনার টেবিলেই আনতে পারেননি এরশাদ। ’৮৪-এর ৩ নভেম্বর এরশাদ ভারতে গিয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর শেষকৃত্যে যোগ দিতে। এরশাদের শেষ ভারত সফর ছিল ১৯৮৬ সালের ১৬ জুলাই। এটি ছিল এরশাদের প্রথম এবং একমাত্র রাষ্ট্রীয় সফর। রাজীব গান্ধীর সঙ্গে এ বৈঠকে গঙ্গার পানি বণ্টন কিংবা স্থলসীমান্ত চুক্তি নিয়ে কোনো আলোচনাই হয়নি।
বেগম জিয়া ক্ষমতায় এসে ১৯৯২-এর ২৫ মে তিন দিনের সফরে ভারতে যান। এটি ছিল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর রাষ্ট্রীয় সফর। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাওয়ের সঙ্গে একান্ত বৈঠকে মূল আলোচনার বিষয় ছিল অবৈধ বাংলাদেশিদের ভারতে অনুপ্রবেশ বন্ধ। বেগম জিয়া-নরসিমা রাওয়ের বৈঠকের পর ভারত থেকে পুশইন শুরু হয়। তিন দিনের সফর শেষে ঢাকায় ফিরে বেগম জিয়া বিমানবন্দরেই সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় একজন সাংবাদিক জানতে চান ‘গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না।’ বেগম জিয়া বলেন, ‘আমি তো এ বিষয়টি ভুলেই গিয়েছিলোম।’ যা-ই হোক, প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের পর শুরু হয় পুশইন। অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো শুরু করে ভারত। বেগম জিয়া তাঁর সফরেই এ-সংক্রান্ত মুচলেকা দিয়ে এসেছেন বলে সেখানকার গণমাধ্যম দাবি করে। বেগম জিয়া দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে ২০০৬ সালের ২০ মার্চ ৪০ ব্যবসায়ীসহ ৯৬ সদস্যের প্রতিনিধি দল নিয়ে দিল্লি যান। বেগম জিয়ার সঙ্গে মনমোহন সিংয়ের বৈঠকটি ছিল তিক্ততাপূর্ণ। ভারত বাংলাদেশের ভূখন্ডে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের তৎপরতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। সংখ্যালঘু নিপীড়ন এবং হিন্দুদের দেশত্যাগ নিয়েও কথা হয় দুই প্রধানমন্ত্রীর। ভারতের প্রধানমন্ত্রী আঞ্চলিক নিরাপত্তার স্বার্থে জঙ্গিবাদ ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ব্যাপারে বাংলাদেশের স্পষ্ট ভূমিকা দাবি করেন। এ বৈঠক এতটাই তিক্ততাপূর্ণ ছিল যে দুই দেশ যৌথ ইশতেহার পর্যন্ত প্রকাশ করেনি। একটি যৌথ প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে নিরাপত্তা, বাণিজ্যসহ সব বিষয়ে একত্রে কাজ করার অঙ্গীকার করা হয়। বেগম জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতা থেকে বিদায় নেয় এক ভয়ংকর রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে। এ প্রেক্ষাপটে ক্ষমতায় আসে ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে এক-এগারো সরকার। সেনাসমর্থিত এ সরকারের মূল কর্তৃত্ব ছিল তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদের হাতে। ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারতের সেনাপ্রধানের আমন্ত্রণে পাঁচ দিনের সফরে জেনারেল মইন উ আহমেদ ভারত সফরে যান। ওই সফরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন বাংলাদেশের সেনাপ্রধান। গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রণব মুখার্জির সঙ্গে। পাঁচ দিনের সফর শেষে ছয়টি ঘোড়া নিয়ে ফেরেন জেনারেল মইন।
সব আমলের সরকারপ্রধানের ভারত সফরের ইতিবৃত্ত খুঁজে বের করলাম আসলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কথার পরিপ্রেক্ষিতে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া ভারত থেকে বাংলাদেশের মানুষের জন্য আর কি কেউ কিছু আনতে পেরেছেন? প্রথম মেয়াদে শেখ হাসিনা গঙ্গার পানি বণ্টনের চুক্তি করেছিলেন। দ্বিতীয় মেয়াদে তিনি বঙ্গবন্ধুর সময় স্বাক্ষরিত স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন করেন। ’৭৪-এ ওই চুক্তি স্বাক্ষর হলেও ভারতের পার্লামেন্টে অনুমোদিত না হওয়ায় বাস্তবায়ন হয়নি। জিয়া, এরশাদ, বেগম জিয়া কেউই তা বাস্তবায়নের চেষ্টাও করেননি। শেখ হাসিনার সফল কূটনীতির কারণে ছিটমহলবাসীর বন্দিজীবনের অবসান হয়। শেখ হাসিনাই সমুদ্রবিরোধ নিষ্পত্তি করেন। সীমান্ত হত্যা বন্ধে উদ্যোগ নেন। এবার কুশিয়ারা নদীর পানির হিস্সা আদায় করেছেন। এনেছেন ট্রানজিট সুবিধা। অন্যদিকে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ব্যাপারে শূন্য সহিষ্ণুতা নীতি গ্রহণ করে দুই দেশের সম্পর্কে বিশ্বাস— আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর সফর বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে বিশ্ব যখন এক মহামন্দার দিকে দ্রুত ধাবমান। এ সময় প্রধানমন্ত্রী ভারতে গিয়ে এ দেশের জনগণের জন্য আপৎকালীন খাদ্য ও জ্বালানির নিশ্চয়তা নিয়ে এলেন। এটা যে কত বড় অর্জন, কত বিশাল প্রাপ্তির তা যারা বোঝেন না, তারা আসলে জ্ঞানপাপী।
লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত