সোমবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

কংগ্রেসের সভাপতি হবেন কে?

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

কংগ্রেসের সভাপতি হবেন কে?

২০১৪ সালে ক্ষমতায় এসে নরেন্দ্র মোদি প্রথম স্লোগান দিয়েছিলেন-কংগ্রেসমুক্ত ভারত। সেই স্লোগান এখনো মোদি, অমিত শাহ এবং আরএসএস নেতারা দিয়ে চলেছেন। সেই স্লোগানে ভারতবাসী এতটুকু বিচলিত বা বিভ্রান্ত হননি। আগামী মাসে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির অধিবেশনের প্রস্তুতি এখন তুঙ্গে। দেশের ২৯টি রাজ্যের মধ্যে মাত্র তিনটিতে-পশ্চিমবঙ্গ, মহারাষ্ট্র এবং তামিলনাড়ু প্রদেশ কংগ্রেস থেকে দাবি তোলা হয়েছে রাহুল গান্ধীকেই কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে প্রার্থী করা হোক। ২০ সেপ্টেম্বর এই লেখা পর্যন্ত দিল্লি থেকে যে খবর এসে পৌঁছেছে তাতে দেখা যাচ্ছে, কেরলের সাংসদ শশী থারুর যিনি জাতিসংঘের সাবেক ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল এবং ভারতের প্রাক্তন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তিনি প্রার্থী পদ দাখিল করতে চলেছেন। দ্বিতীয়জন হলেন, রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী, পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ অশোক গহলৌত। দীর্ঘকাল ধরে তিনি বিজেপির সঙ্গে লড়াই করে চলেছেন। তিনি আগেও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ছিলেন।

গান্ধী পরিবারের কেউ যে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না, সেই ইঙ্গিত অনেক আগেই দিয়েছিলেন সোনিয়া ও রাহুল গান্ধী। কংগ্রেস এখন ব্যস্ত দেশ জোড়ো আন্দোলনে। অর্থাৎ কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত পদযাত্রা করছেন রাহুল গান্ধী। ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস ক্ষমতায় ফেরার জন্য সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার পদযাত্রা শুরু করেছে ২৫ দিন আগে।

এই আন্দোলনের উদ্যোক্তা রাহুল গান্ধী। শুরু করেছেল, ১৯৯১ সালে তিরুবন্তপুরমে- যেখানে তার পিতা রাজীব গান্ধীকে হত্যা করা হয়েছিল সেখান থেকে। দক্ষিণ ভারতে ইতোমধ্যে বিপুল সাড়া জাগিয়েছেন রাহুল। তা বোঝা যাচ্ছে ভারতের সব মিডিয়ার রিপোর্ট থেকেই। এতেও গেরুয়া বাহিনীর উষ্মা। বিবেকানন্দ রকে গিয়ে বিবেকানন্দের ছবিতে প্রণাম করে যাত্রা শুরু করেছিলেন রাহুল। কিন্তু বিজেপির স্মৃতি ইরানি অভিযোগ তোলেন বিবেকানন্দের প্রতিকৃতিতে প্রণাম করেননি রাহুল। সেদিনই ভারতের সমস্ত মিডিয়া রাহুলের প্রণাম করার ছবি ছেপে স্মৃতি ইরানির অভিযোগ নস্যাৎ করে দেয়।

একদিকে যখন সভাপতি নির্বাচনে গহলৌত বনাম থারুরের মঞ্চ প্রস্তুতি চলছে, তখনই দলের সবার প্রথম পছন্দ রাহুল গান্ধী বলে বার্তা দেওয়ার কাজও চলছে। প্রথমে রাজস্থান, তারপর ছত্তিশগড়, গুজরাট, বিহার, মহারাষ্ট্র, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, পুন্ডুচেরি এবং জম্মু কাশ্মীরের প্রদেশ কংগ্রেসে রাহুলই সভাপতি হোন বলে প্রস্তাব পাস করানো হয়েছে। মহারাষ্ট্রে এই প্রস্তাব পাসের সময় জি-২৩ গোষ্ঠীর নেতা পৃত্থিরাজ চৌহান হাত তুলে সমর্থন জানাননি। রাহুলের ঘনিষ্ঠ শিবির জানিয়েছে, সভাপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কোনো সম্ভাবনাই নেই। রাহুল ভারত জোড়ো যাত্রার ফাঁকে কেরলে স্নেক বোট প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন।

২৪ সেপ্টেম্বর থেকে সভাপতি ভোটের মনোনয়ন শুরু হবে। রাহুল তার আগে ২২ তারিখ এক দিনের জন্য দিল্লি এসে পরদিনই ভারত জোড়ো যাত্রায় অংশ নিতে ফিরে যাবেন। মনোনয়ন পর্বে তিনি দিল্লিতে থাকতে চাইছেন না। ১৮৮৫ সালে কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর এক সময় মতিলাল নেহরু, একাধিকবার জওহরলাল নেহরু, চার-পাঁচবার ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী সভাপতি হয়েছিলেন। আরএসএসের অঙ্গুলি হেলানে রাজীবকে হত্যা করা হয়। রাজীব গান্ধীর হত্যার পর কিছুদিনের জন্য সভাপতি হয়েছিলেন সীতারাম কেশরী। পরে সোনিয়া গান্ধী সভাপতি হন। সোনিয়ার পর ২০১৮ সালে রাহুল কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হন। পরে আবার সোনিয়া কংগ্রেসের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।

বর্তমানে সোনিয়াই দলের সভাপতি। শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি আর এবার দাঁড়াতে চাইছেন না। কিন্তু দলের প্রবীণরা চাইছেন, সোনিয়াই ফের সভাপতি হোন। কিন্তু তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি তো দূরের কথা গান্ধী পরিবারের কেউ এবার ভোটে দাঁড়াবেন না।

ইতোমধ্যে আবার নেমেছেন প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও বিহারের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী নিতীশ কুমার। তিনি অবিজেপি সরকার গঠন করার জন্য ১৬টি আঞ্চলিক দলের সঙ্গে কথা বলেছেন। এই দলগুলো তাকে জানিয়েছে, কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে কোনো জোট হতে পারে না। নিতীশ কুমারের সঙ্গে ওই আঞ্চলিক দলের নেতারা দেখা করলেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি দেখা করেননি। মমতা ঘোষণা করেছেন, তাকে আগে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করতে হবে।

অবিজেপি সরকারের প্রধানমন্ত্রী পদের দাবিদার আরও দুজন। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল এবং তেলেঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী টিআরএম। টিআরএম ও মমতা একই কায়দায় কংগ্রেস ছেড়ে আঞ্চলিক দল গঠন করেছিলেন।

এরা কেন বিজেপিকে সমর্থন করতে চাইছেন, রাজনৈতিক মহলে তার ব্যাখ্যা স্পষ্ট। মমতার মন্ত্রিসভার দ্বিতীয় ব্যক্তি পার্থ চট্টোপাধ্যায় এখন দুর্নীতির দায়ে জেলে। অপর কয়েকজন মন্ত্রীরও জেলে যাওয়া কেবল সময়ের অপেক্ষা। তাই মমতা ভোল পাল্টে গত সোমবার পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় বুক চাপড়ে বলেছেন, তার সরকারের বিরুদ্ধে যে ১৩৫টি দুর্নীতির মামলা ঝুলছে সেজন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দায়ী না। দায়ী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। তার এই বক্তব্যে রাজনৈতিক মহলে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। তারা প্রশ্ন তুলেছেন, এ কোন মমতা? মমতা কি ভয় পেয়ে গেছেন? কারণ তাকে নিজেকে এবং ভাইপোকে বাঁচাতে হবে। ইডি এবং সিবিআই’র তরফে বলা হয়, যে গরু পাচার, কয়লা পাচার, বালি পাচারসহ অন্তত ১০টি মামলায় অভিষেকের নাম জড়িত আছে। দক্ষিণ কলকাতায় ৪০টি বাড়ি কেনার জন্য অভিষেকের দিকেই তদন্তকারী অফিসাররা আঙুল তুলেছেন।

অভিষেককে (ভাইপো) কলকাতা হাই কোর্টে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যা কখনো ভারতবর্ষে ঘটেনি, তা ঘটে গেছে বাংলা টিভি চ্যানেল এবিপি আনন্দে। ওই চ্যানেলে কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, মমতার রাজত্বে মুড়ি-মুড়কির মতো দুর্নীতি হয়েছে। তার ওই সাক্ষাৎকার দেখে মঙ্গলবারের মধ্যেই একটা রাজনৈতিক আলোড়নের সৃষ্টি হয়েছে। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় তার এক ঘণ্টার সাক্ষাৎকারে পশ্চিমবঙ্গকে সতর্ক করে দিয়েছেন, ভবিষ্যতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাকে কঠোরতম, এমনকি অভাবিত পদক্ষেপও গ্রহণ করতে হতে পারে।

কারণ হিসেবে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, ‘এত দুর্নীতি জীবনেও কল্পনা করতে পারি না। স্কুল সার্ভিস কমিশন এবং মধ্যশিক্ষা পর্ষদ যেভাবে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য আদালতে পেশ করছিল, তা থেকেই দুর্নীতির বিষয়টি সামনে আসে। মূলত, বেআইনি শিক্ষক নিয়োগ মামলা ঘিরেই জনমানসে পরিচিত নাম বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। তার নির্দেশে ইতোমধ্যে চাকরি হারিয়েছেন বহু অযোগ্য প্রার্থী। বাদ পড়েননি মন্ত্রীর মেয়েও। তিনি বলেছেন, যারা জালিয়াতি করে চাকরি পেয়েছেন তাদের সবার চাকরি যাবে। তিনি এমনকি মমতার ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ারও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় স্পষ্ট করে বলেছেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার আপসহীন লড়াই চলবে।

কংগ্রেসের নির্বাচন নিয়ে সারা দেশে উদ্দীপনা তুঙ্গে উঠেছে। ১৮৫ বছরের ইতিহাসে এই প্রথমবার গান্ধী পরিবারের কোনো সদস্য কংগ্রেস সভাপতি পদে প্রার্থী হচ্ছেন না। কংগ্রেসের মধ্যে বিক্ষোভ দেখিয়ে যারা বেরিয়ে গিয়েছিলেন, তাদেরও দাবি ছিল, দ্রুত নির্বাচন হোক। সেই বিক্ষুব্ধদের দলেই ছিলেন শশী থারুর। আর এক শীর্ষ বিক্ষুব্ধ নেতা কাশ্মীরের গুলাম নবি আজাদ কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে গিয়ে আলাদা দল করেছেন। দলীয় নির্বাচনকে নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে রাহুল গান্ধীর দেশজোড়া পদযাত্রা। ভোটের দিন যত এগিয়ে আসছে, কংগ্রেস মহলে ততই বাড়ছে উত্তেজনা। কারণ এই ভোটের পরেই স্পষ্ট হবে কার হাতে থাকবে ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে কংগ্রেসের ব্যাটন।

লেখক : ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর