বুধবার, ৫ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০ টা

কর্তৃত্ববাদী অপসংস্কৃতি

খায়রুল কবীর খোকন

কর্তৃত্ববাদী অপসংস্কৃতি

দলনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির একটি  দৈনিকের ২৮ সেপ্টেম্বর সংখ্যার প্রথম পৃষ্ঠার দ্বিতীয় প্রধান শিরোনোম (হামলার ছবিসহ) : ‘ঘোষণা দিয়ে ছাত্রদলকে পেটাল ছাত্রলীগ’। দুটি বিষয় এ খবরে গুরুত্ব দিয়ে বলা হয়েছে- ক. ‘ক্যাম্পাসের (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) যে জায়গায় ছাত্রদল নেতা-কর্মীদের পিটিয়েছে ছাত্রলীগ, এর পাশেই নীলক্ষেত পুলিশ ফাঁড়ি’; খ. ‘হামলায় ছাত্রদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ ১৫ জন আহত’। ঘটনাটি ২৭ সেপ্টেম্বরের। পত্রিকাটির রিপোর্টটিতে শুরুর বাক্যটি হচ্ছে, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামানের সঙ্গে তাঁর কার্যালয়ে সৌজন্য সাক্ষাতের কর্মসূচি ছিল বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের নবগঠিত কমিটির। সোমবার এ কর্মসূচি ঘোষণার পরই ছাত্রদলকে ক্যাম্পাসে প্রতিহত করার ঘোষণা দেয় ছাত্রলীগ। ঘোষণা অনুযায়ী কাজ করেছে ছাত্রলীগ’।

২৯ সেপ্টেম্বর আরেকটি প্রধান বাংলা দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠার শীর্ষ শিরোনাম : ‘ফের ছাত্রলীগের অগ্নিমূর্তি’। সেখানে ছাত্রলীগের ‘কীর্তিগুলো’ উল্লেখ করা হয়েছে- ক. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলকে পিটিয়েছে খ. চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিটি নিয়ে অস্থিরতা গ. ইডেন মহিলা কলেজে দুই পক্ষে চুলাচুলি, চেয়ার ছোড়াছুড়ি ঘ. রাজশাহী ছাত্রলীগ সভাপতি-সম্পাদক নানা অপকর্মে ঙ. কেন্দ্রীয় দুই শীর্ষ নেতার (সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক) কর্মকান্ড নিয়েও বিতর্ক। এখন এসব দেখে গণমানুষ তো চিৎকার জুড়তেই পারে- ‘মোনেমখানি এনএসএফ তুমি কোথায়? তুমি কি পুরো ফর্মে ফিরে এসেছ?’ বস্তুত  মোনায়েম খানের পালিত প্রেতাত্মা বিস্তৃত পরিসরে ভর করেছে বর্তমান দেড় দশকের কর্তৃত্ববাদী শাসকচক্রের সমর্থক ছাত্রলীগ-যুবলীগের ওপর।

সারা দেশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির চরম নৈরাজ্য, জ্বালানি তেলের নজিরবিহীন মূল্যবৃদ্ধি, বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ওপর পুলিশ ও সরকারি ছাত্র সংগঠন ও অন্যসব সংগঠনের কর্মীদের হামলা, অগণন মামলা, সভা-সমাবেশ ভেঙে দেওয়া ইত্যাদির প্রতিবাদে বিএনপি ও কয়েকটি বিরোধী দল যতই সভা-সমাবেশ, মিছিল-মানববন্ধন করার চেষ্টা চালাচ্ছে ততই তাদের শায়েস্তা করার তৎপরতা বাড়ানো হচ্ছে। আর প্রতিদিন সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী এবং তথ্যমন্ত্রী (দলের অন্যতম যুগ্মসাধারণ সম্পাদক) ও অন্যসব নেতা বিএনপি এবং অন্যসব বিরোধী দলের আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে হুমকি-ধমকি দিয়ে চলেছেন। তাঁরা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিদার, অথচ গণতন্ত্রের ভাষা তাঁদের মুখে নেই, এমনকি তাঁদের শরীরী-ভাষাও মানুষের মৌলিক অধিকারের প্রতি সামান্য সম্মান দেখায় না।

বিএনপি যেহেতু আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ দাবি করে আসছে, তাই আওয়ামী লীগ নেতারা ক্ষমতা হারানোর আতঙ্কে ভুগছেন। ভয় পেয়ে উল্টাপাল্টা বকে যাচ্ছেন এবং নিজেদের সমর্থকদের দিয়ে বিরোধী দলের সভা-সমাবেশ-মিছিলে হামলা চালানো ও পুলিশকে দিয়ে হামলার শিকার ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ‘উল্টো মামলা’ করার ব্যবস্থা নিচ্ছে। মজার ব্যাপার হলো, প্রথমে বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের সভা-সমাবেশে হামলা করে প- করে দেওয়ার চেষ্টা চালায়, বিরোধী নেতা-কর্মীদের আহত করে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করে, তারপর এসব মার-খাওয়া নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে ‘ডাহা-মিথ্যা’ মামলা সাজিয়ে তাঁদের গ্রেফতার করে জেলবন্দি করার ব্যবস্থা নেয়।

দেশে যখন বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ওপর একের পর এক আক্রমণ হচ্ছে, সরকারপ্রধান তখন ইউরোপ-আমেরিকা সফররত। তিনি যুদ্ধবিরোধী শান্তির বাণী ফেরি করেছেন বিশ্বনেতাদের কাছে। এ বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব চমৎকার ভাষায় বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী এখন দেশের ভিতরে বিরোধী দলকে পিটিয়ে, গুলি করে অগণতান্ত্রিক ও অমানবিক কাজটি করে “যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই” বাণী প্রচারের মহৎকর্মে নেমেছেন। আর বলছেন দেশে তিনি নাকি গণতন্ত্র কায়েম রেখেছেন!’

সুুহৃদ পাঠক! যাঁদের বয়স সত্তর বা তদূর্ধ্ব তাঁদের অবশ্যই স্মরণ থাকার কথা আইয়ুব-মোনায়েম স্বৈরাচারের শেষ সময়ে মানে ষাট দশকের শেষ পর্যায়ের বছরগুলোয় তাদের লালিত-পালিত এনএসএফ (ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফেডারেশন) ছাত্র-রাজনীতির নামে ‘ভাড়াটে গুন্ডাপান্ডা বাহিনী’ ও পাকিস্তানি সামরিক গোয়েন্দা সংস্থাসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে বিরোধীদলীয় সভা-সমাবেশ-মিছিলে হামলা, মিথ্যা মামলা দিয়ে বিরোধী রাজনীতিকসহ গণমানুষের ওপর নিপীড়নের স্টিমরোলার চালাতে আরম্ভ করেছিল। আশির দশকে স্বৈরাচার এরশাদও একই কৌশলে নিপীড়ন চালান। এমনকি স্বাধীনতার পর ক্ষমতায় আসা সরকারও বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ওপর একই কায়দায় নিপীড়ন চালিয়েছিল। বর্তমান সরকার ১৪ বছর ধরে কর্তৃত্ববাদী ধারায় যে শাসন চালাচ্ছে তার পরিণাম যে কী হতে পারে তা কি একবার তারা ভেবে দেখেছেন? জনগণের অর্থ অপচয়, দুর্নীতি তো অপরিসীম পর্যায়ে পৌঁছেছে। অর্থ সংকটে পড়ে চারটি বিশ্ব-সংস্থার কাছে ঋণ ভিক্ষার জন্য কান্নাকাটি করছে সরকার, এমনকি জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ঘটিয়ে গণমানুষের বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছে। আর রাষ্ট্রীয় দৈনন্দিন খরচের রাশ টেনে ধরার বাগাড়ম্বর চললেও তাতে সাফল্য আসছে না মোটেই। মূলত রাজনীতিক ও আমলাদের দুর্নীতির জন্যই তা সফল হচ্ছে না। সরকারপ্রধান ইউরোপ-আমেরিকায় গলা ফাটিয়ে বলার চেষ্টা করেছেন, তাঁর সরকার প্রকৃত জনপ্রতিনিধিত্বশীল ও গণতান্ত্রিক সরকার এবং বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকান্ডে এই আওয়ামী লীগ সরকারের আর কোনো বিকল্প নেই। এদিকে দুর্নীতির বেনোজলে ভেসে যাচ্ছে দেশ, মেগা প্রকল্পের নামে ‘মেগা হরিলুট’ আর সেসব অর্থ দেশের ভিতরে ক্ষমতাবানদের ভোগবিলাসে ও বিদেশে পাচারের কাজে লাগছে দেদার। সেসবের বিরুদ্ধে কথা বললে মামলার পর মামলা হচ্ছে প্রতিবাদী ব্যক্তি ও মিডিয়ার বিরুদ্ধে। এ সবকিছুই তো জলের মতো পরিষ্কার, দেশবাসীর চোখের সামনেই ঘটছে। পাশাপাশি মগ-দস্যু রাষ্ট্র মিয়ানমার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করার লক্ষ্য নিয়ে যে ১৩ লাখ রোহিঙ্গাকে জোরপূর্বক বাংলাদেশে ঢুকিয়ে দিয়েছে তাদের ওই দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে বিশ্বব্যাপী কূটনৈতিক তৎপরতা একেবারেই ‘জিরো’ পর্যায়ে। এখন মিয়ানমার তার ভিতরের যুদ্ধ বাংলাদেশে সম্প্রসারণের চক্রান্ত করছে যাতে উচ্ছেদকৃত ও বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের আর ফেরত নিতে না হয় এবং অবশিষ্ট ৭-৮ লাখ রোহিঙ্গাকে তাড়িয়ে দিয়ে বাংলাদেশে ঢোকানোর ব্যবস্থা করা যায়। মিয়ানমারকে এ অপকর্মে শতভাগ সমর্থন দিচ্ছে নয়া সাম্রাজ্যবাদী-নয়া উপনিবেশবাদী চীন। অথচ চীনকে একটা শক্ত ধমক দেওয়ার কথা মাথায়ই নিচ্ছে না বর্তমান বাংলাদেশ সরকার। (চীনের পাশাপাশি ভারত, রাশিয়া, জাপানেরও বিনিয়োগ কর্মকান্ডের কারণে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে স্বার্থের ব্যাপার রয়েছে, তাই তারাও মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাধ্য করতে কোনো কথা বলতে নারাজ)। বাংলাদেশের উচিত এক্ষুনি চীনসহ এ চারটি রাষ্ট্রকে কড়া বার্তা দেওয়া- এক্ষুনি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু ও বাংলাদেশ সীমান্তসংলগ্ন এলাকায় যুদ্ধাবস্থা বন্ধ করতে হবে।

লেখক : বিএনপির যুগ্মমহাসচিব, সাবেক সংসদ সদস্য ও ডাকসু সাধারণ সম্পাদক

সর্বশেষ খবর