বুধবার, ৫ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০ টা
ইতিহাসের পাতা থেকে

বাংলায় বর্গি হামলা

মুন্সি জামিলউদ্দিন

বাংলায় বর্গি হামলা

আওরঙ্গজেব-পরবর্তী মুঘল শাসনামলে শাসকদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আসে মারাঠাদের থেকে। মারাঠা সেনারা পেশোয়া বাজিরাওয়ের (১৭৪০-১৭৬১) শাসনামলে সমগ্র ভারতবর্ষে হামলা শুরু করে। ১৭৪২ থেকে ১৭৫১ সাল পর্যন্ত বাংলায় বারবার বর্গিদের আক্রমণ হয় এবং ১৭৫১ সালে বাংলার নবাব মারাঠাদের কাছে ওড়িশা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। ১৭৪২ সালের এপ্রিলের প্রথম দিকে একটি মারাঠা বাহিনী নাগপুর থেকে অগ্রসর হয়ে বর্ধমান আক্রমণ করে। খবর পেয়ে ১৫ এপ্রিল নবাব আলীবর্দী খান কটক থেকে বর্ধমান উপস্থিত হন। ভাস্কর পন্ডিতের নেতৃত্বে মারাঠা বাহিনী তাঁর রসদ সরবরাহব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেয়। তাদের অন্য একটি দল বর্ধমানের আশপাশে প্রায় ২৫ কিমি এলাকায় লুণ্ঠন ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। ২৬ এপ্রিল আলীবর্দী বাহিনী মারাঠা সেনাদের বেষ্টনী ভেঙে ফেলে কাটোয়া পৌঁছাতে সমর্থ হন। এ সময় মীর হাবিব নামে নবাবের এক পারস্যদেশীয় অভিজাত বিশ্বাসঘাতকতা করে মারাঠা দলে যোগ দেন। এ মীর হাবিব স্থানীয় বিষয়ে তাঁর জ্ঞান দিয়ে মারাঠাদের অভিযানে সহায়তা করেন। বাংলার নবাবের সঙ্গে শত্রুতার কারণে তিনি তাঁর অসাধারণ যোগ্যতা মারাঠাদের স্বার্থচরিতার্থে ব্যবহার করেন। ফলে বাংলায় মারাঠা বর্গিদের লুণ্ঠন ও ধ্বংসযজ্ঞ অব্যাহত থাকে। নবাবের কাটোয়া অবস্থানকালে তাঁর রাজধানী মুর্শিদাবাদ আক্রমণ ও অঢেল সম্পদ লুণ্ঠনে মীর হাবিব ভাস্কর পন্ডিতকে প্রলুব্ধ করেন। ১৭৪২ সালের ৬ মে ভাস্কর পন্ডিতের মারাঠা বাহিনী মুর্শিদাবাদের উপকণ্ঠ দহিপাড়ায় উপস্থিত হয় এবং বাজারগুলো পুড়িয়ে দেয়। তারা মুর্শিদাবাদে পৌঁছে লুণ্ঠন ও ধ্বংসলীলা চালাতে থাকে। তারা জগৎশেঠ পরিবারের কাছ থেকেই ৩ লাখ টাকা আদায় করে নেয়। মারাঠাদের হাত থেকে রাজধানী রক্ষার জন্য আলীবর্দী ৭ মে মুর্শিদাবাদে উপস্থিত হন। মারাঠারা ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে কাটোয়ায় সরে আসে এবং জুন থেকে কাটোয়া মারাঠা দখলদার বাহিনীর সদর দফতর রূপে পরিগণিত হয়। মীর হাবিব তাদের প্রধান উপদেষ্টা ও এজেন্ট মনোনীত হন।

বর্ষা মৌসুমের শেষে পথঘাট শুকিয়ে যাওয়ার আগেই আলীবর্দী মারাঠা বাহিনীকে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন, যাতে বর্ষার পিচ্ছিল ও কর্দমাক্ত পরিবেশে মারাঠা সেনারা তাদের স্বাভাবিক ক্ষিপ্রগতি হারিয়ে সহজে পর্যুদস্ত হয়। ১৭৪২ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর নবাব কাটোয়ায় ভাস্কর পন্ডিতের ক্যাম্পে ঘুমন্ত মারাঠাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালান। মারাঠা সেনারা তাদের মালামাল ফেলে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। ভাস্কর পন্ডিত বাংলার বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা মারাঠা দলগুলো একত্র করে মেদিনীপুরের দিকে অগ্রসর হন এবং রেশম উৎপাদনের কেন্দ্র রাধানগর লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করে নারায়ণগড়ে এসে ঘাঁটি গাড়েন। আলীবর্দী তাদের বিরুদ্ধে অভিযানে নিজেই সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দেন। ১৭৪২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে তিনি মারাঠাদের থেকে কটক পুনরুদ্ধার করে তাদের চিল্কা হ্রদের ওপারে বিতাড়িত করেন। ১৭৪৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি তিনি বিজয়ীবেশে মুর্শিদাবাদ ফিরে আসেন। মারাঠাদের লুণ্ঠন ও ধ্বংসলীলা থেকে পরিত্রাণ লাভ এবং তাদের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি করে বাংলা থেকে বিতাড়নের লক্ষ্যে আলীবর্দী খান বিশ্বাসঘাতকতা ও হঠকারিতার কৌশল অবলম্বন করেন। বাংলার ‘চৌথ’ প্রদানের বিষয়ে শান্তিপূর্ণভাবে সমঝোতায় উপনীত হতে ভাস্কর পন্ডিত ও তাঁর সহযোগীদের একটি বৈঠকে উপস্থিত হওয়ার জন্য তিনি আমন্ত্রণ জানান। ১৭৪৪ সালের ৩১ মার্চ মানকাড়া নামক স্থানে ওই বৈঠক অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত হয়। ২১ জন সহযোগীসহ ভাস্কর পন্ডিত তাঁবুতে উপস্থিত হলে তাঁবুর পর্দার আড়ালে লুকিয়ে থাকা ঘাতকদল তাদের হত্যা করে। এ ঘটনার অব্যবহিত পরই বাংলা ও ওড়িশা থেকে সব মারাঠা ঘাঁটি গুটিয়ে ফেলা হয়। এ ঘটনার পর বিহার ও ওড়িশা অঞ্চলে প্রায় ১৫ মাস শান্তি ও সমৃদ্ধি বিরাজ করে।

মীর হাবিবের কবল থেকে ওড়িশা পুনর্দখলের জন্য আলীবর্দী ১৭৪৬ সালের শেষের দিকে ওড়িশা অভিযান করেন। আলীবর্দীর সেনাপতি মীর জাফর মীর হাবিবের সেনাধ্যক্ষ সাইয়িদ নুরকে মেদিনীপুর শহরের কাছে একটি যুদ্ধে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করেন। এ অবস্থায় রঘুজি ভোঁসলের ছেলে জানোজি ভোঁসলে বালাশোরের দক্ষিণ দিক থেকে আগত মীর হাবিবের সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলিত হয়। এ সংবাদ পাওয়ামাত্রই মীরজাফর মেদিনীপুর ছেড়ে দিয়ে বর্ধমানে পালিয়ে যান। ১৭৪৭ সালের মার্চে এক যুদ্ধে আলীবর্দী জানোজিকে পরাজিত করেন। পরাজিত মারাঠা হানাদাররা মেদিনীপুরে পালিয়ে গেলে মুর্শিদাবাদ ও বর্ধমান মারাঠা হানাদারমুক্ত হয়। নবাব তাঁর রাজধানীতে ফিরে আসেন এবং বর্ষাকাল সেখানে কাটান। ১৭৪৮ সালের পুরো বছরটিতে মারাঠারা সম্পূর্ণ ওড়িশা ও মেদিনীপুর পর্যন্ত তাদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে। ১৭৪৯ সালের মার্চে আলীবর্দী ওড়িশা পুনর্দখলে যাত্রা করেন। কয়েকটি খন্ডযুদ্ধের পরই মারাঠারা পেছনে হটতে থাকে। ১৭৪৯ সালের জুনের মাঝামাঝি নবাব আলীবর্দী ওড়িশা পুনর্দখল করেন। কিন্তু ওড়িশা দখলের পর কটক থেকে ফিরে যাওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই মীর হাবিবের নেতৃত্বে মারাঠা বাহিনী আলীবর্দীর প্রতিনিধিকে পরাজিত ও বন্দি করে। বৃদ্ধ ও রণক্লান্ত আলীবর্দী ওড়িশা থেকে মারাঠাদের বাংলা গমনের পথ রোধ করতে মেদিনীপুরে ফিরে আসেন। ঘন ঘন মারাঠা হামলা বাংলাকে মহাবিপর্যয়ে নিপতিত করে। বাংলার জনগণের জন্য এটা এতই ধ্বংস আর দুঃখ বয়ে আনে যে মারাঠা বর্গিদের হামলার ভীতিকর গল্প বাংলার শিশুদের ঘুমপাড়ানি গানে বিশেষ স্থান অধিকার করে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর