দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ওপর নির্মিত অসাধারণ এক চলচ্চিত্র ‘দ্য লাস্ট ব্যাটেল’। হ্যারাল্ড জাওয়ার্ড এ ছবিটি পরিচালনা করেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ফ্রান্সের আল্পসে একটি ক্যাসেলে বন্দি করে রাখা হয়েছিল কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে। তাঁদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে চেয়েছিল নাৎসি বাহিনী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও সোভিয়েত ইউনিয়নের যৌথ বাহিনী এক শ্বাসরুদ্ধকর যুদ্ধ শুরু করে। লক্ষ্য ছিল মৃত্যুপ্রতীক্ষায় থাকা ব্যক্তিদের মুক্ত করা। হিটলারের মৃত্যু ও নাৎসি বাহিনীর আত্মসমর্পণের আগে এ যুদ্ধটা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ চলচ্চিত্রের মূল ভাবনা হলো, চূড়ান্তভাবে পরাজিত হওয়ার আগে শত্রুপক্ষ মরণকামড় দেয়। সব নীতিনৈতিকতা ভুলে যে-কোনো উপায়ে শেষ চেষ্টা করতে চায়। এটাই হলো দ্য লাস্ট ব্যাটেল। বর্তমানে বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি দেখে এ সিনেমাটার দৃশ্য বারবার সামনে চলে এলো।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি আছে প্রায় দেড় বছর। এর আগেই দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। সরকার উৎখাতের ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে। প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এখন ষড়যন্ত্রকারীরা বাসা বেঁধেছে। একের পর এক অঘটন ঘটানো হচ্ছে। লক্ষ্য একটাই- সরকারকে বিব্রত করা, বিতর্কিত করা। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা ‘আতঙ্ক রোগে’ ভুগছেন। আড়ালে আবডালে আওয়ামী লীগ নেতারা যেভাবে সরকারের সমালোচনা করছেন, তাতে বিরোধী দলের নেতারাও লজ্জায় মুখ লুকাবেন। রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগ প্রায় বন্ধুহীন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী শরিকরা আগে ফিসফাঁস করে সরকারের সমালোচনা করতেন। এখন করেন প্রকাশ্যে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী জোট ‘মহাজোট’কে আনুষ্ঠানিকভাবে মৃত ঘোষণা করা হয়েছে। একটা সময় ছিল, বুদ্ধিজীবীরা আওয়ামী লীগের প্রতি এক ধরনের নৈতিক সমর্থন জানাতেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ, সমতাভিত্তিক একটা সমাজ বিনির্মাণে মুক্তচিন্তার মানুষ আওয়ামী লীগের ওপরই ভরসা রাখত। কিন্তু এখন বুদ্ধিজীবীরাই আওয়ামী লীগের কঠিন সমালোচক। যাদের নানা স্বার্থ আছে। বিভিন্ন পদপদবির আশায় এরা প্রকাশ্যে সরকারের তোষামোদ করে। গোপনে এদের হতাশার দীর্ঘশ্বাস রীতিমতো ভূমিকম্প সৃষ্টি করে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও- এত দিন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় কেন? এ নিয়ে ভীষণ অস্থির কেউ কেউ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পুরোপুরি আওয়ামীবিরোধী প্ল্যাটফরমে পরিণত হয়েছে। কেউ যদি এসব কয়েক দিন দেখেন তাহলে তার মনে হবে সরকার বোধহয় যায় যায়। সরকারের ভিতর অযোগ্য লোকের ভিড়। এরা চুরি করা ছাড়া আর কোনো কাজ ঠিকঠাকমতো করতে পারে না। তাকিয়ে থাকে শেখ হাসিনার দিকে। আওয়ামী লীগ দল ও সরকারে শেখ হাসিনার অন্ধভক্তের সংখ্যা কাকের চেয়ে বেশি। কিন্তু শেখ হাসিনার একটা নির্দেশও তারা ঠিকঠাকমতো পালন করেন না। বরং প্রধানমন্ত্রী যা বলেন তার উল্টো করার একটা অশুভ প্রবণতা বাড়ছে। সবাই শুধু চান। নেতারা মন্ত্রী হতে চান। এমপি হতে চান। কর্মীরা পদ চান। আমলারা ক্ষমতা চান। অবসরের পর চান নতুন চাকরি। বুদ্ধিজীবীরা উপাচার্য হতে চান। পদক চান। যারা পান তারা থালাসুদ্ধ চেটেপুটে খান। যারা পান না তারা সরকারের সমালোচনায় মুখর হন।
ব্যতিক্রম শুধু দুই ধরনের মানুষ। সাধারণ মানুষ আর আওয়ামী লীগের তৃণমূল। সাধারণ মানুষের চাওয়ার গণ্ডিটা একেবারে সীমিত। ছোট্ট। তারা শান্তি চান। খেয়েপরে বাঁচতে চান। সন্তানকে লেখাপড়া করাতে চান। মাথা গোঁজার ঠাঁই চান। অসুস্থ হলে চিকিৎসা চান। এই সাধারণ মানুষ ভালো আছেন। গত ১৪ বছরে তাদের জীবনের উন্নতি হয়েছে। তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়েছে। গ্রামের গৃহহীন মানুষটা এখন নতুন ঘর পেয়েছে। তার ঘরের কোনায় লাউয়ের ডগায় সূর্যের আলো সোনালি আভা তৈরি করে। সে আভায় ওই মানুষটি নতুন স্বপ্ন দেখে। এ রকমই একজন রহিমা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহারের ঘর পেয়ে তিনি আত্মহারা। তার কাছে এ ঘরই স্বর্গ। রহিমার মেয়ে পুষ্পিতা। সে স্কুলে যায়। বিকাশে বৃত্তির টাকা আসে। আশ্রয়ণ প্রকল্পের কাছেই কমিউনিটি ক্লিনিক। রোগশোক হলেই সেখানে চলে যাওয়া যায়। এটা তো রহিমাদেরই। রহিমা, পুষ্পিতারা অনেক বড় স্বপ্ন দেখেন। পুষ্পিতা বড় হয়ে ডাক্তার হবে। এ রকম হাজারো গল্প বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে। গল্প নয়, সত্যি। বদলে যাওয়া এই বাংলাদেশ নেই আমাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। মূলধারার টেলিভিশনে, সংবাদপত্রে। শহুরে পরিপাটি মানুষের শোভিত ড্রয়িং রুমে এ সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে আর্তনাদ। আর টেলিভিশন টকশোয় সরকারের সমালোচনা শুনে উল্লাস। আওয়ামী লীগের পতন হলে কে কোথায় পালাবে তা নিয়ে উত্তেজক আলাপচারিতা। কিন্তু একজন মানুষ যখন শেখ হাসিনার উপহার দেওয়া নতুন ঘরের উঠোনে বসে চাঁদ দেখে তখন তার কাছে মনে হয়, কি অসাধারণ এই জীবন।অন্য একশ্রেণির মানুষের কোনো অভিযোগ নেই। তারা আওয়ামী লীগের তৃণমূল। বিশেষত বয়ঃপ্রবীণ কর্মীরা। কিংবা আওয়ামী লীগ করেন না কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিশ্বাস করেন। বাংলাদেশ নিয়ে গর্ব করেন। এঁরা ১৯৭৫ দেখেছেন। কি নির্মম বীভৎসতা তাঁদের চারপাশে হয়েছে তা দেখে এখনো শিউরে ওঠেন। এঁরা ২০০১ সাল দেখেছেন। দানবের উত্থানে কীভাবে সবকিছু তছনছ হয়ে গেছে চোখের সামনে। এখনো ভাবতে পারেন না। এ রকম মানুষ ভালো আছেন। শান্তিতে আছেন। তৃণমূলের এই মানুষদের চাওয়া-পাওয়া একটাই- দেশটা যেন ভালো থাকে।
টাঙ্গাইল থেকে মল্লিকদা আমাকে প্রতি শনিবার টেলিফোন করেন। ১৯৭১-এ কৈশোরে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। ’৭৫-এ বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নিতে প্রতিবাদ যুদ্ধ করেছেন। এখন আওয়ামী লীগ করেন না। বঙ্গবীরের দল করেন। কিন্তু তাঁর প্রতিটি কথা যেন একেকটা দর্শন। শনিবার সন্ধ্যায় ফোন করে বললেন, ‘শেখ হাসিনা ছাড়া বাংলাদেশ আফগানিস্তান হয়ে যাবে। তালেবানরা দেশ দখল করবে।’ বললেন, ‘দাদা, আওয়ামী লীগের সঙ্গে দয়া করে বিএনপির তুলনা করবেন না।’ অভাব-অনটনে থাকেন। শরীরে রোগশোক বাসা বেঁধেছে। তার পরও এই মানুষটি কি দৃঢ়ভাবে কথা বলেন। অবাক হয়ে যাই। প্রতিবার তাঁর ফোনের পর কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে ভাবী। আওয়ামী লীগের এক বর্ষীয়ান কর্মী সাদেক মোহাম্মদ। রাজশাহী থেকে ফোন করে বললেন, ‘আমাদের চাওয়া-পাওয়া একটাই- শেখ হাসিনা যেন বেঁচে থাকেন। আর কিছু চাই না।’ বাংলাদেশের প্রান্তজুড়ে এ রকম কোটি মানুষ। এরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। এ রক্তেভেজা দেশটার আসল মালিক তাঁরাই। কিন্তু চার দেয়ালে বন্দি শহুরে সুবিধাবাদী মানুষ তাদের আনন্দগুলো দেখে না। তাদের জীবনের আলোর পথযাত্রার খবর রাখে না। বদলে যাওয়া গ্রামের চিত্রকল্প চোখের সামনে ভেসে ওঠে না।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো সর্বশেষ জনশুমারিতে দেশের জনসংখ্যা হিসাব করেছে সাড়ে ১৬ কোটির কিছু বেশি। এর মধ্যে ১০ কোটি মানুষই এ রকম। কিংবা তার চেয়েও বেশি। এদের একমাত্র নেতার নাম শেখ হাসিনা। এসব মানুষের আস্থার জায়গা শেখ হাসিনা। এদের কাছে শেখ হাসিনাই দেবতা। যেমনটি বলছিলেন, চা-বাগানের শ্রমিকরা। এই বিভক্ত বাংলাদেশের মালিকানা কার কাছে যাবে, সেটাই এখন নির্ধারিত হবে। এটাই শেষ যুদ্ধ। দ্য লাস্ট ব্যাটেল। এ যুদ্ধে একদিকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আপামর সাধারণ মানুষ। ত্যাগী তৃণমূলের কিছু না পাওয়া কর্মী। অন্যদিকে আছে ক্ষমতার বাইরে এবং ক্ষমতায় থাকা সুবিধাবাদী চক্র। আল্পসের ক্যাসেল থেকে যেমন মৃত্যুর প্রহর গোনা মানুষগুলোকে মুক্ত করাই ছিল কঠিন চ্যালেঞ্জ। ঠিক তেমনি, শহুরে সুবিধাবাদীদের কাছ থেকে রাষ্ট্রের মালিকানা রহিমা, পুষ্পিতা কিংবা মল্লিকদাদের হাতে তুলে দেওয়াই এখন চ্যালেঞ্জ। এটাই মরণযুদ্ধ। এ যুদ্ধ অনেকটা স্কুইড গেমের মতো। মরো অথবা মারো। বিএনপি, সুশীল ও সুবিধাবাদীদের সব শক্তি ক্রমে একত্র হচ্ছে। সম্রাট অশোক যেমন কলিঙ্গ যুদ্ধের আগে সেখানকার নিরীহ মানুষকে গোপনে হত্যার পরিকল্পনা করেন। লুটপাট-অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে ভীতি ছড়িয়ে দেওয়ার কৌশল নেন। সে সময় অশোকের সেনাপতি বলেছিলেন, ‘এটা যুদ্ধের নীতিনৈতিকতাবিরুদ্ধ।’ জবাবে সম্রাট অশোক বলেছিলেন, ‘যুদ্ধের একটাই নীতি- জয়।’ সম্রাট অশোক এ মানবতাবিরোধী কৌশলের জন্য ‘চণ্ডাল অশোক’ উপাধি পেয়েছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন যেন আবার ‘চণ্ডাল অশোক’ নীতি ফিরে এসেছে। যে-কোনো উপায়ে শেখ হাসিনাকে (আওয়ামী লীগকে নয়) ক্ষমতাচ্যুত করতে হবে। এজন্য প্রয়োজনে পুলিশের ওপর চড়াও হয়। নিজেদের কর্মীদের মৃত্যুতে উল্লসিত হও। দেশের সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে বিদেশিদের কাছে নালিশ কর। এ যুদ্ধে যেন সব বৈধ। সাধারণ মানুষকে আক্রমণ। চালের বাজার সিন্ডিকেট। খোলাবাজার থেকে ডলার কিনে বাজার খালি করে দেওয়া। সব যেন একই সূত্রে গাঁথা।
বিএনপি বা সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলের কৌশল অবশ্য পরিষ্কার। যে-কোনো মূল্যে তারা শেখ হাসিনাকে হটাতে চায়। এজন্য লাশ চায়। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর হস্তক্ষেপ চায়। জঙ্গিবাদের উত্থান চায়। অর্থনৈতিক সংকট চায়। চেনা শত্রুর সঙ্গে লড়াই করা অনেক সহজ। এই যেমন এবার শারদীয় দুর্গোৎসব নির্বিঘ্নে ঘটে গেল। গতবারের মতো কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। প্রতিমা ভাঙচুর হয়নি। হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি ভাঙচুর হয়নি। অথচ এবারই পূজায় সবচেয়ে বেশি সহিংসতার শঙ্কা ছিল। একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা এ নিয়ে সতর্কবার্তাও দিয়েছিল। কিন্তু সতর্ক থাকার কারণে কোনো বিশ্রী ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু ঘরের ভিতর বন্ধুবেশী শত্রু যখন আপনার ক্ষতি করবে, তখন সামলাবেন কীভাবে? এই যেমন এক মাসের মধ্যে জাতীয় গ্রিডে দুবার বিপর্যয়। এটা স্রেফ দুর্ঘটনা, নাকি ষড়যন্ত্র? এ ঘটনার পর দেখলাম বিএনপি নেতা ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু আনন্দে আত্মহারা। তিনি বললেন, ‘সামনে আরও ব্ল্যাকআউট হবে।’ তিনি জ্যোতিষী, নাকি তাঁর কাছে আগাম খবর আছে। টুকু সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট আমলে হাজার কোটি টাকার খাম্বা কেনা হয়েছিল তাঁর নেতৃত্বে। এ খাম্বায় বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়েনি বটে, কিন্তু তারেক জিয়ার বন্ধুর পকেট ভারী হয়েছে। ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর নির্বাচনী এলাকায় তাঁর নানা প্রশংসা শোনা যায়। তাঁর নির্বাচনী এলাকায় লোকজন বলেন, ‘টুকু সাহেব প্রচুর লোককে চাকরি দিয়েছেন।’ এর বেশির ভাগই বিদ্যুৎ সেক্টরে। জাতীয় গ্রিডে ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর জমানায় নিয়োগপ্রাপ্ত বহু মানুষ নানা পদে কর্মরত আছেন। ৬ সেপ্টেম্বর প্রথমবার জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয় ঘটে। তখন দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অনেক জেলা প্রায় দেড় ঘণ্টা অন্ধকারে ছিল। সে সময় একজন প্রকৌশলী আমাকে বলছিলেন, জাতীয় গ্রিডে আরও বড় বিপর্যয় আসছে।
আমাদের বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীকে নিয়ে আমি আর কোনো কথা বলতে চাই না। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাই তাঁর সম্পদের যে বিপুল স্ফীতির কাহিনি শোনান তা রূপকথার গুপ্তধনকেও হার মানায়। ৪ অক্টোবর যখন গোটা দেশ অন্ধকারে চলে গেল, এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতি চলল ৪ ঘণ্টার বেশি সময়। তখন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী জনসংযোগ কর্মকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। কিন্তু এক মাসে দুবার জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয় কেন হলো, তার কারণ জানতে পারলেন না। চাণক্য বলেছিলেন, ‘অর্থলোভ ভয়ানক রোগ। একবার যে এর স্বাদ পায়, সে সহজে বিকোয়।’ সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশে রপ্তানি আয় কমেছে ৬.২৫ শতাংশ। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বললেই জানা যায়, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণে উৎপাদন বিঘ্নিত হচ্ছে মারাত্মকভাবে। অনেক কলকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী বারবার বলছেন উৎপাদন অব্যাহত রাখতে হবে। উৎপাদন বাড়াতে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে অনুশাসন জারি করা হয়েছে, শিল্পকারখানায় যেন নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ-গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়। এজন্য এলাকাভিত্তিক ছুটির রুটিনও করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা?
সেপ্টেম্বরে প্রবাসী আয়ও কমেছে। গত সাত মাসের মধ্যে প্রবাসী আয় ছিল সর্বনিম্ন। বিদেশের বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় প্রবাসীদের ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ না পাঠানোর প্রচারণা চলছে কয়েক মাস ধরে। সৌদি আরবে রীতিমতো সভা করে বলা হচ্ছে ব্যাংকে টাকা নেই। বৈধ পথে টাকা পাঠালে আপনার পরিজনরা টাকা পাবেন না। বিদেশে কঠোর পরিশ্রম করে টাকা উপার্জন করেন আমাদের শ্রমিক ভাইবোনেরা। তাঁরা এতে আতঙ্কিত হবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এর বিরুদ্ধে পাল্টা কূটনীতি কোথায়? পেশাদারি কূটনীতির নামে বিদেশে বসে চলে আরাম-আয়েশের উৎসব। বিদেশে বাংলাদেশের মিশনগুলো প্রবাসীদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে না, এ রকম অভিযোগ আমলে নেওয়ার কেউ নেই। কদিন আগে আওয়ামী লীগের এক তরুণ মেধাবী নেতার সঙ্গে কথা হচ্ছিল। আমরা একসঙ্গে দুপুরে খেলাম। ওই নেতা বলছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ অফিসে যাই। আওয়ামী লীগ সভাপতির কার্যালয়ে যাই। কর্মীদের সঙ্গে কথা বলি। বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা নেতাদের সঙ্গে কথা বলি। তারা সবাই নেগেটিভ কথা বলেন। আওয়ামী লীগের খারাপ দিকগুলো নিয়েই কথা বলেন।’ ওই নেতার কথার সূত্র ধরে আওয়ামী লীগের বেশ কজন নেতাকে জিজ্ঞাসা করলাম, আচ্ছা শেখ হাসিনার ১০টি উদ্যোগ কী? অবাক বিস্ময়ের ব্যাপার, কেউই এ ১০টি উদ্যোগ বলতে পারলেন না। প্রধানমন্ত্রী বারবার বলেছেন, ১৪ বছরে সরকারের অর্জনগুলো জনগণের কাছে তুলে ধরতে হবে। অথচ কজন নেতা এসব অর্জনের কথা বলতে পারবেন? ফেসবুকে আওয়ামী লীগ ব্যস্ত একে অন্যের বিরুদ্ধে কুৎসা রটানোয়।
বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সম্প্রতি বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগের কোমর ভেঙে গেছে।’ হাজারীবাগে বিএনপি সমাবেশ করতে যায়। ওই সমাবেশে উটকো ঝামেলা বাজাতে গিয়ে আওয়ামী লীগের অতি উৎসাহী কজন বেশ ধোলাই খান। এরপর বিএনপি নেতার ওই দম্ভোক্তি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেখানে বলেছিলেন, ‘বিরোধী দলের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে বাধা দেওয়া হবে না।’ তাঁর এ নির্দেশ লঙ্ঘন করে যারা (আওয়ামী লীগের কর্মী ও পুলিশ প্রশাসন) বিরোধী দলের ওপর বিনা উসকানিতে চড়াও হয়, তারা ষড়যন্ত্রকারী। ঘরের শত্রু বিভীষণ। এরাও দ্য লাস্ট ব্যাটেলে শত্রুপক্ষ।
প্রধানমন্ত্রী বারবার বলছেন, খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হবে। এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে। সারা বিশ্বে দুর্ভিক্ষের পদধ্বনির কথা শেখ হাসিনা এখন প্রায় প্রতিটি বক্তৃতায় বলছেন। তিনি যখন এসব কথা বলছেন, তখন সিন্ডিকেটের খপ্পরে চালের বাজার। কান পাতলেই শোনা যায়, সামনে চালের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির পাঁয়তারা চলছে। আমাদের খাদ্য মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয় কী করছে? কৃষিমন্ত্রী ব্যস্ত ডিম নিয়ে। আর খাদ্যমন্ত্রী মাঝেমধ্যে হুঙ্কার দেন। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত এখন রীতিমতো ধমক দিয়ে কথা বলছেন। তাঁদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে সুশীলরাও এখন মাঠে। বিএনপিকে দিয়ে ক্ষমতার হিসসা ইতোমধ্যে কবুল করিয়েছে দেশের সুশীলসমাজ। বিএনপি নেতারা বিদেশি আজ্ঞাবহ সুশীলদের খুশি করতে নতুন সংবিধান আর দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের কথা বলছেন। সবাই মিলে জোট করেছেন সাধারণ মানুষের অধিকারহরণের নতুন খেলায়। গরিবরা কেন ভালো থাকবে? গৃহহীনরা কেন ঘর পাবে? হতদরিদ্রের বাচ্চারা লেখাপড়া করার দুঃসাহস কোত্থেকে পেল! কমিউনিটি ক্লিনিক কেন থাকবে? এসবই হয়েছে শেখ হাসিনার জন্য। সম্প্রতি ওয়াশিংটন পোস্টে পেটুলা ডিভোরাক শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকারভিত্তিক একটি নিবন্ধে লিখেছেন, ‘এই নারী একটি শক্তির নাম।’ হ্যাঁ, তা-ই। তিনি দারিদ্র্যের শক্তি। তৃণমূলের শক্তি।
আর এ কারণেই শেখ হাসিনার ওপর গোসসা করেছে একটা বিশাল গোষ্ঠী। আমাদের প্রচলিত গণমাধ্যম কেবল তাদের কথাই বলে। কিন্তু দ্য লাস্ট ব্যাটেলে শেখ হাসিনার যোদ্ধা হলো তৃণমূল, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। আগামী নির্বাচন তাই বাংলাদেশের জন্যও শেষ যুদ্ধ। রাষ্ট্রের মালিকানার যুদ্ধ। এ যুদ্ধে শেখ হাসিনাকে লড়তে হবে ঘরের ও বাইরের শত্রুর সঙ্গে। নির্বাচন বানচাল করে সাধারণ মানুষের স্বপ্ন কি বন্দি হবে? শোভিত-পরিপাটি শহুরে মানুষের জয় হবে? নাকি গত ১৪ বছরের অর্জনগুলো পাবে পূর্ণতা? বাংলাদেশ জিতবে নাকি আবার অন্ধকার টানেলে প্রবেশ করবে? এ ফয়সালা হবে দ্য লাস্ট ব্যাটেলে। আপনি কার পক্ষে?
লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত