শনিবার, ৮ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০ টা

কৃষিবীমা ও চতুর্থ শিল্পবিপ্লব

শাইখ সিরাজ

কৃষিবীমা ও চতুর্থ শিল্পবিপ্লব

ষড়ঋতুর বাংলাদেশে ঋতুবৈচিত্র্য ঠিক আগের মতো নেই। ঘোর বর্ষা থাকার সময়ে থাকছে বৃষ্টিহীন। শীতও ঠিক নেই আগের মতো। গ্রীষ্মেও দেখা মেলে কুয়াশার। কয়েক বছর ধরে আবহাওয়া হয়ে উঠেছে অনিশ্চিত। আগে থেকে কিছুই বলা যাচ্ছে না। এটিই মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের বারতা। যার প্রকট প্রভাব পড়ছে আমাদের কৃষিতে। এ সময়টা আমাদের কৃষির পট পরিবর্তনের একটা সময়। শিল্পোদ্যোক্তারা আগ্রহী হয়ে উঠছেন কৃষিতে বিনিয়োগে। ফলে ক্রমেই প্রসারিত হচ্ছে প্রযুক্তিবহুল বাণিজ্যিক কৃষি। কিন্তু জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত প্রভাব অনিশ্চিত করে দিতে পারে অনেক কিছু। আজ (৬ আগস্ট, বৃহস্পতিবার) সকালেও নিউইয়র্ক টাইমসের জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত নিয়ে একটা প্রতিবেদন পড়ছিলাম। আশঙ্কা করা হচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়ার কোথাও কোথাও বর্ষা দীর্ঘায়িত হতে পারে, এ অঞ্চলে অনেকটা অনিশ্চিত আবহাওয়া বিরাজের কথাও বলা হয়েছে। তাই এ সময়ে কৃষিবীমার প্রয়োজনীয়তা আরও জোরেশোরে অনুভূত হচ্ছে।

দীর্ঘদিন ধরে আমি কৃষকের শস্যবীমার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বলে আসছি। যেহেতু আমার লেখা সাধারণ কৃষক পড়েন, তাই এখানে শস্যবীমার বিষয়টি সম্পর্কে একটু বলে নিতে চাই। আমাদের দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ লেগেই আছে। বন্যা, শিলাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, পোকামাকড়ের আক্রমণ, ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদি কারণে ফসলের ক্ষতি হয়। ফলে কৃষক ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হন। এ ধরনের আর্থিক ক্ষতি মোকাবিলায় যে বীমাপত্র গ্রহণ করা হয় তা-ই শস্যবীমা। শস্যবীমা করা থাকলে কোনো কারণে ক্ষতি হলে বীমাকারী প্রতিষ্ঠান আর্থিক সহায়তা দেয়। তবে এ ক্ষেত্রে স্বল্প বা দীর্ঘ মেয়াদে বীমার জন্য প্রিমিয়াম দিতে হয়। শস্যবীমার প্রচলন প্রথম জার্মানিতে শুরু হলেও পরে আমেরিকা, জাপান ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এর ব্যাপকতা লাভ করে। বর্তমানে প্রায় সব দেশেই শস্যবীমার প্রচলন আছে। ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’-এর বিশেষ আয়োজন ‘কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট’ অনুষ্ঠানের শুরু থেকে কৃষক কৃষিবীমার দাবি জানিয়ে আসছেন। বিশেষ করে যারা উচ্চমূল্যের ফলফসলের আবাদ করেন তারা খুব দৃঢ়ভাবেই কৃষিবীমার প্রত্যাশী ছিলেন। আমি বরাবরই জাতীয় বাজেট ঘোষণার প্রাক্কালে কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেটের সুপারিশমালা মাননীয় অর্থমন্ত্রীর হাতে তুলে দিই। সেখানে প্রতিবারই কৃষকের পক্ষ থেকে কৃষিবীমার দাবির উল্লেখ থাকে। মনে আছে, টাঙ্গাইলে অনুষ্ঠিত কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট অনুষ্ঠানে কিষানি মমতাজ বেগম প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনার গাড়িটার যদি বীমা হতে পারে তবে আমার গরুটার কেন বীমা হবে না?’ সেখানে কৃষিমন্ত্রী মহোদয়ও উপস্থিত ছিলেন।

আমি যত দূর জানি, ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো প্রচলিত শস্যবীমা চালু করে ‘সাধারণ বীমা করপোরেশন’। তবে খরচ বেশি হওয়ায় ১৯৯৬ সালে এটি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ২০১৪ সালে পাইলট প্রকল্প আকারে আবারও শস্যবীমা চালু করে সাধারণ বীমা করপোরেশন। আবহাওয়া সূচকভিত্তিক এ শস্যবীমা ছিল একটি নতুন সংযোজন। কিন্তু এ প্রকল্পের পাইলটিং পর্যায়টা ছিল দীর্ঘ। শস্যকৃষির বাইরে মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ খাতে বীমার জোরালো দাবি আছে খামারিদের।

মনে পড়ছে, ২০১৯ সালের ৫ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় কৃষকের জন্য কৃষিবীমা চালুর উদ্যোগের কথা জানিয়েছিলেন। রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে আন্তর্জাতিক ক্ষুদ্র বীমা সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বাংলাদেশে পড়তে যাচ্ছে। দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সাম্প্রতিক একটি সমীকরণ অনুযায়ী প্রাকৃতিক ঝুঁকিপূর্ণ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় যারা বসবাস করে, তাদের ক্ষতি কীভাবে মেটানো যায় এবং তাদের জীবন কীভাবে নিরাপদ করা যায়, সেজন্য তাদের বিশেষ বীমাব্যবস্থা করে দিলে তারা নিরাপদ থাকবে।’ প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর কৃষিবীমা চালুর উদ্যোগ নেয় সরকার। দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশ যেমন- ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, ভারত, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ডে সরকার কৃষিবীমার ওপর বিশেষ গুরুত্ব ও প্রাধান্য আরোপ করেছে। পাশের দেশ ভারতের সরকার কৃষিবীমার ওপর জোর দিয়ে নতুন নতুন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। ফসলের চাষ বীমার আওতায় আনতে চালু করা হয়েছে ‘প্রধানমন্ত্রী ফসল বীমা যোজনা’। খবরে জেনেছি, এ যোজনার অধীনে ৩.৫ কোটি কৃষকের বীমা করা হয়েছে এবং বীমার পরিমাণ ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। উর্বরতা রক্ষা করে একই জমিতে অধিক ফসল তোলার জন্য প্রায় সাড়ে ৭ কোটি সয়েল হেলথ কার্ড ইস্যু করা হয়েছে।

মাস দুয়েক আগে আমার ফিলিপাইন যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। কাজের প্রয়োজনে সেখানকার প্রত্যন্ত গ্রামেও গিয়েছি। ফিলিপাইনের ইলিকস নর্থ প্রদেশের পিদিমের আবুকাই গ্রামের লইতা, আরথুর, সান্তোসসহ বেশ কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে আমি কথা বলি। তারা আমাকে বলছিলেন, ফিলিপাইনের নিবন্ধিত কৃষকের শতভাগ রয়েছে কৃষিবীমার আওতায়। বীজ, সার থেকে শুরু করে সব কৃষি সহযোগিতা তারা সরকার থেকে পান। বিনিময়ে তারা নিয়মিত তাদের প্রিমিয়াম পরিশোধ করেন।

আমাদেরও উচিত হবে আমাদের কৃষকদের দ্রুত শস্যবীমাসহ কৃষিবীমার আওতায় আনা। প্রথমে হয়তো কৃষকদের প্রিমিয়াম দেওয়ায় অভ্যস্ত করে তুলতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারকে ভর্তুকি দিতে হতে পারে। তবে এর ভবিষ্যৎ নিঃসন্দেহে ফলপ্রসূ হবে। শুধু শস্যই নয়, কৃষির অন্যান্য উপখাত গবাদি প্রাণী ও মৎস্যকেও কৃষিবীমার আওতায় আনা প্রয়োজন। প্রাণিসম্পদের বীমার কথা বললে আগে বলা হতো গরু-ছাগলের স্বাস্থ্যের গ্যারান্টি কী? বীমাকৃত প্রাণীটি আদৌ সুস্থ কি না জানা যেত না। কিংবা পুকুরে পানির নিচে কী পরিমাণ মাছ আছে তা-ও জানা যেত না। কিন্তু এখন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এই সময়ে যন্ত্রই সব তথ্য দিয়ে দিচ্ছে। গরুর পেটে থাকা বোলাস সার্বক্ষণিক তথ্য পাঠাচ্ছে গরুর রোগবালাই থেকে শুরু করে কতটুকু খাবার খাচ্ছে, কী পরিমাণ বিশ্রাম নিচ্ছে সব তথ্য। পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকা হোক না কেন মুঠোফোনে মুহূর্তেই সব তথ্য জানা সম্ভব হচ্ছে। এত দিন আমাদের কাছে সব গরুকেই একরকম দেখতে মনে হলেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন যন্ত্র ঠিকই গরুর মুখে ক্যামেরা ফেলে আলাদাভাবে চিনে নিতে পারছে প্রতিটি গরু। যন্ত্রই বলে দিতে পারছে পুকুরের নিচে কীসংখ্যক মাছ আছে, তাদের আকার-আকৃতিই বা কী। ফলে তাদের কৃষিবীমার আওতায় নিয়ে আসা কঠিন নয়।

গত এপ্রিলে নেদারল্যান্ডসে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। সেখানে দেখেছি প্রযুক্তির কৃষির নান্দনিক বিকাশ। বিশাল একেকটা গ্রিনহাউস যেন একেকটা কৃষিপণ্যের কারখানা। মানুষের পাশাপাশি কাজ করছে রোবটও। সংখ্যার হিসাবে মানুষের চেয়ে রোবট বেশি। এ রকম একেকটা গ্রিনহাউসে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ। যেখানে বীমার সুবিধা না থাকলে কেউই হয়তো এত বেশি ঝুঁকি নিত না। উন্নত দেশগুলোর আদলে আমাদের দেশেও প্রযুক্তির কৃষিতে বিনিয়োগ শুরু হয়েছে। একে বিকশিত করতে কয়েকটি বীমা কোম্পানি এগিয়ে এসেছে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে একটা সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা জরুরি। এতে কৃষক বা উদ্যোক্তা ও বীমা কোম্পানি সবাই যেন সামঞ্জস্যপূর্ণ স্থানে অবস্থান করতে পারে। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের পাশে সরকারের বীমা প্রকল্প দ্রুত সম্প্রসারণ করা দরকার। আমার সৌভাগ্য, স্বাধীন বাংলাদেশের কৃষি, কৃষক ও কৃষিনির্ভর আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তনটা খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। আমি দেখেছি এ দেশের কৃষক কতটা ঘাতসহ, কতটা বৈরী অবস্থানে থেকেও খাদ্য উৎপাদনের নেশায় চাষে মগ্ন থেকেছে। পাওয়া-না পাওয়ার হিসাব তার কাছে বড় হয়ে ওঠেনি। কৃষক এগিয়েছে তার নিজগতিতে। সরকারের বিভিন্ন সহযোগিতা ছিল বটে, তবে কৃষকের অবদান এককভাবে সেখানে আরও অনেক বেশি জায়গাজুড়ে। সেই অন্তর্মুখী কৃষককে এখন দাঁড় করাতে হবে বিশ্বকৃষকের পাশে। সময় এখন বিশ্বায়নের। কৃষকের বাজার এখন পৃথিবীব্যাপী। এ সময় আমাদের কৃষককে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে না পারলে পিছিয়ে যাবে আমাদের কৃষি। পিছিয়ে যাব আমরা। আবার চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এই সময়ে আধুনিক প্রযুক্তির কৃষির সঙ্গে তাদের যেমন পরিচয় করিয়ে দিতে হবে, আমাদের শিল্পোদ্যোক্তাদের এ খাতে বিনিয়োগের সুযোগও তৈরি করে দিতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন সুপরিকল্পিত কৃষিবীমা নীতিমালা। সরকার এ বিষয়ে গুরুত্বের চোখ রাখবে- এমনটাই প্রত্যাশা।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব

[email protected]

সর্বশেষ খবর