ইসলাম, খ্রিস্টান ও ইহুদি ধর্মমতের উদ্ভব মধ্যপ্রাচ্যে। মনে করা হয়, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন ধর্মমত মানুষের আত্মিক জগতে যে প্রভাব বিস্তার করেছে তা অবিস্মরণীয়। বিশ্বের মানব গোষ্ঠীর অর্ধাংশের বেশি এ তিনটি ধর্মমতের অনুসারী।
ইহুদি ধর্ম : মনে করা হয়, একেশ্বরবাদ কেন্দ্র করে যে ধর্মীয় চেতনার বিকাশ ঘটেছে তার শুরু ইহুদি ধর্ম থেকে। এ ধর্মের মহাপুরুষরা সম্ভবত প্রথম প্রচার করেন ঈশ্বর এক, নিরাকার ঈশ্বর ধারণার প্রবর্তকও এ ধর্মমত।
মহাপুরুষ আব্রাহাম বা নবী ইবরাহিম (আ.) একেশ্বরবাদ প্রচার করেন। খ্রিস্টান ও মুসলমানরা তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। মুসলমানদের কাছে ইবরাহিম একজন নবী। তাঁকে বিশ্বাসীদের পিতা বলে তারা স্বীকার করেন। ইবরাহিম (আ.) বলতেন, আল্লাহ সর্বশক্তিমান। তাঁর কোনো চেহারা নেই। কাজেই মূর্তি বা প্রতিমা গড়ে তাঁর পুজো হতে পারে না। তিনি ইহুদিদের বলেন, তাঁর কথামতো চললে তিনি তাদের সুন্দর দেশে নিয়ে যাবেন। এ ধর্মের আরেক মহাপুরুষ মোজেস বা মুসা (আ.)। ইহুদিরা সৃষ্টিকর্তাকে ভুলে গেলে তাদের ওপর অভিশাপ নেমে আসে। তারা উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে। মুসা (আ.)-এর কথায় তারা আবার সুমতি ফিরে পায়। ফিরে আসে সঠিক পথে। আল্লাহ আবার সদয় হন ইহুদিদের ওপর। তাঁর নির্দেশে মুসা মিসর থেকে ইহুদিদের কানান বা আজকের প্যালেস্টাইন ভূখণ্ডে নিয়ে যান। ফেরেশতারা মুসাকে পথ দেখান। তাঁর মহিমায় সাগর দুই ভাগ হয়ে তাঁকে পথ করে দেয়।ইহুদিদের বিশ্বাস, আল্লাহ ইহুদিদের সৎপথে চলার জন্য ১০টি নির্দেশনা দেন। পাহাড়ের গায়ে বিদ্যুতের অক্ষরে সেগুলোকে মুসাকে দেওয়া হয়। ইবরাহিম থেকে মুসা পর্যন্ত ইহুদি ধর্মের মহাপুরুষরা মানুষকে সৎপথে চলতে উপদেশ দিয়েছেন। হিংসা-হানাহানি থেকে মুক্ত হয়ে সৎজীবন যাপনের পরামর্শ দিয়েছেন।।
খ্রিস্টধর্ম : খ্রিস্টধর্মের প্রবর্তক মহাপুরুষ যিশুখ্রিস্ট। মুসলমানদের কাছে যিনি ইসা (আ.) বলে পরিচিত। তিনি ছিলেন মেরি বা মরিয়াম নামে এক পবিত্র কুমারী নারীর সন্তান। খ্রিস্টান ও মুসলিমদের বিশ্বাস অনুসারে আল্লাহর অসীম কৃপায় পিতা ছাড়াই কুমারী মাতার গর্ভে ইসা জন্ম নেন। প্যালেস্টাইনের বেথলেহেম শহরে এই পবিত্র শিশুর জন্ম হয়। যিশুখ্রিস্ট একেশ্বরবাদের প্রচার চালান। তিনি মানুষকে ভালোবাসার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করেন। হিংসা বর্জনের শিক্ষা দেন। ঈসা (আ.)-এর ধর্মমত কায়েমি স্বার্থবাদীদের গাত্রদাহের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তারা ষড়যন্ত্র করে এই মহাপরুষের বিরুদ্ধে। ধর্মদ্রোহিতা ও রাজদ্রোহিতার অভিযোগ এনে তাঁর বিচার হয়। কথিত বিচারে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যার রায় দেওয়া হয়। খ্রিস্টানদের বিশ্বাস, যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করার আগে তিনি তাঁকে হত্যার জন্য যারা দায়ী তাদের ক্ষমা করে দেন। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে বলেন, ‘ঈশ্বর! ওরা তো জানে না কী ভুল করছে।’ যিশুখ্রিস্টের ভালোবাসার বাণী দ্রুত সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। মাত্র ৩৩ বছর বয়সে তিনি ক্রুশবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারালেও তাঁর শান্তি ও ভালোবাসার বাণী ছড়িয়ে পড়ে দেশ থেকে দেশান্তরে। মানব জাতিকে ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ করতে তাঁর শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মানুষ খ্রিস্টধর্মের অনুসারী বলে বিবেচিত।
ইসলাম ধর্ম : মধ্যপ্রাচ্যে উদ্ভাবিত অন্যতম প্রধান ধর্ম ইসলাম। মহাপুরুষ হজরত মুহাম্মদ (সা.) এ ধর্মের প্রবর্তক। আরবের মক্কা নগরীতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ইসা (আ.)-এর জন্মের ৫৭০ বছর পর আবির্ভূত এই মহাপুরুষ ইবরাহিম, মুসা ও ইসার (আ.) মতো একেশ্বরবাদের ধারণা সামনে তুলে ধরেন। ইহুদি ও খ্রিস্ট ধর্মের প্রবর্তকদের প্রতিও তিনি ছিলেন শ্রদ্ধাশীল। হজরত মুহাম্মদ (সা.) জন্মের আগেই তাঁর বাবাকে হারান। শিশু বয়সে হারান মাকে। শিশুবেলা থেকেই তিনি মানুষের কল্যাণের কথা ভাবতেন। হানাহানি ও ব্যভিচার তখন আরব সমাজকে কলুষিত করে তুলেছিল। তিনি সমাজে শান্তি ও সৌহার্দ্যরে পরিবেশ সৃষ্টিতে কিশোর বয়সেই তৎপর হয়ে ওঠেন। তিনি তাঁর একেশ্বরবাদী ধর্মীয় বিশ্বাস প্রচার করতে গিয়ে নানা প্রতিকূলতার শিকার হন। দৈহিকভাবেও তাঁকে অত্যাচারিত হতে হয়েছে। তার পরও তিনি ছিলেন ক্ষমা ও ভালোবাসার মূর্তপ্রতীক। ভিন্নধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে সহাবস্থানের নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। ভালোবাসা দিয়ে প্রতিপক্ষকে জয় করার নীতিতেও বিশ্বাসী ছিলেন এই মহাপুরুষ। পরধর্মের প্রতি হজরত মুহাম্মদ (সা.) কতটা সহনশীল ছিলেন তা তাঁর জীবনচরিতে স্পষ্ট। এই মহাপুরুষ তাঁর অনুসারীদের নির্দেশ দিয়েছেন তারা যেন অন্য ধর্মের উপাস্যদের সম্পর্কে কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া না দেখায়। ইসলামের মহানবী তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসা ভিন্নধর্মাবলম্বীদের উপাসনার জন্য মসজিদ ব্যবহারের সুযোগ দিয়েছেন।
মধ্যপ্রাচ্যে উদ্ভাবিত তিনটি ধর্মমতের মধ্যে পার্থক্য কম। তিনটি ধর্মমতই হজরত ইবরাহিম (আ.)-কে তাদের আদিপিতা মনে করে। খ্রিস্টানরা আদম থেকে শুরু করে মুসা পর্যন্ত ইহুদি ধর্মের সব মহাপুরুষের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। মুসলমানরা ইহুদি ও খ্রিস্ট ধর্মের প্রবর্তকদের আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ বা রসুল বলে শ্রদ্ধা করে। এ শ্রদ্ধার ব্যত্যয় হলে তাকে ধর্মচ্যুতও হতে হয়। তার পরও এ তিনটি ধর্মের বিরোধ আজ বিশ্বশান্তির জন্য বিড়ম্বনা সৃষ্টি করছে। সমগ্র মানব জাতির অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। ধর্মীয় শিক্ষা অগ্রাহ্য করে হিংসার বাতাবরণ সৃষ্টির ফলে বিশ্বজুড়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে মানুষ। ধার্মিকদের ঐক্যই এ থেকে শান্তির পথ দেখাতে পারে। ধর্মের নামে যে যুদ্ধবাজ ও মতলববাজরা অশান্তির উসকানি দিচ্ছে, তাদের কালো হাতকে ঠেকাতে সব ধর্মের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে।