বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের মুক্তিদূত মজলুম জননেতা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর কন্যা মনোয়ারা ভাসানী আবার বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। কয়েক মাস আগেও একবার ভর্তি হয়েছিলেন। তখন চমৎকার চিকিৎসা পেয়েছিলেন। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি বা হচ্ছে না। বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের বর্তমানে যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ডাক্তার, নার্স, কর্মচারী সবার আচার-ব্যবহারেও অনেকটা সহনশীলতা এসেছে। পয়ঃপরিষ্কারও অনেকটা ভালো। বৃহস্পতিবার সহধর্মিণীকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে গিয়েছিলাম। হুজুর মওলানা ভাসানীর মেয়ে মনোয়ারা ভাসানীকে দেখে সহধর্মিণী নাসরীন সিদ্দিকীর ইসিজি ও ইকো করিয়ে বাসায় ফিরেছি। ফিরতে ফিরতে বেগম সাহেবা বলছিলেন, এমনিতে সবকিছুই ভালো। কিন্তু পরীক্ষা-নিরীক্ষায় অসংখ্য মানুষ। রোগীর চাপ খুব বেশি। কত বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, তাদের বসবার কোনো ব্যবস্থা নেই। বসার জন্য যদি কয়েকটি চেয়ার থাকত তাহলে ভালো হতো। বেগম সাহেবার অনুভূতি আমার খুবই ভালো লেগেছে। মানুষের প্রতি ভালোবাসা, অন্যের কষ্ট উপলব্ধি করা এটাই তো মনুষ্যত্ব। বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ভিসি প্রফেসর ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ খুবই ভালো মানুষ। মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসা, মায়া-মমতায় ভরপুর। মানুষটি যদি প্রাণ খুলে কাজ করতে পারেন আমার বিশ্বাস আরও ভালো করতে পারবেন। দোয়া করি আল্লাহ যেন তাঁকে সেই শক্তি ও ধৈর্য প্রদান করেন।
দারুণ বিস্ময়কর ঘটনা গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচন বন্ধ করে দেওয়া। সরাসরি নির্বাচন কমিশন এভাবে আর কোনো দিন কোনো নির্বাচন বন্ধ করেনি। সাংবিধানিক নিয়ম অনুসারে সব নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। নির্বাচন কমিশন রিটার্নিং অফিসারের দ্বারা তার ক্ষমতা প্রয়োগ করে। নির্বাচন কমিশনের তেমন নিজস্ব লোকবল নেই। প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিয়েই তাদের চলতে হয়। এটা খুবই সত্য, যে-কোনো নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর তফসিল ঘোষিত এলাকার সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ নির্বাচন কমিশনের হাতে আপনাআপনি চলে আসে। আইন অনুসারে তফসিল ঘোষিত এলাকায় সরকারের ওপর সরকার নির্বাচন কমিশন। যে-কোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী নির্বাচন কমিশনের আদেশ-নির্দেশ মানতে বাধ্য। সে ক্ষেত্রে মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীরও কিছু করার নেই। তাদেরও সততার সঙ্গে নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা করতে হয়, সেটাই নিয়ম। কিছুদিন আগে নির্বাচন কমিশন সারা দেশের জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারদের ডেকেছিল। তাঁরা এসেছিলেন। আলোচনা হয়েছে। তবে কিছু হইহুল্লোড়ও হয়েছে, কিছুটা দোষারোপও হয়েছে। নির্বাচন কমিশন এখনই নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করেনি তাই তার এভাবে সবাইকে ডাকার সাংবিধানিক ক্ষমতা ছিল কি না, একটা প্রশ্ন অবশ্যই থেকেই যায়। নির্বাচন কমিশন সবাইকে ডেকেছে, তাঁরাও এসেছেন, কথা বলেছেন এটা ভালো কথা। কিন্তু ব্যাপারটা আইনসিদ্ধ কি না এ প্রশ্ন অনেকের। দেশে একটা শক্তিশালী দক্ষ-যোগ্য নির্বাচন কমিশন খুবই প্রয়োজন। এখানে নির্বাচন কমিশন তার ক্ষমতা দেখাবে অথবা সরকার সরকারের ক্ষমতা দেখাবে এসব কোনোমতেই মেনে নেওয়া যায় না। গাইবান্ধার উপনির্বাচনে বুথে বুথে সিসি ক্যামেরা; ব্যাপারটা আইনসিদ্ধ কি না স্পষ্ট নয়। কারণ ভোট সরাসরি কারও চোখের সামনে হওয়ার কথা নয়, ভোট গোপন। ভোটদানের গোপনীয়তা রক্ষা করা সাংবিধানিক দায়িত্ব। বুথগুলো সিসি ক্যামেরার আওতায় আনায় ভোটারের গোপনীয়তা ক্ষুন্ন হয়েছে কি না দেখতে হবে। সিসি ক্যামেরা লাগিয়ে ভোট কেন্দ্রের অবস্থা পর্যবেক্ষণ এক কথা আর ভোটারের গোপনীয়তা রক্ষা আরেক কথা। ভোটারের ভোটদানের গোপনীয়তা রক্ষা করে সিসি ক্যামেরা লাগানো হলে অবশ্যই প্রশংসার যোগ্য। কিন্তু যদি গোপনীয়তা নষ্ট হয়ে থাকে তাহলে সেটা খুবই নিন্দনীয়। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয়নি। তার পরও যদি আওয়ামী লীগের জেতার জন্য শক্তি প্রয়োগ করতে হয় তাহলে সত্যিকার অর্থেই জাতীয় নির্বাচনে কী হবে? ৩০০ আসনের ২৯২ এবং ৫০ নারী আসনের ৪৯ জনই সরকারি দল অথবা ‘সরকারি বিরোধী দল’ মিলেঝিলে দখলে রাখার পরও একটি উপনির্বাচনে জোর-জুলুমের কী আছে? এতে সরকারের বিশ্বস্ততা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে অবাধ নিরপেক্ষ ভোট হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই- বিরোধীদের সেই কথাই তো সত্য বলে মনে হচ্ছে। সেটাই তো বেশি করে ফুটে ওঠে। সব খাওয়ার প্রবণতা ভালো নয়। সব খাওয়ার প্রবণতা বা সব গেলার প্রবণতা ধ্বংস ডেকে আনে। গাইবান্ধা নির্বাচন কোনো শুভ ইঙ্গিত বহন করবে না। যে যা-ই বলুন, গাইবান্ধা-৫ উপনির্বাচনটি একটি খারাপ নজির হয়ে থাকল।
কেন যেন সহমর্মিতা, সমবেদনা, অন্যের ব্যথায় ব্যথিত হওয়া ধীরে ধীরে দিনে দিনে হারিয়ে যেতে বসেছে। শুক্রবার নামাজের আগে আল কাওসার, ইমতিয়াজ হোসেন, ইউসুফ জামিল, আলমগীর হোসেন এ চারটি তরতাজা তরুণ এসেছিল সরকারি চাকরির বয়সসীমা ৩৫ বছর করার দাবি নিয়ে। আমার এলাকার একটি মেধাবী মেয়ে ইলা আক্তার সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫-এর দাবির কথা আগেই বুঝিয়েছিল। তাই বিষয়টি আগে থেকেই আমার জানা ছিল। পৃথিবীর বহু দেশে চাকরিতে প্রবেশের কোনো বয়সসীমার বাধ্যবাধকতা নেই। স্বাস্থ্য-গতর ভালো থাকলে যে-কোনো বয়সের লোকজন সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করতে পারে। ভারত আমাদের নিকট প্রতিবেশী। সব ক্ষেত্রে সব বিষয়েই উপমা দিতে গিয়ে আমরা ভারতকে সামনে আনি। সেই ভারতেও চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৪০ বছর। হ্যাঁ, পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের একটা মিল আছে। শত্রুরাষ্ট্র পাকিস্তানকে এ ক্ষেত্রে আমরা অনুসরণ করে চলেছি। ১৯৯০ সালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে যখন ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল তখন তাঁর অনেক কাজকর্ম বাতিল করা হয়েছিল। অনেক ভালো সিদ্ধান্তও বাতিল করা হয়েছিল। উপজেলা পদ্ধতি উঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। উপজেলার যে জমিজমার দাম ছিল লাখ টাকা কাঠা, উপজেলা উঠে যাওয়ায় সেই লাখ টাকার জমি ২-৩ হাজার টাকায় নেমে এসেছিল। আবার উপজেলা পদ্ধতি চালু হলে দুই-আড়াই হাজার টাকার জমিজমা দুই-আড়াই লাখে উঠে গিয়েছিল। পাকিস্তান আমাদের শত্রু, রক্ত দিয়ে পাকিস্তানের হাত থেকে আমরা মুক্ত হয়েছি, সেই পাকিস্তানের চাকরিতে বয়সসীমার পেছনে পড়ে থাকা কোনো কাজের কথা নয়।
সারা বিশ্বের মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে, কর্মক্ষমতা বেড়েছে। কিন্তু সরকারি চাকরিতে যোগদানের বয়সসীমা বাড়েনি। লাখ লাখ শিক্ষিত বেকার তার মধ্যে উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যাও ফেলার মতো নয়। কিন্তু এসবের কোনো প্রতিকার নেই। করোনায় ছেলেমেয়েদের জীবন থেকে প্রায় তিন বছর চলে গেছে। তা কোনো বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় দায়সারা একটি ঘোষণা দিয়েছে। তাদের ঘোষণায় ৩৯ মাসের করোনাকাল বাদ দিয়েছে। এতে প্রথম অবস্থায় সবাই খুশি হয়েছিল। কিন্তু পরীক্ষা-নিরীক্ষা হিসাব-নিকাশ করে দেখা যায় আদতে ছাত্রছাত্রীদের সুবিধা হবে মাত্র আট-নয় মাস। তা-ও আবার বিসিএসে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়নি। গরিব মা-বাবা রক্ত পানি করে যেসব সন্তানকে পড়ান তারা শিক্ষা শেষে সরকারি চাকরিতে যোগ দিতে যে পরীক্ষা দেয় সেখানেও মস্তবড় শুভঙ্করের ফাঁকি। সাধারণত শুক্রবার সরকারি চাকরির পরীক্ষা হয়। একই দিন একই সঙ্গে ২০-৩০ বা তারও বেশি চাকরির পরীক্ষা হয়। একজন প্রার্থী হয়তো পাঁচ-সাতটা বিভাগে আবেদন করেছে। কিন্তু সে সকাল-বিকাল একটি বা দুটির বেশি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারে না। সরকারি চাকরিতে অংশগ্রহণের আবেদন ফিও এক মস্ত জ্বালা। ৫-১০ টাকা আবেদন ফি হলে যেখানে গরিবের ছেলেমেয়েরা অংশ নিতে পারে সেখানে আবেদন ফি হাজার টাকা, ২ হাজার টাকা! ৫০০-৭০০-এর নিচে কোনো কথাই নেই। এটা গরিবের ওপর জুলুম ছাড়া আর কী? সেদিন শুক্রবার প্রেস ক্লাবের সামনে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র পরিষদের নেত্রী এ এস বি সোনিয়া চৌধুরীর অনশনের কথা শুনে গিয়েছিলাম। গেটের সামনে একেবারে নোংরা জায়গায় পলিথিন বিছিয়ে একটি মেয়ে পড়ে আছে। আমি যখন গিয়েছিলাম তখন মনে হয় ২৪-২৫ ঘণ্টা হয়ে গিয়েছিল। মেয়েটি পানিও মুখে নেয়নি। ৩০-৪০ ঘণ্টা পানি পান না করলে কিডনি নষ্ট হয়ে যায়। বলতে গেলে অনশনের গুরু ভারতপিতা মহাত্মা গান্ধী বহুবার অনশন করেছেন, মজলুম জননেতা আবদুল হামিদ খান ভাসানী করেছেন। তাঁদের লেখালেখি পড়েছি, মন্তব্য-বক্তব্যে শুনেছি, অনশনে একটু একটু পানি পান না করলে কিডনির মারাত্মক ক্ষতি হয়। বলে এসেছি, ওই রকম নোংরা পরিবেশে অনশনে থাকার কোনো মানে হয় না। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে একমত হয়ে তাদের দাবি সমর্থন করে এসেছি। ৩৫ বছর কেন ৪০ বছরে চাকরিতে প্রবেশ করলেও তো কোনো দোষের কথা নয়। লেখাপড়ায় সেশনজটের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে অনেকে তো সময়ই পায় না। শিক্ষাজটে তাদের সরকারি চাকরিতে যোগদানের বয়স শেষ হয়ে যায়। তা ছাড়া কোনো মেধাবী ছাত্রছাত্রী সরকারি-বেসরকারি কোনো প্রজেক্টে দু-চার বছর কাজ করলে প্রজেক্টের কাজ শেষ হয়ে গেলে সে আর সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করতে পারে না। প্রজেক্টের কর্মকাল গ্রেস দেওয়া হয় না। তাই বয়সসীমা পেরিয়ে যায়। এও একটা অন্যায়, এও একটা জুলুম। এমনি করে নানা সমস্যা আন্তরিকতার সঙ্গে সমাধান করা দরকার। কিন্তু সেই মনমানসিকতা কারও নেই। পিতৃমাতৃ ¯ন্ডেœহে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে আচরণ করা উচিত। তা কে করবে? সবার তিরিক্ষি মেজাজ। কেউ ভালোবাসার দৃষ্টি নিয়ে, দরদ নিয়ে কারও দিকে তাকায় না। এভাবে আর যা-ই হোক একটা দেশ, একটা সমাজ চলতে পারে না। তাই সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩৫ কেন ৪০ হলেও আমার সমর্থন থাকবে। অনুরোধ করব, এ এস বি সোনিয়া চৌধুরী অনশন প্রত্যাহার করে অবস্থান কর্মসূচি বা দীর্ঘমেয়াদি অন্য কোনো কর্মসূচিতে গেলে সেটাই যুক্তিযুক্ত হবে। এই পা-ববর্জিত দেশে অনশন করে একটা অমূল্য জীবন ধ্বংস করার কোনো মানে হয় না। আমি যখন বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র পরিষদের অনশনস্থলে ছিলাম পাশেই বাংলাদেশ শ্রমিক অধিকার পরিষদ সর্বনিম্ন বেতন ২৫ হাজার টাকার দাবিতে অবস্থান করছিল। মাইক লাগিয়ে বক্তৃতা হচ্ছিল। সে অনুষ্ঠানে বর্তমান যুবসমাজের খুবই প্রিয় মুখ, সাহসী পুরুষ নুরুল হক নূর গিয়েছিলেন। শ্রমিক অধিকার পরিষদের অনুষ্ঠানেও দুই কথা বলেছি। বলেছি, বর্তমানের দুর্মূল্যের বাজারে একটা পরিবার ২৫ হাজার কেন ৫০ হাজারেও ভালোভাবে চলতে পারে না। তাই শ্রমিকদের এই ন্যায্য দাবি আমি সর্বান্তঃকরণে সমর্থন করি। জানি না শ্রমিকরা তাদের আন্দোলন শেষ করেছেন কি না। তবে অনশনরত সোনিয়ার শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে যাওয়ায় তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। তারা সোনিয়ার অনশন ভেঙে সুচিকিৎসা দিয়ে বাড়ি পাঠিয়েছে। এটা সত্যি খুবই আশার কথা। এভাবে আর কত দিন? যত তাড়াতাড়ি মানুষের এই ছোট ছোট দাবিগুলো নিরসন করা যাবে ততই মঙ্গল।
লেখক : রাজনীতিক
www.ksjleague.com