সোমবার, ২৪ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০ টা

স্বৈরাচারবিরোধী যুদ্ধে শেখ মণি অকুতোভয় সেনানি

নূরে আলম সিদ্দিকী

স্বৈরাচারবিরোধী যুদ্ধে শেখ মণি অকুতোভয় সেনানি

যুব ও ছাত্ররাজনীতির এক বিস্ময়কর নাম শেখ ফজলুল হক মণি। বাংলা সাহিত্যের ছাত্র শেখ ফজলুল হক মণি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নেতৃত্বের দায়িত্ব পালন করেন ১৯৬০ সাল থেকে। ১৯৬২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে আইয়ুব খানের দোসর ও কুখ্যাত সহযোগী হিসেবে পরিচিত মোনায়েম খানকে সমাবর্তনের প্রধান চরিত্র বা সমাবর্তন বক্তা হিসেবে উপস্থিত থাকতে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তদানীন্তন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। শেখ ফজলুল হক মণি ওই সমাবর্তন অনুষ্ঠানকে ভন্ডুল করার ক্ষেত্রে প্রচন্ড সাহসী ভূমিকা পালন করেন। ফলে তাঁর বাংলা সাহিত্যের স্নাতকোত্তর ডিগ্রি এবং তাঁর অত্যন্ত প্রিয়ভাজন বন্ধু ছাত্রলীগের তেজস্বী নেতা আসমত আলী শিকদারের পাস করা ডিগ্রি গায়ের জোরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিনিয়ে নেয়, তদানীন্তন গভর্নর মোনায়েম খানের প্রত্যক্ষ নির্দেশে। এ নিয়ে তুমুল ছাত্র আন্দোলন গড়ে ওঠে। যে আন্দোলনের মুখে আইয়ুব শাহী নতি স্বীকার করে এবং শেখ ফজলুল হক মণি ও আসমত আলী শিকদারের ডিগ্রি ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়। মণি ভাই ছিলেন ছিপছিপে গড়নের এবং খিটখিটে মেজাজের। হঠাৎ রেগে যাওয়ার অভ্যাস ছিল তাঁর এবং কেউ যদি এই রাগটাকে হজম করে টিকে থাকতে পারত এবং যুক্তিতর্ক সাহসের সঙ্গে তাঁর সামনে উত্থাপন করতে পারত, তাহলে নিমেষেই শেখ ফজলুল হক মণি গলে জল হয়ে যেতেন। সময় সময় তার বিরুদ্ধ মত প্রকাশকারীকেও বুকে জড়িয়ে ধরতেন। এমন একটি অদ্ভুত মানবিক গুণ ছিল মণি ভাইয়ের।

মণি ভাইকে আমি প্রথম দেখি ১৯৬৩ সালের ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে। ৫ ডিসেম্বরে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বৈরুতে ইন্তেকালের পর তাঁর লাশ ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। পুরাতন তেজগাঁও বিমানবন্দরে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর লাশবাহী উড়োজাহাজটি অবতরণ করে। তখন এটি একটি জাঁকজমকপূর্ণ এয়ারপোর্ট ছিল। তখনকার ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ জালালউদ্দিন সাহেব সাংঘাতিকভাবে মোনায়েম খানকে পছন্দ করতেন এবং তার অনুসারী ছিলেন। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ওপর তাঁর ব্যক্তিগত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা ছিল প্রগাঢ়। তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ওপর খুবই দুর্বল ছিলেন। তাই ঢাকা কলেজ থেকে একটা বিরাট মিছিল সোহরাওয়ার্দীর লাশ গ্রহণ করার জন্য তেজগাঁও বিমানবন্দরে উপস্থিত হতে প্রত্যক্ষভাবে তিনি অনুপ্রেরণা ও উৎসাহ জুগিয়েছিলেন।

সে যাই হোক, ওই বিশাল মিছিলটিকে মূল মিছিলের সঙ্গে সম্পৃক্ত বা সংযুক্ত করার জন্য শেখ ফজলুল হক মণি মুখে একটা বাঁশি দিয়ে ফুঁ দিচ্ছিলেন এবং সবাইকে যথাযথ শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে এবং সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াতে নির্দেশ দিচ্ছিলেন। তিনি বকাবকি করছিলেন, রাগারাগি করছিলেন, খুব জোরে জোরে চিৎকার করছিলেন। তাতে বোঝা গেল, তিনি অত্যন্ত রাগী মানুষ। ওখানে ওইটুকু পরিচয়ের পর তাঁর সঙ্গে আমার সরাসরি পরিচয় করিয়ে দেন ছাত্রলীগের তৎকালীন কোষাধ্যক্ষ শেখ শহিদুল হক মুন্সি। তারপর থেকেই মণি ভাইয়ের প্রতি দিনে দিনে ক্ষণে ক্ষণে আমার গভীর ভালোবাসা, সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হতে থাকে। সমুদ্রের ওপর তিলে তিলে পলি দিয়ে গড়ে ওঠা দ্বীপের মতো আমার অন্তরের একটা বিস্তীর্ণ অঞ্চল মণি ভাই আমার অজান্তেই দখল করে নেন। এই মণি ভাইয়ের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা নিবিড় থেকে নিবিড়তর হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের দীর্ঘ সাড়ে তিন বছরের কারাজীবনে ১৯ মাস ছিলাম আমি পুরনো বিশে, দেওয়ানির কাছাকাছি। যে দেওয়ানিতে আমার স্বপ্নের সিংহপুরুষ বাংলার অবিসংবাদিত নেতা মুজিব ভাই থাকতেন। সেই ১৯৬৬ থেকে ৬৭ সালের শেষ অবধি যখন তাঁকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি করে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়, তার আগ পর্যন্ত আমি, খুলনার ছাত্রনেতা কামরুজ্জামান টুকু, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব চিত্তরঞ্জন সুতার, কখনো কখনো নুরুল ইসলাম ভাই (যাকে আওয়ামী লীগের পোস্টার নুরুল ইসলাম হিসেবেই সবাই জানেন), আমরা পুরনো বিশে থাকতাম। সেখান থেকে মুজিব ভাইর সঙ্গে সারা দিন একত্রে থাকার সৌভাগ্য আমাদের হয়েছিল। মুজিব ভাইকে ষড়যন্ত্র মামলার আসামি করে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে গেলে আমাদের তখনকার সম্মিলিত ওয়ার্ড এক/দুই খাতায় (জেলখানার ভাষায়) স্থানান্তরিত করা হয়। উল্লেখ্য, তখন দেশরক্ষা আইনে মুজিব ভাইসহ আমরা পূর্ব পাকিস্তানের ৭৩ জন কারারুদ্ধ ছিলাম। এই এক/দুই খাতায় প্রায় ৩৭ জনের মতো বন্দি আমরা অবস্থান করতাম। ছাত্রদের মধ্যে শেখ ফজলুল হক মণি, ছাত্র ইউনিয়নের রেজা, শফি আহমেদ, পঙ্কজ ভট্টাচার্য; ছাত্রলীগের মণি ভাইসহ আবদুর রাজ্জাক, আল মুজাহিদী, কাজী ফিরোজ, এম এ রেজা, সাইফুদ্দিন, মফিজুর রহমান এবং কিছুদিনের জন্য খন্ড খন্ড সময়ে সৈয়দ মাযহারুল হক বাকী এবং ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী কারাগারে যেতেন। জেলখানায় অল্পসময়ের জন্য গিয়ে আবার জেল থেকে বেরিয়ে এসে তারা আবার জেলে যেতেন। যারা অল্প সময়ের জন্য কারাগারে যেতেন, আবার বেরিয়ে যেতেন, তাদের ঠাট্টা করে বি ক্লাস বলা হতো। মুজিব ভাইসহ আমরা সবাই ছাত্রলীগের এই দুই বিশাল নেতাকে ঠাট্টা করে বি ক্লাস বলতাম।

আমাকে যখন এক/দুই খাতায় অ্যাসোসিয়েশন ওয়ার্ডে স্থানান্তরিত করা হয়, তখন সৌভাগ্যক্রমে আমার চৌকিটি ঠিক মণি ভাইয়ের চৌকির পাশেই দুই হাত দূরত্বে রাখা হয়। মণি ভাইয়ের চৌকিটি ছিল একদম কর্নারে। আমারটি ছিল ঠিক তার পাশে। দরজা নাই, ছোট্ট একটা পার্টিশন ছিল। আল মুজাহিদী, কাজী ফিরোজ, এম এ রেজা এবং অল্প কিছুদিনের জন্য জগন্নাথ কলেজের সাইফুদ্দিন ছিলেন। পরে অসুস্থ হয়ে তিনি হাসপাতালে স্থানান্তরিত হন। মণি ভাই আর আমার খাটটি পাশাপাশি হওয়ার কারণে, মণি ভাইয়ের প্রতি আমার অন্তরের আকর্ষণ ও তাঁর প্রগাঢ় দেশপ্রেমের প্রতি আমার ভক্তি-শ্রদ্ধা ক্রমেই বাড়তে থাকে। সৌভাগ্যক্রমে মণি ভাইও আমার প্রতি আন্তরিকভাবে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। বিশেষ করে লেখাপড়ার প্রতি আমার আগ্রহ তাকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করে। তিনি বাংলায় এমএ ছিলেন। বাংলার প্রতি আমার অনুরাগ ও নিষ্ঠা অত্যন্ত প্রগাঢ় ছিল। আমি যখন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে যাই, তখন রাষ্ট্রবিজ্ঞানে প্রথম পার্ট আমি মুক্ত অবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উত্তীর্ণ হই। জেলখানায় বসে আমি সেকেন্ড পার্ট পরীক্ষা দিই। মণি ভাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র না হলেও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক লেখাপড়ায় তিনি প্রচন্ড আগ্রহ প্রকাশ করতেন। অনেক সময় আমার সঙ্গে আলোচনা করতেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিভিন্ন টপিক নিয়ে।

সে যাই হোক। আমি ওখানে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরীক্ষা যখন দিই, তখন ব্যক্তিগত পর্যায়ে তিনি আমাকে উৎসাহ ও উদ্দীপনা জুগিয়েছেন, আমাকে অনুপ্রাণিত করেছেন। আমাদের মধ্যে আমি, আল মুজাহিদী ও ময়মনসিংহের ন্যাপ নেতা অজয় রায় ছাত্র ছিলাম। আমরা পরীক্ষা দিতাম, মণি ভাই শিক্ষকের মতো ঘুরে ঘুরে আমাদের পড়াশোনার আগ্রহ ও একাগ্রতা লক্ষ্য করতেন এবং আমাদের প্রচন্ডভাবে উৎসাহ দিতেন। মণি ভাই তার হবু পত্নী, যিনি সৌভাগ্যক্রমে তাঁর আপন খালাতো বোন ছিলেন, সেই আরজু ভাবির সঙ্গে গভীর সম্পর্কে যুক্ত ছিলেন। জেলখানা থেকে অত্যন্ত রোমান্টিক ভাষায় সাহিত্যের অনুপ্রেরণায় তিনি আরজু ভাবিকে চিঠি লিখতেন। সেখানে তার গভীর প্রেম ও রোমান্টিক হৃদয়ের প্রতিচ্ছবি প্রতিফলিত হতো। তিনি আমাকে চিঠিগুলো অনায়াসে পড়ে শোনাতেন এবং কৌতুক করে আমাকে তাঁর ভায়রা হওয়ার জন্য অনুরোধ করতেন। তার এক শ্যালিকার সঙ্গে আমার বিয়ে দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করতেন। এটি জেলখানায় আমার অন্য সহকর্মীদের মনে প্রচন্ড ঈর্ষা সৃষ্টি করত।

মণি ভাই যখন কৌতুক করে বলতেন, তুই আমার ভায়রা হবি? অনেকেই তখন অস্পষ্টভাবে উচ্চারণ করতেন, মণি ভাই কি শুধু আলম ভাইকেই দেখে, আমাদের দেখে না? সেটি একটি বিরাট মজা ও কৌতূহলের বিষয় ছিল। যাই হোক, সেই ফজলুল হক মণি ছাত্রলীগের কিংবদন্তি নেতা, কারাগার থেকে বেরিয়ে আসার পর কীভাবে যেন একটা কোটারির সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেন। শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক এবং তোফায়েল আহমেদ সেই কোটারির অন্তর্ভুক্ত ছিলেন বলে তখনকার ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে সর্বজ্ঞাত জনশ্রুতি ছিল।

কারাগার থেকে বেরিয়ে আসার পর ছাত্রলীগের বিশাল গণতন্ত্র অনুরাগী অংশটি আমাকে ছাত্রলীগের সভাপতি প্রার্থী করে। ছাত্রলীগের বিভিন্ন জেলার নেতা-কর্মীর অকুণ্ঠ সমর্থন থাকা সত্ত্বেও আমি ছাত্রলীগের ওই কোটারির সমর্থন থেকে বঞ্চিত হওয়ায় সেবারের কাউন্সিলে সভাপতি পদ লাভ করতে পারিনি। তাতে অবশ্য ভালোই হয়েছে। পরবর্তীতে আমি ছাত্রলীগের সভাপতি হলাম এবং ঘটনাপ্রবাহে ১৯৭০-এর নির্বাচন ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রলীগ সভাপতি এবং স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক হিসেবে অংশগ্রহণ ও দায়িত্ব পালনের অনিরুদ্ধ ও অবারিত সুযোগ পেলাম। আমি অস্বীকার করব না, সেই উত্তাল গণআন্দোলনের অনন্ত প্রবাহের প্রতিটি মহালগ্নে, প্রতিটি কর্মযজ্ঞে, প্রতিটি ঐতিহাসিক সভায় মণি ভাইয়ের হৃদয়নিঃসৃত প্রেরণা আমাকে উৎসাহিত করেছে, উদ্বুদ্ধ করেছে, উদ্বেলিত করেছে। এখানে একটি কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ছয় দফা আন্দোলনকে গণআন্দোলনে রূপান্তরিত করার লক্ষ্যে ৭ জুন বাংলাদেশজুড়ে হরতাল আহ্বান করে আওয়ামী লীগ। ছাত্রলীগ সেই হরতালকে পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করে। মণি ভাই সেই উপলক্ষে এফ এইচ হলে অবস্থান গ্রহণ করেন এবং আমাকে তেজগাঁও এলাকার শ্রমিকদের সংগঠিত করে আন্দোলনকে ফলপ্রসূ করার জন্য নিয়োগ করেন। তখনো আওয়ামী লীগের পক্ষে শ্রমিক লীগের জন্ম হয়নি, কোনো শ্রমিক সংগঠন গড়ে ওঠেনি। ওখানে রুহুল আমিন নামে নোয়াখালীর এক ভদ্রলোকের সঙ্গে মণি ভাইয়ের একটা সাময়িক সমঝোতা হয়। রুহুল আমিন সাহেব মণি ভাইকে প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন, ৭ জুনের হরতাল তেজগাঁওয়ে সংগঠিত করার জন্য তিনি সর্বাত্মক সমর্থন করবেন। তার সমর্থনে মণি ভাই আমাকে এবং খুলনার কামরুজ্জামান টুকুকে তেজগাঁও এলাকার হরতালকে সফল করার জন্য নিয়োজিত করেন।

আমি আগের দিন রাতে তেজগাঁও পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে রহমত আলী সাহেবের সঙ্গে অবস্থান করি এবং প্রায় সারা রাত শ্রমিকদের একেকটা মেসে গিয়ে তাদের কাছে সমর্থন চেয়ে কথা বলি। পর দিন সকালে, সত্যি বলতে কী, হরতালের তেমন কোনো সুস্পষ্ট চিহ্ন অবলোকন করতে পারলাম না। অল্প কয়েকজন শ্রমিক কোহিনূর কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের ওখানে জটলা করছিল। আমি ও কামরুজ্জামান টুকু সাহেব এবং ফিরোজ নুন বলে এক ছাত্রনেতা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি, স্থানীয় শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে নিয়ে আমরা ঢাকা-চট্টগ্রামগামী ট্রেনটিকে অবরোধ করে দেব। ওই রাস্তায় আর কোনো ট্রেন চলাচল করতে দেব না। তখন আমার নিজের মধ্যে একটা নেশা ধরেছিল, যে কোনো উপায়ে একটা প্রতিরোধ গড়ে তুলতেই হবে। আমি যখন মাইলপোস্টের ওপর দাঁড়িয়ে হাতে একটা হ্যান্ডমাইক নিয়ে কথা বলছিলাম। ঠিক তখনই রেলের একটা ইঞ্জিন হর্ন বাজাতে বাজাতে এগিয়ে এলো এবং সেখান থেকে পুলিশের এক কর্মকর্তা একটা পিস্তলের গুলি ছুড়লেন। যার কাঁধে ভর দিয়ে আমি কথা বলছিলাম, সেই মনু মিয়া সঙ্গে সঙ্গে ওখানে লুটিয়ে পড়লেন। তাঁর শরীরের সমস্ত রক্ত আমার জামাকাপড়ে লেগে গেল।

সেই রক্তাক্ত জামাকাপড় নিয়ে আমি যখন মিছিল সহকারে কার্জন হলের দিকে আসছিলাম, তখন পুলিশ আমাকে বেদম পিটিয়েছিল। আমি ওই অবস্থায় কার্জন হলে এলে মণি ভাই আমাকে আবেগ-উচ্ছ্বাসে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। পাশে বাকী ভাই, রাজ্জাক ভাই, সিরাজ ভাই; তারাও খুব উত্তেজিতভাবে মণি ভাইয়ের পাশে দাঁড়ানো ছিলেন। তারপর থেকেই মণি ভাইয়ের একটা স্নেহার্দ্র দৃষ্টি আমার প্রতি সবসময় প্রতিফলিত ছিল। তবুও কোটারির কারণে কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর প্রথমবার, অর্থাৎ ঊনসত্তরের প্রথমভাগে আমি সভাপতি হতে পারিনি। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে ৬৯-এর শেষের দিকে আমি ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের অকুণ্ঠ সমর্থন নিয়ে তাদের অভূতপূর্ব চেতনার প্রত্যয় ও বলিষ্ঠতায় সভাপতি নির্বাচিত হলাম। সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার প্রাক্কালে ওই নেতাদের প্রচ্ছন্ন বিরোধিতা ছিল কিনা আমি বুঝতে পারিনি কিন্তু মণি ভাই আমাকে নির্বাচিত হওয়ার পরে সাদরে আলিঙ্গন করেছিলেন এবং বলেছিলেন তুমি সামনের দিকে এগিয়ে যাও। তোমাকে আমি সর্বাত্মক সহযোগিতা দেব। তুমি কখনো কুণ্ঠাবোধ করবে না। তারপর থেকে আমি কখনোই মণি ভাইয়ের সমর্থনবঞ্চিত হইনি।

ছাত্ররাজনীতির এককালীন সিংহপুরুষ ছিলেন শেখ ফজলুল হক মণি। ছিপছিপে দোহারা গড়নের, মোটা গোঁফ, ফর্সা চেহারার মণি ভাইয়ের হৃদয় ছিল শান্ত-প্রশান্ত সাগরের মতো বিশাল বিস্তীর্ণ। তিনি রাগী মেজাজের হলেও, কেউ যদি তার ক্রোধের প্রথম ধাক্কাটা সামলাতে পারত, তাহলেই সে মণি ভাইকে পূর্ণ কবজা করে নিতে পারত। পাষাণের বুকে ঝরনার ফল্গুধারার মতো তাঁর হৃদয়টা ছিল দেশ ও ছাত্রলীগের প্রতি বিমূর্ত ভালোবাসায় ভরপুর। আমি তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। ছাত্ররাজনীতি থেকে বিদায় নেওয়ার পর তাঁর অন্তরের বাসনা ছিল, তিনি সাংবাদিকতায় শীর্ষশিখরে উঠবেন, মানিক মিয়া হবেন। এই প্রত্যয় ও প্রতীতি থেকে তিনি বাংলার বাণী পত্রিকাকে সাপ্তাহিক থেকে দৈনিকে রূপান্তর করেন এবং নিজেই তার সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

যারা কাপুরুষের মতো পৈশাচিক আক্রমণ করে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল, তাদের হিসাবের পরিমন্ডলে ছিল, শেখ মণি জীবিত থাকলে মুজিব হত্যার পর তিনি বাংলাদেশে একটা প্রচন্ড প্রতিরোধ করে তুলতে পারবেন। তাই তারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার আগেই শেখ মণিকে হত্যার পরিকল্পনা কার্যকর করে। দুর্ভাগ্য বাংলাদেশের, দুর্ভাগ্য শেখ ফজলুল হক মণির, তিনি তাঁর প্রতিভার সবটুকু দেশ ও জাতিকে দিয়ে যেতে পারেননি।

তাঁকে আমি বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলাম, তথাকথিত বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রীরা সামাজিক বিপ্লবের ধুয়া তুলে যেভাবে ছাত্র ও যুবসমাজকে বিভ্রান্ত করে মরীচিকার পেছনে টেনে নিচ্ছিল, তাতে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ দ্বারা তাদের প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে না। এই দুটি সংগঠনের মধ্যবর্তী একটি যুব সংগঠন আবশ্যক। তাই তিনি দৈনিক বাংলার বাণীর সম্পাদনার পাশাপাশি যুবলীগ প্রতিষ্ঠার তাগিদ অনুভব করেন এবং একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করেন। সেখানে আমাকে তিনি যুগ্ম-আহ্বায়ক রাখেন।

ঝিনাইদহ থেকে আমি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে সর্বপ্রথম তিনিই আমাকে টেলিফোনে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। আমি ঢাকায় ফিরে এলে মণিভাই আমাকে একান্তে ডেকে নিয়ে বলেন, তিনি যুবলীগের চেয়ারম্যান হলে আমাকে মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করতে হবে। আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালে মণি ভাই বলেছিলেন, ‘আমি মামাকে কথাটা বলেছি। মামাও সম্মতি জানিয়েছেন।’ তখন আমার আর কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকল না, নিঃসংশয় চিত্তে অমলিন হৃদয়ে উদ্বেলিত সত্তায় উজ্জীবিত হয়ে যুবলীগ মহাসচিবের দায়িত্ব বয়ে নিয়ে চললাম। পরবর্তীতে ষড়যন্ত্রের কুশীলবদের শতরঞ্জির খেলায় আমি যখন যুবলীগ থেকে বাদ পড়ার উপক্রম, আমাকে যখন যুবলীগের মহাসচিবের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র পাকাপোক্ত হলো, তখন মণি ভাই আমাকে ডেকে বলেছিলেন, যা হওয়ার তাই হবে। এসো আমরা যুবলীগকে পরিপূর্ণ রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করি। তখন আর কারও প্রতি আমাদের দায়-দায়িত্ব থাকবে না, আনুগত্যের বোঝাও বইতে হবে না। মণি ভাইয়ের এই প্রাণবন্ত প্রস্তাব আমি প্রত্যাখ্যান করেছিলাম। কারণ আমি জানতাম, যুবলীগ রাজনৈতিক সংগঠন হলে, তার যে প্রচন্ড বাধাবিঘ্ন আসত এবং অসংখ্য যুবলীগ নেতা-কর্মী যে, অকারণে জীবন দিতে হতো, সেটা এতখানি ভয়াবহ হতো যে, সহ্য করা সম্ভব হতো না।

আমি মণি ভাইকে বলেছিলাম, আপনার এবং আমার ওপর হয়তো আঘাত আসবে না; কিন্তু তলা থেকে সব সাফ হয়ে যাবে। প্রাণ হারাবে আমাদের অগণিত নেতা-কর্মী। মণি ভাই কথাটা বুঝেছিলেন। অশ্রুসিক্ত নয়নে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, আলম রে, আমি তোর কাছে ঋণী হয়ে রইলাম। আমার যদি কোনো দিন সুযোগ আসে তবে এই ঋণ আমি শোধ করব। মণি ভাইয়ের মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তার সঙ্গে আমার রাজনৈতিক যোগাযোগ গভীরভাবে সংযুক্ত ছিল। শাহাদাতের আগের ওইদিন রাতে তিনি যুবলীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের কাছে আমার সম্পর্কে তার অমলিন বিশ্বাস, গভীর আস্থা ও অমøান ধারণার কথা বিশেষভাবে বলে গিয়েছিলেন। মণি ভাইয়ের যুবলীগ অবিচল ধারায় আওয়ামী লীগের শক্তিশালী অঙ্গসংগঠন হিসেবে কাজ করছে এবং যথার্থভাবেই জাসদের তথাকথিত ভুয়া সামাজিক বিপ্লবের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে একটা অজেয় সংগঠন হিসেবে গিরিশৃঙ্গমালার মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, মণি ভাইয়ের বিদেহী আত্মা যুবলীগের কাঞ্চনজঙ্ঘার মতো এই দৃশ্যমান অবস্থান দেখে নিশ্চয়ই খুবই পরিতৃপ্ত। আমিও জীবনসায়াহ্নে এই নিঃসঙ্গ নিষ্প্রভ রাজনৈতিক জীবনের পাদপীঠে দাঁড়িয়ে যুবলীগকে আশীর্বাদই করে যাব, গণতন্ত্রকে সমুন্নত ও সংহত রাখার এই কালজয়ী যুদ্ধে তারা বিজয়কেতন ওড়াবেই। ইনশা আল্লাহ।

লেখক : স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ও ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি।

সর্বশেষ খবর