বৃহস্পতিবার, ২৭ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০ টা

আজমিরের মহান সাধক খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (রহ.)

এম এ মান্নান

আজমিরের মহান সাধক খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (রহ.)

ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলাম প্রচার হয়েছে পীর-আউলিয়াদের মাধ্যমে। তাঁরা ইসলামের শান্তি ও কল্যাণের বাণী পৌঁছে দিয়েছেন নানা প্রান্তের মানুষের কাছে। এসব পীর-আউলিয়ার অন্যতম ভারতের আজমিরের খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (রহ.)। খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (রহ.) ৫৩৭ হিজরিতে মধ্য এশিয়ার খোরাসানে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম সৈয়দ খাজা গিয়াস উদ্দিন, মায়ের নাম সৈয়দা উম্মুল ওয়ারা মাহেনুর। বাবার দিকে তিনি হজরত আলীর (রা.) চতুর্দশতম ও মায়ের দিকে হজরত ফাতেমা (রা.)-এর দ্বাদশতম বংশধর। মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি বাবা-মা উভয়কে হারান। মঈনুদ্দিন চিশতি বাবার সান্নিধ্যে প্রাথমিক দীনি শিক্ষা অর্জন করেন। নয় বছর বয়সে তরজমাসহ আল কোরআন মুখস্থ করেন। এপর ১৩ বছর পর্যন্ত বাবার সার্বিক তত্ত্বাবধানে কোরআন, হাদিস, ফিকাহ ইত্যাদি বিষয়ে গভীর ব্যুৎপত্তি লাভ করেন।

রুহানি আকর্ষণে তিনি আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। বুখারা, ইরাক, নিশাপুর প্রভৃতি জায়গায় যেখানে অলি বুজুর্গ, দরবেশের সন্ধান পান সেখানেই অবস্থান নিয়ে ইলমে মারেফত অর্জনে নিজেকে নিয়োজিত করেন। এভাবে মঈনুদ্দিন চিশতি বুখারা থেকে নিশাপুরে আসেন। নিশাপুর এসে ‘হারুন’ নামক একটি ছোট শহরে হজরত ওসমান হারুনির (রহ.) সন্ধান পান, যিনি হাজি শরিফ জিন্দানি (রহ.)-এর শিষ্য ও প্রধান খলিফা। যিনি ছিলেন তৎকালীন ইলমে মারেফতের রহস্যজ্ঞানী মহান আধ্যাত্মিক তাপস। মঈনুদ্দিন চিশতি তাঁর দরবারে উপস্থিত হন। ওসমান হারুনি মঈনুদ্দিন চিশতিকে খিলাফত প্রদান করেন। খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি আপন পীর-মুরশিদের অনুমতিক্রমে বিভিন্ন ওলি-আউলিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বাগদাদে হজরত আবদুল কাদির জিলানি (রহ.)-এর সাহচর্যে ৫৭ দিন অবস্থান করেন। এই সময়ে হজরত জিলানি হিন্দুস্থান অর্থাৎ ভারতবর্ষে দীন কায়েমের দায়িত্ব দেন তাঁকে। একই সুসংবাদ মদিনায় অবস্থানকালে তিনি পান রসুল (সা.)-এর পক্ষ থেকে রুহানিভাবে।

তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় তাঁকে আজমির শহরের দৃশ্য দেখিয়ে দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে দেওয়া হয় প্রয়োজনীয় পথনির্দেশনা। খাজা গরিবে নেওয়াজ নবীজির নির্দেশেই সুদূর আরব থেকে ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান হয়ে প্রথমে লাহোর পরে দিল্লি হয়ে আজমিরে শুভাগমন করেন। দলে দলে লোকজন হজরত মঈনুদ্দিন চিশতির সান্নিধ্যে এসে দীনের দাওয়াত গ্রহণ করে। কায়েমি স্বার্থবাদীরা রাজদরবারে গিয়ে খাজা মইনুদ্দিন চিশতি ও তাঁর সহচরদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন রাজা পৃথ্বীরাজ। রাজা একদল সেনাকে আদেশ দিলেন ফকির-দরবেশ দলকে এক্ষুনি রাজ্য থেকে বিতাড়িত করতে। রাজার আদেশ পেয়ে সেনারা ঝাঁপিয়ে পড়ল অভিযানে। হজরত খাজা মইনুদ্দিন চিশতি (রহ.) নির্বিকার। আল্লাহর সাহায্য কামনা করলেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গেই আক্রমণকারীদের কেউ হলেন অন্ধ, কারও শরীর হলো নিঃসাড়। কেউ হলো ভূতলশায়ী। নিরুপায় হয়ে পায়ে পড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করল তারা। খাজা মইনুদ্দিন চিশতি ক্ষমা করে দিলেন সবাইকে।

এ ঘটনার পর দলে দলে লোক গ্রহণ করে একাত্মবাদী ধর্মমত। রাজা ভেবেচিন্তে ঠিক করলেন, হিন্দুধর্মের আধ্যাত্মিক সিদ্ধপুরুষদের দ্বারা প্রতিরোধ করতে হবে ফকিরকে। তাই সিদ্ধপুরুষ বলে খ্যাত রামদেওকে তাঁর যোগমন্ত্রবলে এই মুসলিম ফকিরকে বিতাড়িত করার দায়িত্ব দেন। রামদেও তাঁর সাধনালব্ধ আধ্যাত্মিক শক্তিতে খাজা মইনুদ্দিন চিশতিকে পরাস্ত করার বাসনায় হাজির হলেন হজরতের দরবারে। খাজা মইনুদ্দিন তখন ছিলেন ধ্যানমগ্ন। কিছুক্ষণ পর চোখ খুললেন। খাজা মইনুদ্দিনের জ্যোতির্ময় চেহারায় মুগ্ধ হয়ে গেলেন রামদেও। হজরত খাজার কদমে লুটিয়ে পড়লেন রামদেও। গ্রহণ করলেন ইসলাম। খাজা মইনুদ্দিন চিশতি তার নাম রাখলেন মুহাম্মদ সাদি। রামদেওয়ের ইসলাম গ্রহণে রাজা ক্ষোভে-দুঃখে অস্থির হয়ে উঠলেন।

খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি রাজা পৃথ্বীরাজের একজন মুসলিম কর্মচারীকে দিয়ে তাঁর কাছে ইসলামের দাওয়াত পাঠান। চিঠি পেয়ে রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন পৃথ্বীরাজ। মুসলমান কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করলেন। সেই সঙ্গে খাজার বিরুদ্ধে উচ্চারণ করলেন অশালীন বক্তব্য। শুনে মইনুদ্দিন চিশতি এক টুকরো কাগজে লিখে পাঠালেন রাজা পৃথ্বীরাজকে- ‘আমি তোমাকে তোমার জীবিতাবস্থায়ই মুসলিম সেনাদের হাতে সোপর্দ করলাম।’ এর আগে দুবার ভারত আক্রমণ করেও সফল হতে পারেননি সুলতান শাহাবুদ্দিন মুহাম্মদ ঘুরি। তিনি স্বপ্নে দেখলেন এক জ্যোতির্ময় মহাপুরুষ তাঁকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘যাও, তোমাকে আমি হিন্দুস্থানের শাসনক্ষমতা দান করলাম।’ এ শুভস্বপ্ন দেখে সুলতান তাঁর বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে রওনা হলেন। এ বাহিনীর প্রধান সেনাপতি কুতুবুদ্দিন আইবেক। রাজা পৃথ্বীরাজের বাহিনী পরাজিত হয় নির্মমভাবে।

যুদ্ধ শেষে সুলতান ঘুরি আজমির পৌঁছান। তখন সন্ধ্যা। দূরে আজানের ধ্বনি শুনে সেদিকে এগিয়ে যেতেই দেখলেন একদল লোক হাত বেঁধে দাঁড়িয়েছেন। দরবেশদের জামাতে নামাজ আদায় করলেন সুলতান। সালাত শেষে জামাতের ইমামের মুখের দিকে তাকিয়েই চমকে উঠলেন মুহাম্মদ ঘুরি। এই তো সেই জ্যোতির্ময় মহাপুরুষ, স্বপ্নে যিনি জানিয়েছেন হিন্দুস্থান বিজয়ের সুসংবাদ। সুলতান শ্রদ্ধাভরে পরিচিত হলেন হজরত খাজার সঙ্গে। হজরতের হাতে বায়াত গ্রহণ করে তাঁর সোহবতে তিন দিন অতিবাহিত করে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করলেন সুলতান। তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে দিল্লিতে রেখে গেলেন কুতুবুদ্দিন আইবেককে। ৬৩৩ হিজরির ৬ রজব আজমিরে ইন্তেকাল করেন খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি।

লেখক : সভাপতি, আমেনা খাতুন হাফেজিয়া কোরআন রিসার্চ অ্যান্ড ক্যাডেট ইনস্টিটিউট, কটিয়াদী, কিশোরগঞ্জ

সর্বশেষ খবর