আগামী জাতীয় নির্বাচনের ফুল ফোটেনি এখনো। নির্বাচন আদৌ হবে কি না সে প্রশ্নের উত্তর রাজপথে ঘুরপাক খাচ্ছে। ডিজিটাল ভোটযন্ত্রে সব দল ও নাগরিক সমাজের অনীহা। শুধু সরকারি দল পক্ষে। ক্ষমতাসীন দল ইভিএম টানাটানি না করে সরকারের বড় বড় অর্জন মানুষের কাছে তুলে ধরলে তা কাজের কাজ বলে বিবেচিত হবে। আখেরে ভালো হবে। করোনার শুরু থেকে আর্থিক সংকটের দুর্যোগ জেঁকে বসেছে জাতির কাঁধে, বর্তমানে তা আরও তীব্রতর হয়েছে। বাজারে কিছু ছোঁয়া যায় না। আগুন জ্বলছে নিত্যপণ্যের গায়ে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কাছে অসহায় মানুষ। দেশের এমন দুর্বিপাকে কার বাণিজ্য মোটাতাজা প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চায় কমিশন। কীসের অজ্ঞাত মোহে আর্থিক সংকটের দুঃসময়ে স্ববিরোধী কম্মে হাত দিতে হচ্ছে। নির্বাচন কমিশনের কেনাকাটার হিড়িকের লাগামহীন পাগলা ঘোড়া কোনো যুক্তিতেই থামানো যাচ্ছে না। সব মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দ কেটে কাটছাঁট হচ্ছে, কর্মচারীদের অফিসে এসি বন্ধ, গাড়ির সীমিত চলন, বিদেশ ভ্রমণ বন্ধ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আগাম দুর্ভিক্ষের আভাস দিয়ে খাদ্য উৎপাদনে মন দিতে বলছেন।
দুই সচিবের প্রাসাদ নির্মাণ এখন কি বেহুদা খরচ মনে হয় না? সরকার নির্মাণ করতে চাইলেও সচিবরা বিনয়ের সঙ্গে এ অর্থ তেল-গাস-খাদ্য আমদানিতে বিনিয়োগের সুপারিশ করলে প্রশংসিত হতেন। সুবিধাবাদীরা সুযোগ পেলেই অগ্রপশ্চাৎ সবই ভক্ষণ করে। আমরা স্বার্থান্বেষণে উৎসাহী জাতি। চাকরির ষোল আনা ঘরে তুলে নেব। অবসরে বোনাস হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার আশায় বুক বেঁধে দেনদরবার করে পাইকারিভাবে শুধু চাই চাই।
জর্জ ওয়াশিংটন দুই টার্ম প্রেসিডেন্ট থাকার পর তৃতীয়বারের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। সেই রেওয়াজ এখনো আমেরিকা অনুসরণ করে। আমাদের কে দেখাবে আলোর পথ।সংকট মোকাবিলায় সরকার কৃপণ হতে অসিয়ত করছে। কম গুরুত্ব প্রকল্প স্থগিত। দুর্ভিক্ষের পূর্বাভাস দেওয়া হচ্ছে। এমন অবস্থায় কোন আক্কেলে ২ লাখ ইভিএম খরিদ করতে চাওয়া হচ্ছে। রাজকোষ নিয়ে মজা চলছে। আগাম ঘোষণা ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫০ আসনে যন্ত্রে ভোট নেবে। যন্ত্রের হ্যাঁ-না মাঝামাঝি অবস্থান তাই অর্ধেক আসনের জন্য কিনতে চায়, বাঃ কী বিচক্ষণতা! নির্বাচনে গতবার বরাদ্দ ছিল ৭০০ কোটি টাকা। বিতর্ক আছে ইভিএম ব্যবহারে আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগী কয় দল যন্ত্রের পক্ষে। অনেক দল ইভিএমকে আখ্যা দিয়েছে কারচুপির মেশিন, ভোট চুরির যন্ত্র। শিশুর দুধের জন্য পিতার চাল চুরির সংবাদ গণমাধ্যমে যখন, তখন এ টাকার মচ্ছব অন্যায়। বিতর্কিত দুর্বল যন্ত্র কেন, কার স্বার্থে। আমাদের ইভিএম যন্ত্রের দাম ৩ লাখ ৩৩ হাজার টাকা মাত্র। আর ভারতের দাম ২২-২৩ হাজার টাকা। আমাদের কীর্তিমানরা ভারতের তুলনায় ৩ লাখের বেশি টাকা দামে ইভিএম কেনায় পারদর্শী। যাচাই-বাছাইয়ের প্রশ্ন এলে ভাঙা রেকর্ড বাজাবেন- সময়ের অভাবে সম্ভাব্য যাচাই করা যায়নি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় অর্থের হরিলুট চলছে। সরকারও বলছে যত টাকা নাও আমার লক্ষ্মীসোনা। তোমরা ক্রয়নীতি জারি রাখ যাতে সরকার কামিয়াবি হতে পারে।
কমিশন গোঁয়ার্তুমি করে বলছে সব কেন্দ্র পাহারা দেবে সিসি ক্যামেরা। নয়া এ ক্যামেরা প্রকল্পের ভূত মাথায় চড়েছে, টাকার মা-বাপ নেই। গাইবান্ধা সিসি ক্যামেরায় কমিশন দেখল বায়োস্কোপ, প্রিসাইডিং অফিসার কিছু দেখেনি। সিসি ক্যামেরার চোখ সরকারি দলও মানে না। সিসি ক্যামেরায় নিয়ন্ত্রণ করবে কারচুপি এটা একটা অসিলা মাত্র। বাস্তবে কোনোভাবে সম্ভব নয়। গাইবান্ধার সিসি ক্যামেরা কাহিনির তদন্ত এখনো শেষ হয়নি, যা এসেছে কমিশন বলছে খন্ডিত তদন্ত রিপোর্ট এসেছে।
কমিশন কেনাকাটায় মনোযোগী। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা থাকা উচিত। মনে হচ্ছে যেন যন্ত্র মঙ্গলগ্রহ থেকে কেনা হচ্ছে। উচ্চমূল্যে কেনা হলে সে অনিয়মের বিচার একদিন হবে। ওই টাকা দিয়ে উন্নয়ন করা হোক। সরকারের জবাবদিহি থাকতে হবে। অর্থনৈতিক সংকটে দেশ, তার পরও ৯ হাজার কোটি টাকার ইভিএম। অথচ এ যন্ত্রটি নির্ভরযোগ্য নয়। যেখানেই দেবেন ভোট গড়িয়ে পড়বে বিশেষ মার্কায়- এ বিতর্ক রয়ে গেছে। যে দেশে ঠিকমতো ভোটই হয় না সে দেশে চড়া দামে ইভিএম আমদানির কী দরকার। এটা ভোটিং মেশিন নাকি টাকা কামানোর মেশিন? আগে যেসব মেশিন কেনা হয়েছিল এখন সেগুলোর প্রায় সবই খারাপ হয়ে গেছে। দামও ১১ গুণ বেশি ভারতের চেয়ে। প্রকল্প যাচাই করা হয়নি সময় বাঁচাতে। এমন আজব যন্ত্র অন্য দেশ ব্যবহার করে না। আমাদের দেশেও হওয়া উচিত নয়।
অর্থনৈতিক সংকট চলছে। সুসংরক্ষণের অভাবে আগের মেশিনগুলো খারাপ। এ টি এম শামসুল হুদা তুলনামূলক খরচের নিরীক্ষা করেছিলেন। দেশের বরেণ্য ৩৯ জন বিশিষ্ট নাগরিক বিবৃতি দিয়েছেন ইভিএম বাদ দিতে। অস্থির বিশ্ব পরিস্থিতিতে দেশের আর্থিক সংকটে ইভিএম কেনা কতটা যৌক্তিক তা ভাবতে হবে। বিশ্বের ১৩টি দেশ ইভিএমে ভোট করে। ১৭৮টি দেশের মধ্যে জার্মানি, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস প্রযুক্তির দিক থেকে উন্নত হলেও তারা এ মেশিনের খপ্পর থেকে দূরে সরে আছে। প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতার জন্য ভোটারের অনাস্থা। সরকার আইএমএফের দরবারে ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের জন্য চেষ্টা-তদবির করছে সংকট উত্তরণে উপায় আবিষ্কারের জন্য। তারা আমাদের রিজার্ভের হিসাবে ভুল খুঁজে পেয়েছে। শুধু ইভিএম নয়, সব ক্ষেত্রে অপচয়ের চিন্তা বাদ দিতে হবে।
লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক