দিলীপ বড়ুয়া একজন ভাগ্যবান রাজনীতিবিদ। বাম রাজনীতি করলেও ক্ষমতার চারপাশেই তার আনাগোনা। বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় থাকাকালীন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়ার সফরসঙ্গী হয়ে চীন সফর করেছিলেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে তিনি শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী হিসেবে পাঁচ বছর দায়িত্ব পালন করেন। তার সাম্যবাদী দলের তিনিই সর্বেসর্বা। কর্মী নেই, আসন নেই তবু তিনি মন্ত্রী হওয়ার বিরল সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর থেকে আওয়ামী লীগ একলা চলো নীতিতে। এ কারণে বামপন্থি ওই নেতা অপাঙ্ক্তেয়। অনাদরে-অবহেলায় পরিত্যক্ত সরঞ্জামের মতো পড়ে আছেন। এরকম কষ্টে থাকলে তো যে কারোরই মন খারাপ হওয়ার কথা। দিলীপ বড়ুয়ারও হয়েছে। এ কারণেই ক্ষোভ ঝেড়ে এক সাক্ষাৎকার দিয়েছেন বিবিসিতে। ওই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘জাতীয় আন্তর্জাতিক সবকিছু মিলিয়ে বাংলাদেশে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে, তাতে সুষ্ঠু নির্বাচনে অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্লোগানের মধ্য দিয়ে আদৌ নির্বাচন না-ও হতে পারে।’ বড়ুয়া একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ। বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যাপারে তার অভিমানের কথা যেমন বলেছেন, ঠিক তেমনি নির্বাচন নিয়ে তিনি যে শঙ্কার কথা বলেছেন, সেটি উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। বরং বাংলাদেশের রাজনীতিতে আগামীর শঙ্কার বিষয়টা তিনি অকপটে এবং খোলামেলাভাবে বলেছেন।
বাংলাদেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে হওয়ার কথা। এক বছর দুই মাস আগে থেকেই নির্বাচন নিয়ে রাজনীতির মাঠ আস্তে আস্তে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো নির্বাচন নিয়ে খোলামেলা কথাবার্তা বলছে। নির্বাচন নিয়ে সুশীল সমাজের ঘুম নেই। নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করেছে, গাইবান্ধার মতো নির্বাচন রুখতে তারা বদ্ধপরিকর। সবার উদ্যোগ, আয়োজন, উৎকণ্ঠা এবং কথাবার্তায় মনে হচ্ছে, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান নয়। আগামী নির্বাচন বানচাল করাই যেন একটি সম্মিলিত শক্তির প্রধান লক্ষ্য। আওয়ামী লীগ সরকারকে হটানোর প্রধান এবং অব্যর্থ অস্ত্র যেন নির্বাচন হতে না দেওয়া। এমনকি আগামী সংসদ নির্বাচন যেন না হয়, সে জন্য ক্ষমতাসীন দলের কেউ কেউ তৎপর। প্রশাসনের মধ্যেও ঘাঁপটি মেরে আছে নির্বাচন বানচাল করার অপশক্তি। তর্কের খাতিরে আমরা যদি ধরে নিই শেষ পর্যন্ত নির্বাচন হলো না, তাহলে কী হবে? বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী পাঁচ বছর অন্তর জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। এটি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। এই নির্বাচন না হলে দেশে একটি সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হবে। অসাংবিধানিক শক্তি ক্ষমতায় আসার সুযোগ পাবে। আবার সংবিধান কাটাছেঁড়া হবে। অগণতান্ত্রিক এবং অনির্বাচিত একটি সরকার জগদ্দল পাথরের মতো জনগণের বুকের ওপর চেপে বসবে। সে রকম একটি পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্যই কি সমন্বিত প্রয়াস? আবার কি দেশে একটি এক-এগারো আনার পাঁয়তারা চলছে?
গত তিনটি নির্বাচনেই আওয়ামী লীগ জয়ী হয়েছে। এর মধ্যে ২০০৮ সালের নির্বাচন বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি সেরা নির্বাচন। ২০১৪-এ বিএনপি নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে নির্বাচন বর্জন করে। অর্ধেকের বেশি আসনে বিনা ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়। জাতীয় পার্টি আংশিক রঙিন সিনেমার মতো ওই নির্বাচনে আংশিক অংশগ্রহণ করে। কিন্তু বিএনপি ওই নির্বাচন প্রতিরোধ করতে পারেনি। বাংলাদেশে ২০১৪ সালের মতো প্রধান প্রধান দলের অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচন হয়েছে মোট চারটি। ১৯৮৬ সালের ৭ মের নির্বাচন বিএনপি বর্জন করে। আওয়ামী লীগ ওই নির্বাচনে অংশ নেয়। নিশ্চিত পরাজয়ের মুখে ক্ষমতাসীন জাতীয় পার্টির নেতা সামরিক একনায়ক এরশাদ নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা বন্ধ করে দেন। তারপর বানোয়াট ফলাফল বেতার এবং টেলিভিশনে প্রচার করা হয়। ওই নির্বাচনকে বলা হয় মিডিয়া ক্যু-এর নির্বাচন। ’৮৬-এর নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদের আয়ু ছিল মাত্র দেড় বছর। ১০ জুলাই সংসদের প্রথম অধিবেশন বসে। ১৯৮৭ সালের ৬ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি তীব্র বিরোধী আন্দোলনের মুখে সংসদ বিলুপ্ত করেন। ১৯৮৮-এর ৩ মার্চের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি কোনো দলই অংশ নেয়নি। আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বে কিছু রাজনৈতিক ভাঁড়কে নিয়ে সম্মিলিত বিরোধী দল এবং জাতির পিতার আত্মস্বীকৃত খুনিদের ফ্যাসিস্ট দল ফ্রীডম পার্টি ওই নির্বাচনে অংশ নেয়। ওই নির্বাচনে কোনো ভোট হয়নি। বানোয়াট ফলাফল ঘোষণা করা হয়। ২৫ এপ্রিল ১৯৮৮-তে সংসদের প্রথম অধিবেশন বসে। ’৯০-এর ৬ ডিসেম্বর এরশাদের পতনের মধ্য দিয়ে এই সংসদ বিলুপ্ত হয়। প্রধান সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ ছাড়া আরেকটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। মাগুরা, মিরপুর উপনির্বাচনে নজিরবিহীন কারচুপির পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। সে সময় বিএনপি বলেছিল, ‘পাগল এবং ছাগল ছাড়া কেউই নিরপেক্ষ নন।’ তীব্র গণআন্দোলন উপেক্ষা করে বেগম জিয়া নির্বাচনের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জামায়াতসহ দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দল ওই নির্বাচন বর্জন করে। প্রতিরোধের ডাক দেয়। বিএনপি ছাড়া আত্মস্বীকৃত খুনিদের দল ফ্রীডম পার্টি ওই নির্বাচনে অংশ নেয়। তীব্র গণআন্দোলনের মুখে ’৯৬-এর ১৫ ফেব্রুয়ারি আসলে কোনো ভোট হয়নি। নির্বাচনে বিএনপির ৪৯ প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। ভোট ছাড়াই কমিশন বিএনপি এবং ফ্রীডম পার্টির মধ্যে আসন বণ্টন করে একটি ভৌতিক ফলাফল ঘোষণা করে। এটা করতেই কমিশনের সময় লাগে পাঁচ দিন। গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে কোনো রকমে ১৯ মার্চ রাতে সংসদ অধিবেশন বসানো হয়। এই সংসদের আয়ু ছিল মাত্র সাত দিন (চার কর্মদিবস)। নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাস করেই এই সংসদ বিলুপ্ত হয়। প্রধান যে কোনো রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ ছাড়া সংসদ তার মেয়াদপূর্তি করতে পারে না- এরকম একটি ধারণা বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ২০১৪-তে বিএনপির ভোট বর্জনের পক্ষে প্রধান প্রেরণা ছিল এই সূত্রই। শুধু বিএনপি কেন, আওয়ামী লীগেরও অধিকাংশ নেতা এবং প্রার্থী মনে করেছিলেন, এই নির্বাচন একটি আপৎকালীন ব্যবস্থা। দ্রুতই আরেকটি নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ জন্য আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের মধ্যে বিনা ভোটে জয়ী হওয়ার হিড়িক পড়ে। নির্বাচনের প্রচারণা এবং টাকা খরচ করা থেকে আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ প্রার্থীই বিরত থাকেন। অল্প কিছু টাকা দিয়ে প্রতিপক্ষকে বসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলে। কোথাও কোথাও প্রশাসনকে ব্যবহার করে হুমকি দিয়েও প্রতিপক্ষকে নির্বাচন থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ফলে দেড় শর বেশি আসনে ভোট হয়নি। যেসব স্থানে ভোট হয় সেখানেও ভোটারদের উৎসাহ-উদ্দীপনা ছিল না। ওই নির্বাচনের পর এক বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোটে গঠিত সংসদ তার মেয়াদপূর্ণ করে। এটার কারণ ছিল, বিএনপির নেতিবাচক রাজনীতি। এ দেশের জনগণ বিএনপির জ্বালাও- পোড়াও এবং ধ্বংসাত্মক রাজনীতির বিরুদ্ধে অনাস্থা জানিয়েছিল ওই নির্বাচনকে মেনে নিয়ে। অবশ্য এর পেছনে আরেকটি ব্যাপার ছিল। ২০০৯ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত সময়ে আওয়ামী লীগের সুশাসন, উন্নয়ন। জনগণের জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য আসছিল। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার হচ্ছিল। মানুষ পরিবর্তনে সায় দেয়নি। অনিশ্চয়তার সাগরে ঝাঁপ দিতে চায়নি। ২০১৮-এর নির্বাচন ছিল আওয়ামী লীগকে কলঙ্কিত করার ষড়যন্ত্র। ওই নির্বাচন যদি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম সুষ্ঠু নির্বাচনও হতো তবু আওয়ামী লীগ জিতত। ২০১৮-এর নির্বাচনে বিএনপি শর্তহীনভাবে অংশ নিয়েছিল। দলটির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য। ড. কামাল হোসেনকে নেতা মেনে বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল নিশ্চিত পরাজয় জেনেই। কিন্তু কিছু অতি উৎসাহী চাটুকার দলীয় সরকারের অধীনে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের সম্ভাবনাকে গলা টিপে হত্যা করে। ওই নির্বাচনে যারা এটা করেছে, তারা আসলে গণতন্ত্রের শত্রু। ওই নির্বাচন সুন্দর হলে আজ এই সংকট হতো না। নির্বাচন নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর এমন অতিকথনের সুযোগও থাকত না। এখন বিএনপি সুযোগ পেয়েছে। নির্বাচন বর্জনের নামে তারা একটি অসাংবিধানিক টানেলে বাংলাদেশকে নিতে চাইছে। এখন রাজনীতির আসল খেলা হচ্ছে নির্বাচন হওয়া না হওয়ার লড়াই। এখানে মাঠের লড়াই কেবল গ্যালারি শো। আসল খেলা হচ্ছে পর্দার আড়ালে। যেখানে আওয়ামী লীগ সব সময়ই আনাড়ি এবং অপরিপক্ব। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এখন প্রতিদিন ‘খেলা হবে’ সেøাগানের ব্র্যান্ডিং করছেন। শামীম ওসমান উদ্ভাবিত, পশ্চিম বাংলার মমতা ব্যানার্জি কর্তৃক বাজারজাতকৃত এই বহুল চর্চিত সেøাগান বারবার বলে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক কোন খেলার কথা বলছেন? তিনি কি ভুল নিশানায় গুলি ছুড়ছেন? কারণ এবারের খেলাটা কে নির্বাচনে জিতবে তার প্রতিযোগিতা নয় বরং নির্বাচন করা না করার খেলা। সংবিধান রক্ষার খেলা। এই খেলায় কে জিতবে?এখন বিশ্বকাপ জ্বরে কাঁপছে গোটা দেশ। সারা বিশ্ব। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা নিয়ে চলছে মাতামাতি। খেলা যেমন অনিশ্চয়তা, তেমনি রাজনীতিও। মঙ্গলবার একটা মিটিং শেষ করে অফিসে এলাম বিকাল ৪টা নাগাদ। অফিসে ঢুকেই দেখি হইচই। ঘটনা কী? জানলাম আর্জেন্টিনা-সৌদি আরব খেলা। এ জন্য আমার সহকর্মীদের এত উচ্ছ্বাস। জাস্টিন, রিফাতসহ আরও কয়েকজন আর্জেন্টিনার জার্সি পরে খেলা দেখছে। আর্জেন্টিনার সঙ্গে সৌদি আরবের যোজন-যোজন পার্থক্য। আর্জেন্টিনার ফুটবল ঐতিহ্য বিস্ময়কর। আর সৌদি আরবের বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে খেলাটাই বড় অর্জন। এই খেলায় আর্জেন্টিনার জয় নিয়ে কারও কোনো সন্দেহ ছিল না। দেখার বিষয় ছিল কত ব্যবধানে আর্জেন্টিনা জিতবে। পেলে, ম্যারাডোনার পর এই বিশ্বে অন্যতম সেরা খেলোয়াড় লিওনেল মেসি। ফুটবলের জীবন্ত কিংবদন্তি। বিশ্বকাপের ট্রফিটা ছাড়া ফুটবলের এমন কোনো প্রাপ্তি নেই যা মেসি অর্জন করেননি। অনেক বোদ্ধা ক্রীড়া সমালোচক বলেন, মেসির জন্যই এবার আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ ট্রফিটা জেতা উচিত। মেসি যদি একটা বিশ্বকাপ জয় না করতে পারেন, তাহলে সেটা হবে ফুটবলের দুর্ভাগ্য। বিশ্বকাপে আসার আগে টানা ৩৬ ম্যাচ অপরাজিত লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা। তাই তৃতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ জয়ের মিশনেই কাতারে এসেছে আর্জেন্টিনা। খেলা শুরুর পর মনে হচ্ছিল সৌদি আরবকে নিয়ে রীতিমতো ছেলেখেলা করবে বিশ্বের তৃতীয় ফুটবল শক্তির দেশটি। ১০ মিনিটে গোল করেন মেসি। স্পর্শ করলেন অনন্য রেকর্ড। টানা চার বিশ্বকাপে গোল করা গ্রেটদের এলিট ক্লাবে প্রবেশ করেন ফুটবলের জাদুকর। কিন্তু তখন কে জানত বিস্ময়ের অনেক বাকি। দ্বিতীয়ার্ধের ৫ মিনিটের ঝড়ে ল-ভ- হয়ে গেল মেসির আর্জেন্টিনা। বিশ্বকাপ ফুটবলের ইতিহাসে অন্যতম আপসেট জন্ম দিয়ে জিতল সৌদি আরব। প্রথম ম্যাচে একমাত্র লিওনেল মেসি ছাড়া আর সব আর্জেন্টাইন খেলোয়াড়কে নিষ্প্রভ, মøান লেগেছে। মেসি নিঃসঙ্গ একাকী। সতীর্থরা মেসিকে মোটেও সহযোগিতা করতে পারছেন না। এই খেলাটা একটা ব্যাপার পরিষ্কার করে দিল, তা হলো খেলা এক মহাতারকার বিজয়গাথা নয়। একটি সমন্বিত টিমওয়ার্ক। যেখানে জেতার জন্য সবাইকে অবদান রাখতে হয়। খেলার মতো রাজনীতিতেও টিমওয়ার্ক লাগে। নেতার বিশ্বস্ত, পরীক্ষিত, যোগ্য সহযোগী লাগে। লাগে সমঝোতা, বোঝাপড়া এবং সমন্বয়। আর্জেন্টিনা-সৌদি আরব খেলা দেখে আমার মানসপটে বাংলাদেশের রাজনীতির চিত্রটা ভেসে উঠল। ওই খেলায় যেমন মেসি ছিলেন একা। তাকে তার সতীর্থরা সহযোগিতা করতে পারেননি। ঠিক তেমনি আমার মনে হয় বাংলাদেশের রাজনীতিতেও শেখ হাসিনা একাকী। তাঁকে সহায়তা করার মতো যোগ্য লোক নেই সরকারে কিংবা দলে। টানা তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকার দেশ পরিচালনা করছে। ১৪ বছর বাংলাদেশ এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে। এই কৃতিত্ব একজনের, শেখ হাসিনার। তিনি দেশকে একাই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। প্রথম এবং দ্বিতীয় মেয়াদে তাও কয়েকজন দৃশ্যমান সহযোগী ছিলেন। কিন্তু তৃতীয় মেয়াদে এসে মনে হচ্ছে শেখ হাসিনা একাই লড়ছেন।
একটি সরকারে প্রধানমন্ত্রীর পর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হলেন অর্থমন্ত্রী। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক। বরিস জনসন তাকে অর্থমন্ত্রী (চ্যান্সেলর অব এক্সচেকার) নিযুক্ত করেছিলেন। অর্থমন্ত্রী হিসেবে করোনাকালীন বিভিন্ন উদ্ভাবনী উদ্যোগ নিয়ে তিনি ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হন। বিবিসির সঙ্গে তখন এক সাক্ষাৎকারে ঋষি বলেছিলেন, ‘বিশ্বে সবচেয়ে নিদ্রাহীন, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত এবং অসুখী ব্যক্তি হলেন একটি দেশের অর্থমন্ত্রী।’ ঋষি সরকারের নতুন অর্থমন্ত্রী জেরেমি হান্ট। মঙ্গলবার তিনি গার্ডিয়ানে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘এই বিশ্বের কোনো অর্থমন্ত্রীর দম ফেলার সুযোগ নেই।’ জো বাইডেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে চমক সৃষ্টি করেন। অর্থমন্ত্রী (সেক্রেটারি অব ট্রেজারি) হিসেবে নিয়োগ দেন জ্যানেট ইয়েলেনকে। মার্কিন ইতিহাসে তিনিই প্রথম নারী অর্থমন্ত্রী। সম্প্রতি তীব্র অর্থনৈতিক সংকট এবং মুদ্রাস্ফীতির চাপে জর্জরিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ওয়াশিংটন পোস্টে এর পরিপ্রেক্ষিতে এক সাক্ষাৎকারে জ্যানেট ইয়েলেন বলেছেন, ‘এই দায়িত্বটা এমন যে, এক মুহূর্তও আপনি নিজের কথা ভাবতে পারবেন না।’ এই যখন দেশে দেশে অর্থমন্ত্রীদের অবস্থা তখন বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রীর দর্শন প্রাপ্তিই যেন এক বিরাট খবর। যে কোনো সময়ে তার জন্য ‘নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি’ দেওয়া যেতেই পারে। সংকট উত্তরণে তিনি ভূমিকাহীন। কেন তিনি অর্থমন্ত্রী- এ প্রশ্নের উত্তর হয়তো তিনি নিজেই দিতে পারবেন না। বাণিজ্যমন্ত্রীর বাজারের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তিনি কখন কী বলেন, তা নিয়ে রীতিমতো গবেষণা হতে পারে। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী সরকারের জন্য কত বড় বোঝা তা নিয়ে আওয়ামী লীগের মধ্যেই ব্যাপক আলোচনা শোনা যায়। রেলমন্ত্রী তো তার নিজ নির্বাচনী এলাকাকেই রেলের সদর দফতর বানিয়ে ফেলেছেন। তার কিঞ্চিৎ পুরনো হওয়া নববধূর মন্ত্রণালয়ের কাজে হস্তক্ষেপের পরও তিনি এটাকে শপথ ভঙ্গ মনে করতে রাজি নন। এ নিয়ে তিনি পদত্যাগের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেননি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এখন সাংবাদিকতা শেখাচ্ছেন। এত বাচাল এবং অসংলগ্ন কথাবার্তা বলা পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ কি আগে কখনো পেয়েছে? একা মেসি সৌদি আরবের সঙ্গেই হেরে গেছেন। এসব খেলোয়াড় (মন্ত্রী) দিয়ে শেখ হাসিনা কি পারবেন, ‘নির্বাচন বর্জন’ ষড়যন্ত্রকে হারাতে? এসব মন্ত্রী সামনে আরও বড় সংকটে কী করবেন? কিছু কিছু মন্ত্রী (সবাই নন) সরকারকে আরও ঝামেলায় ফেলছেন। কয়েকজনের কারণে সরকারের দুর্নাম হচ্ছে। মন্ত্রীদের যোগ্যতা, সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে আমরা যা জানি, তার চেয়ে বেশি জানেন শেখ হাসিনা। এ কারণেই তিনি মন্ত্রীদের ছেড়ে দিয়েছেন ফিতা কাটা, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির আসন অলঙ্কৃত করে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য। কাজ করাচ্ছেন আমলাদের দিয়ে। বাড়ির কাজের সহায়তাকারী যদি একবার বুঝে ফেলে তাকে ছাড়া বাড়ির লোকজন অসহায়, তাহলে তাদের কেউ কেউ পেয়ে বসে। জি বাংলা, স্টার জলসা দেখার সময় থেকে শুরু করে সুগন্ধি সাবানের দাবি ওঠে। প্রতিদিন চাহিদার ফর্দ লম্বা হতেই থাকে। আমলারা যখন বুঝে গেলেন, মন্ত্রীরা ‘কচিকাঁচা’ (প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ভাষা ধার করে) তখন কিছু কিছু আমলাও আবদারের তালিকাটা প্রতিদিন বাড়াচ্ছেন। এরা সরকারের সঙ্গে জনগণের মধ্যে দেয়াল তৈরি করছেন। রাজনীতি আর খেলার এক মৌলিক পার্থক্য আছে। ফুটবল বা ক্রিকেটে সমর্থকদের শুধু হাততালি দেওয়া কিংবা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করা ছাড়া কোনো ভূমিকা থাকে না। সমর্থকরা পছন্দের দলকে জেতাতে পারেন না। কিন্তু রাজনীতির খেলায় সমর্থকরাই আসল। সমর্থকরাই শক্তি। সমর্থকরাই দলকে জেতান। আর সমর্থক সৃষ্টির জন্য প্রয়োজন সংগঠন এবং ভালো কাজ। সংগঠন শক্তিশালী হলেই সমর্থন বাড়ে। দল জনপ্রিয় হয়। আর সংগঠন না থাকলে বিশাল বড় নেতাও বিলীন হয়ে যান। সম্প্রতি মালয়েশিয়ার নির্বাচনে আধুনিক মালয়েশিয়ার প্রতিষ্ঠাতা মাহাথির মোহাম্মদের পরাজয় তার সবচেয়ে টাটকা উদাহরণ। ৫৩ বছরের রাজনৈতিক জীবনে মাহাথির প্রথম পরাজিত হলেন। জামানত হারালেন। কারণ তার সংগঠন ছিল না। নতুন রাজনৈতিক দলকে ঠিকঠাক মতো গড়ে তুলতে পারেননি ৯২ বছরের এই প্রবীণ রাজনীতিবিদ। আওয়ামী লীগ এখনো টিকে আছে, তৃণমূল পর্যন্ত সংগঠনের জন্যই। কিন্তু এখন যে জেলায়, উপজেলায় সম্মেলন হচ্ছে, তা কি মনে হচ্ছে আওয়ামী লীগের সংগঠন ঠিকঠাক আছে? নাকি সুবিধাবাদীর মতলববাজরা দখল করে নিয়েছে আওয়ামী লীগকে। সংগঠনে তারুণ্যের জয়ধ্বনি নেই। সেই বিতর্কিত পুরনো মুখরা আবার নেতৃত্বে আসছেন। এই সংগঠন কি নির্বাচনী খেলায় শেখ হাসিনাকে যোগ্য সহযোগিতা করতে পারবে? এই খেলা কঠিন হবে। এই খেলা ২০১৪ কিংবা ২০১৮-এর মতো হবে না। মাঠের খেলা আর রাজনীতির খেলায় একটি ব্যাপার হুবহু এক। মিরাকল। অনেক কিংবদন্তি একাই খেলার ভাগ্য পাল্টে দেন। যেমন ১৯৮৬-এর বিশ্বকাপে ম্যারাডোনা। রাজনীতিতেও কখনো কখনো মহামানবের উত্থান ঘটে। তার এক অঙ্গুলি হেলনে জনগণ উদ্বেলিত হয়। সব ষড়যন্ত্র নস্যাৎ হয়। যেমন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। শেখ হাসিনার ধমনিতে সেই রক্ত। যখনই বিপর্যয়, যখনই কালো মেঘে ঢাকা অন্ধকার তখনই শেখ হাসিনা আলোকবর্তিকা হয়ে সামনে এসেছেন। একাই সংকট কাটিয়েছেন। এটাই হয়তো তাঁর খেলার কৌশল। ’৭৫ দেখেছেন, ২০০১ দেখেছেন, ২০০৪-এর ২১ আগস্ট দেখেছেন। দেখেছেন এক-এগারো। এ জন্য হয়তো একাই ঝুঁকি নিতে চাইছেন। বিশ্বাস শব্দটাই তাঁর চিন্তা থেকে উবে গেছে। একাই তিনি জয়ী করতে চান বাংলাদেশকে, জনগণকে। কি তিনি পারবেন? মেসি পারেননি কিন্তু ম্যারাডোনা পেরেছেন। শেখ হাসিনা কি পারবেন?
লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত।