বিশ্বজুড়ে এখন আলোচনার কেন্দ্রে ‘দ্য বিগেস্ট শো অন আর্থ’-ফিফা বিশ্বকাপ ২০২২। বিশ্ব ফুটবলের সর্বোচ্চ নিয়ামক সংস্থা ফিফা চার বছর পর পর ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজন করে থাকে। বিশ্বকাপের ২২তম আসর বসেছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতারে। গত ২০ নভেম্বর শুরু হয়েছে এ মহারণ। অংশ নিয়েছে ৩২টি দল। গরমের কথা মাথায় রেখে জুন-জুলাইয়ের বদলে এবার বিশ্বকাপ হচ্ছে নভেম্বর-ডিসেম্বরে। প্রিয় তারকাদের পারফরম্যান্স দেখার অপেক্ষায় ফুটবলপ্রেমীদের চোখ এখন টেলিভিশনের পর্দায়। বিশ্বকাপে নতুন নতুন তারকা খেলোয়াড়ের আবির্ভাব হয়। পুরনো তারকার কেউ কেউ ঝরে পড়েন। কার হাতে উঠবে এবারের বিশ্বকাপ তা জানতে অপেক্ষা করতে হবে ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত। বলা হয়ে থাকে ক্রিকেট অনিশ্চয়তার খেলা। কিন্তু ফুটবলেও মাঝেমধ্যে অঘটন ঘটে যায়। এবারের বিশ্বকাপে দুবারের চ্যাম্পিয়ন ও অন্যতম ফেবারিট আর্জেন্টিনাকে ২-১ গোলে ধরাশায়ী করে প্রথম চমক সৃষ্টি করেছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরব। চারবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন জার্মানিকে ২-১ গোলে হারিয়ে রূপকথার জন্ম দিয়েছে জাপান।
ফুটবল মহাযজ্ঞের ফেবারিটের তালিকা তৈরি করা হলে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, জার্মানি ও ফ্রান্স ঠাঁই পাবে, কোনো সন্দেহ নেই। স্পেন, পর্তুগাল আর ইংল্যান্ডও অনেকের ফেবারিট। ব্রাজিল বিশ্বকাপ শিরোপা জিতেছে মোট পাঁচবার। ১৯৫৮, ১৯৬২, ১৯৭০, ১৯৯৪ ও ২০০২ সালে। চারবারের চ্যাম্পিয়ন জার্মানি। ইতালিও চারবার বিশ্বকাপ ঘরে তুলেছে। ইতালি টানা দ্বিতীয়বারের মতো অনুপস্থিত বিশ্বকাপে। দুর্ভাগ্যক্রমে, ইউরো চ্যাম্পিয়নরা এবার ইউরোপের বাছাই পর্ব পার হতে পারেনি। আর্জেন্টিনা দুবার বিশ্বকাপ জিতেছে। ১৯৭৮ ও ১৯৮৬ সালে। এরপর কেটে গেছে অনেক বছর। তবে টানা ৩৬ ম্যাচ অপরাজিত থাকার রেকর্ড নিয়ে বিশ্বকাপ জয়ের মিশনে এসেছে অন্যতম ফেবারিট আর্জেন্টিনা। এবারের বিশ্বকাপে আফ্রিকার প্রতিনিধিত্ব করছে সেনেগাল, ক্যামেরুন, ঘানা, মরক্কো ও তিউনিসিয়া। আর জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ইরান, সৌদি আরব ও কাতার- এই পাঁচটি দেশ এশিয়ার প্রতিনিধিত্ব করছে। স্বাগতিক দেশ হিসেবে বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পেয়েছে মরুর দেশ কাতার। কাতারের এটাই প্রথম বিশ্বকাপ। উদ্বোধনী খেলায় ইকুয়েডরের কাছে ২-০ গোলে হেরে গেছে কাতার। ১৯৩০ সালে বিশ্বকাপের প্রথম আসর বসেছিল লাতিন আমেরিকার দেশ উরুগুয়েতে। সেবার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছিল স্বাগতিক উরুগুয়ে। বিশ্বকাপে গতবারের চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স। রানার্সআপ ক্রোয়েশিয়া।
এবারের বিশ্বকাপে মোট ৪৪ কোটি ডলার পুরস্কার দেওয়া হবে। বিশ্বজয়ী দল পাবে ৪ কোটি ২০ লাখ ডলার। প্রতি ডলার ১০৭ টাকা হিসাবে বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৪৫০ কোটি টাকা। রানার্সআপ দল পাবে ৩ কোটি ডলার। যার বিনিময় মূল্য বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩২১ কোটি টাকা। বিশ্বকাপে যোগ দেওয়া প্রতিটি দেশই কিছু না কিছু পাবে।ফুটবল উৎসবে মেতে উঠেছে বিশ্ব। বিশ্বকাপের ঢেউ আছড়ে পড়েছে বাংলাদেশেও। বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীরা মূলত ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা- এ দুটি শিবিরে বিভক্ত। প্রিয় তারকার ছবি আঁকা জার্সি গায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন ভক্তরা। ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার জাতীয় পতাকা উড়ছে অনেকের বাড়ির ছাদে। পতাকার রঙে রাঙানো হয়েছে কারও কারও বাড়ির দেয়াল। অতিউৎসাহী কেউ কেউ জমানো টাকা খরচ করে বা জমিজমা বিক্রি করে কয়েক কিলোমিটার লম্বা পতাকা বানিয়ে খবরের শিরোনাম হয়েছেন। প্রিয় দলের সমর্থনে শোভাযাত্রা বের করা হয়েছে এখানে-ওখানে। আমাদের ছোটকালে রেডিও ছিল বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম। রেডিওতে প্রচারিত ফুটবল খেলার ধারাবর্ণনা কান পেতে শুনতাম। তখন সাদা-কালো যুগ। পাড়া-মহল্লার দু-একটি সম্পন্ন পরিবারে সাদা-কালো টেলিভিশন ছিল। রঙিন টিভি আসার পর বিশ্বকাপ নিয়ে আমাদের আগ্রহ বেড়ে যায়।
আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল নিয়ে বাংলাদেশে উন্মাদনার খবর প্রকাশিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্টে। এটা আমাদের বড় অর্জন, এ কথা মনে করে পুলকিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। যা স্বাভাবিক তা সংবাদ নয়। যা অস্বাভাবিক সেটাই সংবাদ হিসেবে গুরুত্ব পায়। সুন্দর একটা উপমা দিয়ে এটা বোঝানো হয়। একটা কুকুর যখন একজন মানুষকে কামড়ায় তখন এটা সংবাদ নয়। কিন্তু যখন একজন মানুষ একটা কুকুরকে কামড়ায় তখন এটা সংবাদ হয়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি দেশের নাগরিক হয়েও সুদূর দক্ষিণ আমেরিকার দেশ আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের ফুটবলের প্রতি বাংলাদেশের অগুনতি ভক্ত-সমর্থকদের ভালোবাসা ও মাত্রাতিরিক্ত উন্মাদনা সঙ্গত কারণেই আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের দৃষ্টি কেড়েছে। এই উন্মাদনার ছিটেফোঁটাও বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবল ঘিরে পরিলক্ষিত হয় না। এক সময়ের জনপ্রিয় খেলা ফুটবল এখন অবহেলার শিকার। ঘরোয়া ফুটবল এখন আর দর্শক টানে না।
বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ফুটবল। শিশু যখন হাঁটতে শিখে তখন তার হাতে তুলে দেওয়া হয় বল। আমাদের স্কুলজীবনে ‘তোমার প্রিয় খেলা’ রচনা লিখতে হতো। প্রায় সবারই প্রিয় খেলা ছিল ফুটবল। এখন অবশ্য লেখা হয় ক্রিকেট। ক্রিকেট নিয়ে আমাদের প্রত্যাশার পারদ ওঠানামা করছে। পারফরম্যান্সের ধারাবাহিকতা নেই। বাংলাদেশের নারী ফুটবল দল আমাদের মুখ উজ্জ্বল করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একজন পোস্ট দিয়েছেন, ‘আপনার ফেবারিট দল কোনটি, আর্জেন্টিনা না ব্রাজিল?’ এর প্রতিক্রিয়ায় কেউ একজন মন্তব্য করেছেন, ‘বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল।’ মোক্ষম জবাব! আন্তর্জাতিক ফুটবলে বাংলাদেশের অবস্থান বলতে গেলে প্রায় তলানিতে। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা নিয়ে মাতামাতি নয়, এখন সময় বাংলাদেশের ফুটবলের প্রতি মনোযোগ দেওয়ার। সময় বয়ে যাচ্ছে। নিজের চরকায় তেল দেওয়ার উপযুক্ত সময় এটা।
লেখক : পরিচালক, পরিচালনা পর্ষদ, বাংলাদেশ হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন।