দুই হাজার বছরেরও বেশি আগে মহাবীর আলেকজান্ডারের গ্রিসের মানুষ জানত সেদিনের গঙ্গারিড তথা আজকের বাঙালি জাতির কথা। মধ্যযুগে বাংলাদেশ ছিল এক সমৃদ্ধ জনপদ। মরক্কোর বিশ্বখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা সারা বিশ্ব ঘুরে বাংলাদেশে এসে মন্তব্য করেন, ‘আমি পৃথিবীর বহু দেশ ঘুরেছি কিন্তু পণ্যের এমন প্রাচুর্য ও সস্তা দর আর কোথাও দেখিনি।’ বাংলাদেশের বন্দরে সে সময় চীন, মালয়সহ বিভিন্ন দেশের জাহাজ আসত পণ্য নেওয়ার জন্য। বাংলাদেশে তৈরি হতো মসলিন নামের সূক্ষ্ম বস্ত্র। মধ্যযুগে বাংলাদেশ দুনিয়াজুড়ে মসলিনের দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল। সেই প্রাচীন ও মধ্যযুগে বাংলা ছিল এক সম্পদশালী জনপদ। বাংলার অফুরন্ত সম্পদ এ দেশের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। এ সম্পদ লুণ্ঠনে কখনো এসেছে কর্ণাটক থেকে সেনেরা। কখনো পাঠান ও মুঘলরা। তবে তাদের সবাই গাঙ্গেয় বদ্বীপকে নিজের দেশ হিসেবে বেছে নিয়েছেন। মাটি ও মানুষের সঙ্গে একাত্ম হয়ে এ দেশের সন্তান হিসেবে নিজেদের পরিচয় গড়ে তুলেছেন। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে এ দেশে নোঙর ফেলে পর্তুগিজ, ডাচ, ফরাসি ও ইংরেজ বণিকরা। বাংলার নবাবের কাছ থেকে ব্যবসার অনুমতি পায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ইউরোপীয় বণিকরা ব্যবসায় সন্তুষ্ট থাকেনি। বাংলার মসনদের দিকেও তারা হাত বাড়ায়। শুরু হয় ষড়যন্ত্র। সে ষড়যন্ত্রে যোগ দেয় বাংলা-বিহার-ওড়িশার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার প্রধান সেনাপতি ও উজিরে আজম মীরজাফর আলী খান। নবাব হওয়ার লোভে মীরজাফর বিদেশি বেনিয়াদের কাছে নিজের বিবেক বিক্রি করে দেন। জগৎশেঠ, ইয়ার লতিফ, রায় দুর্লভসহ আরও অনেক বিশ্বাসঘাতক এ ষড়যন্ত্রে অংশ নেন।
নবাব সিরাজউদ্দৌলা ইংরেজদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তাই তিনি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশী প্রাঙ্গণে যুদ্ধ হয়। বিশাল বাহিনী নিয়েও এ যুদ্ধে পরাজিত হন বাংলার নবাব। মীরজাফরসহ নবাব বাহিনীর দুই-তৃতীয়াংশ সৈন্য যুদ্ধ থেকে বিরত থাকায় ইংরেজরা সহজেই জয়লাভ করে। পলাশী প্রান্তরে ডুবে যায় বাংলার স্বাধীনতার সূর্য। তারপর ১৯০ বছর ধরে এ দেশ নির্মম শোষণের শিকার হয়। ইংরেজ শাসনে মাত্র ১৩ বছরের মধ্যে সোনার বাংলা শ্মশানে পরিণত হয়। দেখা দেয় খাদ্যাভাব। ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দ অর্থাৎ বাংলা ১১৭৬ সনে দেখা দেয় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। সে দুর্ভিক্ষে বাংলার এক-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ ১ কোটি মানুষ অনাহারে মারা যায়।
দুর্ভিক্ষে যখন একের পর এক মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে তখনো ইংরেজরা এ দেশ থেকে জোর করে রাজস্ব আদায় করেছে। দুর্ভিক্ষের পরের বছরও আগের বছরের চেয়ে ৫ লাখ ২২ হাজার টাকা বেশি রাজস্ব আদায় হয়। আজকের মুদ্রায় এ অর্থের পরিমাণ কয়েক শ কোটি টাকার সমান। ইংরেজ আমলে ১৮৮৬, ১৮৯৬ ও ১৯৪৩ সালে তিনটি বড় দুর্ভিক্ষে কয়েক লাখ মানুষ মারা যায়। এর মধ্যে শুধু ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে ৩৫ লাখের বেশি মানুষ প্রাণ হারায়। নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের সময় বাংলা-বিহার-ওড়িশার রাজধানী মুর্শিদাবাদ ছিল লন্ডনের চেয়েও সমৃদ্ধ নগর। ঢাকা, চট্টগ্রাম নগরের আভিজাত্য ছিল ইউরোপের যে কোনো নগরের চেয়ে বেশি। ১৭৫৭ সালের আগে ও পরে বস্ত্র, চিনি, মসলাসহ বিপুল পরিমাণ পণ্য এ দেশ থেকে রপ্তানি হতো ইউরোপে। ১৯৪৭ সাল নাগাদ বাংলাদেশ প্রায় শিল্পশূন্য দেশে পরিণত হয়। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ইংরেজরা এ দেশ ছেড়ে চলে যায়। বাংলাদেশ পাকিস্তানের অংশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পাকিস্তান আন্দোলনে বাঙালি মুসলমানরাই মূলত নেতৃত্ব দেয়। পাকিস্তান আন্দোলনের নেতৃত্ব দানকারী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ঢাকায় ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহর সভাপতিত্বে। বাংলার মুসলমানরা একাট্টা হয়ে ভোট দিয়েছিল পাকিস্তানের পক্ষে। কিন্তু স্বাধীন পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও বাঙালি ছিল উপেক্ষার শিকার। পাকিস্তানের ২৩ বছরেও বাংলাদেশ নির্মম শোষণের শিকার হয়। পাকিস্তানের প্রধান রপ্তানি পণ্য ছিল পাট। এ পাট উৎপাদিত হতো তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশে। পাট রপ্তানির টাকা জমা হতো করাচি, লাহোর, রাওয়ালপিন্ডি ও ইসলামাবাদে। এ শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় বাঙালি। শুরু হয় স্বাধিকার সংগ্রাম। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা দেওয়ার বদলে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের আঁধারে পাকিস্তানিরা ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙালির ওপর। শুরু হয় গণহত্যা। এ কঠিন সময়ে বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয় স্বাধীনতা।রূপকথার ফিনিক্স পাখির কথা অনেকেরই জানা। ভস্মের মধ্য থেকে উড়াল দেওয়ার কৃতিত্বের অধিকারী এই জাদুকরী পাখি। বাংলাদেশ তথা বাঙালি জাতিকে তুলনা করা যায় এ পাখির সঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানিরা বাংলাদেশে বেপরোয়া গণহত্যা চালায়। লাখ লাখ মানুষ হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়। হাজার হাজার ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। শত শত সেতু-কালভার্ট ধ্বংস হয় মুক্তিযুদ্ধে। ৩০ লাখ মানুষের আত্মোৎসর্গের বিনিময়ে অর্জিত হয় মুক্তিযুদ্ধের বিজয়।
বলা যায় ধ্বংসস্তূপের ওপর বাংলাদেশের অভ্যুদয়। স্বাধীনতার পর বিরাজমান দুরবস্থা দেখে এ দেশের শত্রুরা ব্যঙ্গ করে বলত, ‘এটি একটি তলাবিহীন ঝুড়ি’। বাংলাদেশ যে তলাবিহীন ঝুড়ি নয় এ সত্যটি প্রমাণ করেছে বাঙালি। বাংলাদেশের অগ্রগতিকে বিস্ময় বলে স্বীকার করেছে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও উন্নত বিশ্বের বিশেষজ্ঞরা। স্বাধীনতার সময় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ব্যবধান ছিল আকাশসম। আজ উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পাকিস্তানকে অতিক্রম করার কৃতিত্ব দেখিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে ভারতও বাংলাদেশের পেছনে। স্বাধীনতার জন্য বাঙালি জাতির আত্মত্যাগ ব্যর্থ যায়নি। ফিনিক্স পাখির মতো ভস্ম থেকে উড়াল দেওয়ার যে কৃতিত্ব তারা দেখিয়েছে তা এখন দুনিয়ার সেরা সেরা অর্থনীতিবিদ ও উন্নয়ন গবেষকেরও গবেষণার বিষয়।
লেখক : প্রাবন্ধিক