নতুন বছর নতুন আঙ্গিক নতুন চিন্তাভাবনা, নতুন আশা-আকাক্সক্ষা। নতুন বছর শুভ হোক এটাই সবার প্রত্যাশা, এটাই সবার কামনা। বাস্তবে বিদায়ী বছর যেভাবে গেছে তাতে অনেক বড় কিছু আশা করা যায় না। তবু নতুনের প্রতি ভালোর প্রতি সবারই একটা দুর্বার আকাক্সক্ষা বা চাহিদা থাকে। তেমন একটা স্বপ্ন কল্পনা ও দুর্বার মানবিক ইচ্ছা নিয়েই নতুন বছর ২০২৩-কে আলিঙ্গন করছি। আশা করি ২০২৩ আমাদের স্বস্তি দেবে, সুস্থিতি দেবে। যে যা-ই বলুক, মানব জাতিকে সব সময় সংগ্রাম করেই চলতে হয়। সংগ্রাম, সংগ্রাম আর সংগ্রাম মানবসত্তার এক মস্তবড় সার্থক উপাদান।
বিদায়ী বছরে আর যা কিছুই হোক অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক কোনো কিছুতেই তেমন বড়সড় সাফল্য ছিল না। আবার এটা সত্য, গত বছর বাংলাদেশ যতটা সমস্যায় পড়তে পারত, যতটা সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা ছিল মোটেই ততটা বা তেমন হয়নি। বিগত বছরে বাংলাদেশের অর্জন একেবারেই ফেলে দেওয়ার নয়। পদ্মা সেতু নিয়ে কত পানি ঘোলা করা হয়েছে, কত উলটা-পালটা কথা বলা হয়েছে, কতজনকে নাজেহাল করা হয়েছে। তার পরও পদ্মা সেতু সগৌরবে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। সরকার এবং সরকারি দল পদ্মা সেতুর জাজিরা প্রান্তে ১০ লাখ মানুষের জমায়েত করতে চেয়েছিল। কাজটা বুদ্ধিমানের ছিল না। সে সময় বৃহত্তর সিলেটে ব্যাপক বন্যায় চরম ক্ষতি হয়েছিল। সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়লে পদ্মা সেতুতে ১০ লাখ লোকের সমাবেশের চেষ্টার চাইতে অনেক ভালো হতো। কিন্তু তেমনটা হয়নি। ১০ লাখ লোকের জমায়েত হয়নি। আপনাআপনি ২-৩ লাখ লোকের যে সমাবেশ হয়েছিল সেটাই উত্তম। তার চাইতে বেশি দরকার ছিল না। পদ্মা সেতুতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী খুবই দরদের সঙ্গে ’৭৫-এর প্রতিরোধ যোদ্ধাদের কথা তুলে ধরেছিলেন। তার পরও ছয় মাস যাচ্ছে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ-প্রতিরোধ কারীরা এখনো রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে কাগজে কলমে ‘দুষ্কৃতকারী’। যারা বঙ্গবন্ধুকে খুন করেছিল, বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী-সন্তানকে খুন করেছিল তারা কিন্তু চিহ্নিত দুষ্কৃতকারী নয়। ’৭৫-এর প্রতিরোধ যোদ্ধা দু-চার জন যারা নেতা হয়েছে, মন্ত্রী হয়েছে, এমপি হয়েছে আদতে তারাও দুষ্কৃতকারী। কারণ সার্বিকভাবে ’৭৫-এর প্রতিরোধ যোদ্ধা জিয়া-এরশাদ-খালেদা জিয়ার সরকারের আমলে যেমন দুষ্কৃতকারী ছিল, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রিয় বোন শেখ হাসিনার সময়ও তারা একই রকম দুষ্কৃতকারী। এর কোনো হেরফের নেই, কোনো অদলবদল নেই। ’৭৫-এর প্রতিরোধ যুদ্ধে ১০৪ জন যোদ্ধা শহীদ হয়েছিল। কয়েকবার সংসদে শোক প্রস্তাব তুলতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছি। শোক প্রস্তাব তোলা যায়নি। বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার মালিক হলেও বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিরুদ্ধে যারা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন তাদের স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। বরং তারা নানাভাবে লাঞ্ছিত হয়েছে। বিশেষ করে সীমান্ত এলাকায় প্রথম দিকে সরকারি দল জিয়া-এরশাদ-খালেদা জিয়ার লোকজন পীড়ন করেছে। এখানে একটা কথা ধ্রুব সত্য, সবার আমলে সব সময় একইভাবে জুলুম-নির্যাতন হয়েছে, এখনো হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে বরং হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে কিছুটা কম হয়েছে। ’৭৫-এর প্রতিরোধ যুদ্ধে সবচাইতে বেশি সীমান্তে বসবাসকারী আদিবাসীরা অংশ নিয়েছিল। তাদের এক কথা, ‘ওরা জাতির পিতাকে হত্যা করেছে, আমরা তার প্রতিশোধ নেব।’ যখনই কোনো শৃঙ্খলা বাহিনীর সৃষ্টি হয় তখনই সেখানে বিশৃঙ্খলা ঘটার সম্ভাবনা নিয়েই সৃষ্টি হয়। শৃঙ্খলা বাহিনী হবে সেখানে বিশৃঙ্খলা হবে না এটা হলফ করে বলা যায় না। ছোটখাটো বিশৃঙ্খলা হবে, বড় বিশৃঙ্খলাও হতে পারে। কিন্তু আমি একজন সৌভাগ্যবান মানুষ, আমার দলে তেমন কঠিন বিশৃঙ্খলা কখনো হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের সময় একজন নামকরা কমান্ডার এক অপারেশনে গিয়ে প্রচ- ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। চারজন সহযোদ্ধা শাহাদাতবরণ করেছিল, দুই বা তিনটি অস্ত্র হারিয়েছিল, প্রায় হাজারো গুলি খরচ করা হয়েছিল। যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে ফিরে মারাত্মক তান্ডব শুরু করেছিল। আমাকে গালাগালিও করেছিল, ‘অস্ত্র দিতে পারে না আমাদের যুদ্ধে পাঠাইছে। হেডকোয়ার্টার উড়িয়ে দেব।’ চার-পাঁচ শ মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে এমন হম্বিতম্বি মুক্তিযুদ্ধে কাদেরিয়া বাহিনীতে একবারই হয়েছিল। ঘটনা ঘটার কয়েক ঘণ্টা পর আমি সেখানে গিয়েছিলাম। একমাত্র কমান্ডার ছাড়া আর সবার মূল দলের প্রতি আনুগত্য ছিল অপরিসীম। ঘটনাস্থলে পৌঁছে কয়েকজন যোদ্ধাকে কয়েকটা বেত মেরে কমান্ডারকে বলেছিলাম, আপনি বয়সী মানুষ। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার শর্ত ভেঙেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম শর্ত হলো এক গুলি ব্যবহার করলে তার পরিবর্তে পাঁচ গুলি দিতে হবে। আপনি হাজারের ওপর গুলি খরচ করেছেন। পরিবর্তে একটা গুলিও অর্জন করতে পারেননি। চারজন সহযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন। এ পর্যন্ত আমাদের কোথাও একত্রে দুজন শাহাদাতবরণ করেনি। কী জবাব দেবেন? আপনি কিছুটা বয়সী মানুষ তাই আপনাকে এবারের মতো ছেড়ে দেওয়া হলো। সেই কমান্ডার মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্ত আর কখনো অমন করেননি। বরং সুশৃঙ্খল কাদেরিয়া বাহিনী গঠনে সিংহভাগ গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছেন। ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিরোধ-প্রতিবাদে জাতীয় মুক্তিবাহিনীর মধ্যে কখনো কোনো বিদ্রোহের আলামত খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবু জিয়া সরকারের প্রলোভনে মহান ভারতের শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী সরকারের বদল হওয়ার পর মোরারজি দেশাই সরকারের আমলে আমাদের কিছু যোদ্ধা পালিয়ে এদিক-ওদিক চলে গিয়েছিল। জিয়াউর রহমানের প্রলোভনে পা দিয়েছিল। তবে এসব ছিল অতি নগণ্য, শতকরা পাঁচজনের কম। সেই প্রতিরোধ যোদ্ধারা আজ পর্যন্ত সরকারি স্বীকৃতি পায়নি। অথচ কেউ কেউ দালালি করে সরকারের কাছ থেকে টাকাপয়সা নিয়ে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের জন্য কিছু তো করেইনি বা করতে পারেনি বরং সরকারকে এমনকি বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বোন হাসিনাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছে।
২০২২ সালের সব থেকে নিকৃষ্টতম ঘটনা বা কাজ গাজীপুরের বিএনপি নেতা আলী আজমকে মায়ের জানাজায় ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে কিছু সময়ের জন্য প্যারোলে মুক্তি। এটা সরকারের ভাবমূর্তি ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। প্যারোল না দিত সেটা ছিল এক কথা। কিন্তু মায়ের মৃত্যুতে প্যারোলে ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে জানাজায় হাজির করা এ এক দুর্দান্ত অমানবিক কর্মকান্ড। সরকারেরও বহু লোক এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ কাজে বিরক্ত। আমাদের সবারই পর্যাপ্ত মানবিক গুণ থাকার কথা। কিন্তু আস্তে আস্তে অনেক কিছুই নষ্ট হয়ে গেছে। কবে যে মানবিক গুণগুলো আবার ফিরে পাব, নাকি জীবিতকালে পাব না ঠিক বলতে পারছি না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের দেশ সারা বিশ্বে মানবিক গুণে শ্রেষ্ঠস্থান অর্জন করুক সেটাই প্রত্যাশা করি।
নতুন বছরে সবার মঙ্গল হোক, দেশবাসী পরম প্রশান্তিতে কাটাক, ২০২৩ হোক বিশ্বশান্তির মাইলফলক। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান হোক। দরিদ্রতার কশাঘাত থেকে মুক্তি পাক পৃথিবী। করোনাসহ সব রকম সংক্রামক রোগব্যাধির হাত থেকে বিশ্ব মুক্তি পাক- এ কামনাই করি।
লেখক : রাজনীতিক
www.ksjleague.com