মঙ্গলবার, ১০ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ভাষণ ও বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতির দর্শন

ওয়ালিউর রহমান

স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ভাষণ ও বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতির দর্শন

১০ জানুয়ারি, ১৯৭২। দিনটি সবারই জানা। ৩০ লাখ প্রাণের বিসর্জন, ৪ লাখ নারীর সম্ভ্রমহানি, অগণিত মানুষের ভোগান্তি ও অবর্ণনীয় ধ্বংসলীলার ওপর দাঁড়িয়ে প্রাপ্ত স্বাধীন বাংলাদেশ। শোষণের বন্দিশালা থেকে মুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। অপেক্ষমাণ বাংলার লাখো-কোটি মানুষ। সামনে দাঁড়িয়ে আবালবৃদ্ধবনিতার প্রাণের স্পন্দন, অনুপ্রেরণার বাতিঘর, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শান্তির বার্তা নিয়ে এক অবিস্মরণীয় ভাষণ। বললেন, ‘আমার বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়েছে, আমার জীবনের সাধ আজ পূর্ণ হয়েছে, আমার বাংলার মানুষ আজ মুক্ত হয়েছে।’

স্বদেশের মুক্ত বাতাসে তাঁর এ ভাষণে অভ্যন্তরীণ বিষয়ের পাশাপাশি পররাষ্ট্রনীতির কিছু ভিত্তিস্থাপন পরিলক্ষিত হয়। বাংলাদেশের ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, বুদ্ধিজীবী, হিন্দু-মুসলমান সবাইকে কৃতজ্ঞতা জানানোর পাশাপাশি স্মরণ করলেন ভারত-রাশিয়াসহ মুক্তিযুদ্ধে সহযোগী বন্ধুদের।

‘আমি মোবারকবাদ জানাই ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে, আমি মোবারকবাদ জানাই ভারতবর্ষের জনগণকে, আমি মোবারকবাদ জানাই ভারতবর্ষের সামরিক বাহিনীকে, আমি মোবারকবাদ জানাই রাশিয়ার জনগণকে, আমি মোবারকবাদ জানাই জার্মানি, ব্রিটিশ, ফ্রান্স- সব জায়গার জনগণকে। তাদের আমি মোবারকবাদ জানাই যারা আমাকে সমর্থন করেছেন।’ সে সময় একটি বিষয় স্পষ্ট হওয়া দরকার ছিল, সদ্যস্বাধীনতা প্রাপ্ত বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক কী হবে। বললেন, ‘আসার সময় ভুট্টো আমায় বললেন, শেখসাব দেখেন দুই অংশের কোনো একটা বাঁধন রাখা যায় নাকি। আমি বললাম আমি বলতে পারি না আমি বলতে পারব না আমি কোথায় আছি বলতে পারি না, আমি বাংলায় গিয়ে বলব। আজ বলছি, ভুট্টো সাহেব সুখে থাকো, বাঁধন ছিঁড়ে গেছে, আর না। পশ্চিম পাকিস্তানের ভাইদের বলি তোমরা সুখে থাকো। তোমাদের সঙ্গে আর না, শেষ হয়ে গেছে। তোমরা স্বাধীন থাকো, আমিও স্বাধীন থাকি।’ পাকিস্তান কারাগার থেকে বের হওয়ার সময় ভুট্টোর জবাবে তিনি এ কথা বলতে পারতেন। ভুট্টোর চাল উপলব্ধি করতে পেরে বঙ্গবন্ধু কৌশলগত উত্তর দিলেন, দেশে গিয়ে জানাব। এ থেকে বঙ্গবন্ধুর কূটনৈতিক জ্ঞানের গভীরতা উপলব্ধি করা যায়। আমেরিকা মুক্তিযুদ্ধে স্পষ্টত পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল। স্বাধীনতার পর কৌশলে আমেরিকার সরকারকে উপেক্ষা করে স্মরণ করলেন আমেরিকার জনগণকে।

‘আমি মোবারকবাদ জানাই আমেরিকার জনসাধারণকে, মোবারকবাদ জানাই সারা বিশ্বের মজলুম জনগণকে যারা আমার এই মুক্তিসংগ্রামকে সাহায্য করেছে।’

আমার মনে পড়ে যায়, লর্ড পামারস্টোনের সেই উক্তি, Nations have no permanent friends or allies; they only have permanent interests.

তিনি উপলব্ধি করতে পারছেন দেশ স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু বড় চ্যালেঞ্জ সামনে। অবকাঠামো নির্মাণ ও দেশ গঠন, বহির্বিশ্বের স্বীকৃতি, সদ্যপ্রাপ্ত স্বাধীনতাকে অভ্যন্তরীণ ও বহির্বিশ্বের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সামনে সমুন্নত রাখা। বললেন, ‘দুনিয়ার সব রাষ্ট্রের কাছে আমার আবেদন- তোমরা আমার মানুষকে সাহায্য কর মানবতার খাতিরে, তোমাদের কাছে আমি সাহায্য চাই। দুনিয়ার সব রাষ্ট্রের কাছে আমি সাহায্য চাই। তোমরা আমার বাংলাদেশকে রিকগনাইজ কর। জাতিসংঘের ত্রাণ দাও, দিতে হবে, উপায় নাই দিতে হবে। আমি আমরা হার মানব না, আমরা হার মানতে জানি না।’ টি এস এলিয়ট বলেছেন, And time future is contained in time past. এর পরপরই বিভিন্ন জাতি-রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি হয়। আসতে থাকে স্বীকৃতি। ১৯৭২ সালেই বাংলাদেশ Commonwealth, World Health Organization (WHO), International Labour Organization (ILO), UNCTAD, UNIDO এবং ১৯৭৩ সালে Non Aligned Movement (NAM)-এর সদস্য হয়। এর আগে যারা বাংলাদেশের পক্ষে জাতিসংঘে ভোট দিয়েছিল, তারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার ক্ষেত্রেও অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করে।

সদ্যসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ বিষয়ে আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি সম্মান জানিয়ে বলেন, ‘তবে যারা দালালি করেছে, যারা আমার লোকদের ঘরে ঢুকে হত্যা করেছে, তাদের বিচার হবে এবং শাস্তি হবে। তাদের বাংলার স্বাধীন সরকারের হাতে ছেড়ে দেন, একজনকেও ক্ষমা করা হবে না। তবে আমি চাই স্বাধীন দেশে স্বাধীন আদালতে বিচার হয়ে এদের শাস্তি হবে। আমি দেখিয়ে দিতে চাই, দুনিয়ার কাছে শান্তিপূর্ণ বাঙালি রক্ত দিতে জানে, শান্তিপূর্ণ বাঙালি শান্তি বজায় রাখতেও জানে।’

বিচারের মাধ্যমে অপরাধীদের সাজা দেওয়ার ঘোষণার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করলেন পাকিস্তানি সেনারা ও তাদের দোসররা যে ক্ষমার অযোগ্য অপকর্ম করেছে তার প্রতিবাদস্বরূপ কিছু মানুষ যারা যুদ্ধে ভিকটিম হয়েছে তারা আইন হাতে তুলে নিতে পারে, যেটি যুদ্ধপরবর্তী অহরহই হয়ে থাকে। এমনটি হলে অভ্যন্তরীণভাবে বিশৃঙ্খলা তৈরি এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আইনের শাসন প্রশ্নবিদ্ধ হবে। তাই তিনি বললেন, ‘ক্ষমা কর আমার ভাইয়েরা, ক্ষমা কর আজ আমার কারও বিরুদ্ধে প্রতিহিংসা নেই, একটা মানুষকেও তোমরা কিছু বোলো না; অন্যায় যে করেছে তাকে সাজা দিব, আইন নিজের হাতে তুলে নিও না।’

এ কথাগুলো আমাকে মনে করিয়ে দেয় আব্রাহাম লিঙ্কনের সেই উক্তি,  I have always found that mercy bears richer fruits than strict justice.

ফ্রান্স ফেনন বলেন, To speak a language is to take on a world, a culture.

বঙ্গবন্ধু সে সময় লিডিয়া মারিয়া চাইল্ডের মতো উপলব্ধি করেছিলেন- Law is not law, if it violates the principles of eternal justice.

বঙ্গবন্ধু বললেন বিচার হবে। সে সময় বিচারের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা ও সমর্থন প্রয়োজন ছিল। এজন্য বিশ্ববাসীর প্রতি আহ্বান জানান,

‘ভাইয়েরা আমার, আমার ৪ লাখ বাঙালি আছে পাকিস্তানে; আমি অনুরোধ করব তবে একটা জিনিস আমি বলতে চাই, ইন্টারন্যাশনাল ফোরামে জাতিসংঘের মাধ্যমে অথবা ওয়ার্ল্ড জুরির পক্ষ থেকে একটা ইনকোয়ারি হতে হবে কি পাশবিক অত্যাচার কীভাবে হত্যা করা হয়েছে আমার লোকদের এ সত্য দুনিয়ার মানুষকে জানতে হবে। আমি দাবি করব জাতিসংঘকে বাংলাদেশকে আসন দাও এবং ইনকোয়ারি কর।’

বঙ্গবন্ধুর এ দর্শনগুলো বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের গ্রহণযোগ্যতা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কোন্নয়নে ইতিবাচকভাবে সহায়তা করে। ফ্রেডরিক নিটশের কথা মনে পড়ে। তিনি বলেছেন, If you look at the Ravine below, the Ravine will soon look at you and swallow you.ওপরে তাকাও সামনে তাকাও। বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্তগুলো এরূপ দর্শনের ওপরই দাঁড়িয়ে ছিল।

ডিপ্লোম্যাসি ও পররাষ্ট্র নীতির চিন্তাভাবনায় সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমধর্মী ছিলেন তিনি। তিনি ১৪ বছর জেলে কাটিয়েছেন- সময় কোথায় ছিল। তাঁর দার্শনিক চিন্তার ওপর বাঙালি জাতির ভবিষ্যৎ সম্পর্কের ভিত্তি রচিত হয়।

ফ্রান্স ফেনন (১৯৬৩) বলেন, Each generation must discover its mission, fulfill it or betray it, in relative opacity.

আজ বিশ্বপরিমন্ডলে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গবেষণা করা হয়। তাঁর ভাষণগুলো পর্যালোচনা করা হয়। তাঁর রাজনৈতিক ও দার্শনিক ভাবনাগুলো নিয়ে অধ্যয়ন করা হয়।

সম্প্রতি ৬ ডিসেম্বর, ২০২২ জাতিসংঘে সাধারণ পরিষদের ‘ইন্টারন্যাশনাল ইয়ার অব ডায়ালগ অ্যাজ আ গ্যারান্টি অব পিস, ২০২৩’ রেজুলেশনের চতুর্দশ প্যারায় যুক্ত করা হয় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক উক্তি- ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারও সাথে বৈরিতা নয়’। তাঁর ৭ মার্চের ভাষণকে ৩০ অক্টোবর, ২০১৭ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। নেলসন ম্যান্ডেলা, আব্রাহাম লিঙ্কনদের মতো তিনি আজ বিশ্বনেতা হিসেবে সমাদৃত। একই সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে বাংলাদেশের নাম। আমরা গর্বিত। ইতিহাসে তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

                লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও গবেষক

সর্বশেষ খবর