বাংলা ভাষায় একই শব্দের বহুবিধ অর্থ পড়ানোর সময় ছোটবেলায় বাংলার পণ্ডিত স্যার একটা শ্লোক বলেছিলেন। “হরির উপরে হরি। হরি শোভা পায়, হরিকে দেখিয়া হরি, হরিতে লুকায়”। এখানে ক্রমানুসারে হরির অর্থ পানি, পদ্মপাতা, ব্যাঙ, সাপ আবার ব্যাঙ ও পানি। অর্থাৎ পানির ওপরে ভাসমান পদ্মপাতায় বসা ব্যাঙ সাপ দেখে পানিতে লুকায় বুঝাতে হরি শব্দের এত ছড়াছড়ি। পরবর্তী জীবনে আরও পড়ালেখার সুবাদে জেনেছি ধর্মতত্ত্ব, আধ্যাত্মবাদ ও পৃথিবীতে বংশবিস্তার প্রক্রিয়া সংক্রান্ত উচ্চমার্গীয় ভাব প্রকাশে যে শব্দগুলো ব্যবহার করা যায় তার অনেকগুলোর সমার্থক হলো হরি। দীর্ঘদিন পর বাংলা পণ্ডিত স্যারের কণ্ঠে প্রথম শোনা এ শ্লোকটি মনে পড়ল বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেতার ভারে মঞ্চ ভেঙে নিচে পড়ে যাওয়া সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ‘এত নেতা কেন?’ শিরোনামের খবর পড়ে ও শুনে। ভিডিও ফুটেজ দেখে মনে হচ্ছিল, এই বুঝি তিনি পণ্ডিত স্যারের মতো বলবেন- নেতার ওপরে নেতা, নেতা শোভা পায়, নেতারে দেখিয়া নেতা, নেতাতে পালায়। এরপর তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে তিনি ব্যাখ্যা করবেন নেতা শব্দের বহুবিধ অর্থ, যার অন্যতম সিকি নেতা, আধুলি নেতা, পাতি নেতা, কাউয়া, হাইব্রিড, বসন্তের কোকিল, শীতের পাখি, অতিথি পাখি ইত্যাদি।
যারা মঞ্চ ভাঙার ভিডিওটি দেখেননি তাদের জানাচ্ছি, ৬ জানুয়ারি ২০২৩ শুক্রবার আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ নিজেদের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে সাবেক নেতা-কর্মীদের নিয়ে একটি মিলনমেলা ও শোভাযাত্রার আয়োজন করেছিল। ৬০ থেকে ৯০ দশকের কলেজ ও ভার্সিটি পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের অনেক উৎসুক চোখ এদিন মোবাইল কম্পিউটার এবং টিভির পর্দায় নিবদ্ধ ছিল। মনের অজান্তেই তারা স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী গণআন্দোলন ও পরবর্তীতে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে রাজপথ ও মঞ্চ কাঁপানো ছাত্রলীগের অগ্নিপুরুষ ও অগ্নিকন্যাদের গণমাধ্যমের পর্দায় বা সংবাদপত্রের পাতায় প্রত্যাশা করেছিলেন। তেমন কাউকেই খুঁজে পাওয়া গেল না ছাত্রলীগের এ অনুষ্ঠানে। মঞ্চে ছিল অধিকাংশ নতুন মুখের ছড়াছড়ি। তাদের একটাই পরিচয়, তারা নেতা। ছাত্রলীগের নেতা। সেদিনের প্রধান অতিথি হিসেবে ওবায়দুল কাদের বিকাল সোয়া ৪টায় যখন মঞ্চে ওঠেন তখন তাঁর চারপাশে দুনিয়ার ‘সেলফি নেতা’দের হাট বসে। এ হাটে দৃষ্টিকটুভাবে একজন আরেকজনের গায়ের ওপর ওঠার জোগাড়। এমনই প্রেক্ষাপটে বক্তৃতা শুরু করেন ওবায়দুল কাদের। একপর্যায়ে তিনি বলতে থাকেন, ‘আমি তোমাদের কাছে স্মার্ট বাংলা...’। না, শেষ করতে পারেননি তাঁর কথা। এর আগেই আনস্মার্ট স্টেজ ভেঙে পড়ে। এতে নেতা ওবায়দুল কাদের নিচে পড়ে যান। এ সময় তাঁর শরীরের ওপরে পড়া অন্য নেতাদের শোভা (?) পেতে দেখা যায়। কেউ কেউ এ ছবি বা সেলফিও ধারণ করে। আবার বিব্রত, বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ নেতা ওবায়দুল কাদেরকে দেখে তথাকথিত স্টেজ নেতাদের অনেকেই অন্য নেতাদের আড়ালে লুকান। তাই ছোটবেলার শোনা শ্লোকের কথা স্মরণ করে মনের অজান্তে উচ্চারিত হলো- “নেতার ওপরে নেতা, নেতা শোভা পায়, নেতাকে দেখিয়া নেতা, নেতাতে পালায়”।
![](/assets/archive/images/Print-Edition/2023/01.%20January/27-01-2023/BD-Pratidin_2023-01-27-21.jpg)
মঞ্চ ভেঙে পড়ার এ চিত্র বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি ভেঙে পড়ারই একটি রূপক চিত্র বা সিম্বলিক সাইন বলে মনে করেন অনেক বিশ্লেষক। এখন নেতার পদভারে মঞ্চ ভেঙে পড়ে।
অথচ নির্বাচনের সময় ভোট কেন্দ্র থাকে ভোটারশূন্য। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যে রাজধানীতে মঞ্চে নেতা আধিক্যের কারণে প্রধান অতিথি বক্তৃতা করতে পারেন না, সেই রাজধানীতেই বিগত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী উত্তরে ১৪.৮৪ শতাংশ এবং দক্ষিণে ১৭.৩০ শতাংশ ভোট পেয়ে নৌকা প্রতীকে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। রংপুর সিটি করপোরেশনে গত মাসের ২৭ তারিখে মেয়র নির্বাচনে নৌকা প্রার্থী ৭.৯৭ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। সভা-সমাবেশে কেন্দ্রীয় নেতাদের সামনে নৌকার যাত্রী হতে এত আগ্রহ থাকলেও নিজ দলের নেতাদের নৌকায় ভোট দিতে অনাগ্রহের একটাই কারণ- রাজনীতির নামে ফায়দা হাসিল। বাংলাদেশের নেতা হতে চাওয়ার নেপথ্য কারণ এবং বিচ্যুত হওয়ার একটা কেস হতে পারে ফরিদপুর জেলা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন ফরিদপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন এবং ছাত্রনেতা থেকে জননেতা ও শেষে জাতির পিতা হয়ে ওঠেন। কারণ তিনি বলতে পেরেছিলেন, “আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, এদেশের মানুষের অধিকার চাই”। কালের বিবর্তনে এ ফরিদপুর জেলা থেকেই মুক্তিযুদ্ধবিরোধী পরিবার থেকে একজন আওয়ামী লীগ নেতা, এমপি ও মন্ত্রী হন। যেখানে মুক্তিযুদ্ধে পূর্ব পুরুষের বিরোধিতার কারণে সরকারের পিয়নের চাকরিও মেলে না, সেখানে এভাবে মন্ত্রী হওয়াটা ভেঙে পড়া রাজনীতির একটি দিক বলে ধারণা করেন রাজনৈতিক মহল। পরবর্তীতে এ নেতা বা মন্ত্রীর আশীর্বাদে দুই হাতে টাকা কামান তার আপন ভাই। একই মন্ত্রীর আশীর্বাদপুষ্ট ফরিদপুর জেলার আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন বরকত ও তার ভাই ইমতিয়াজ হোসেন ২ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন বলে দুর্নীতি দমন কমিশন অভিযোগ তোলে। দলের নেতা ও স্থানীয় এমপি হয়েও তিনি দীর্ঘদিন বিদেশে আছেন। জনগণের খোঁজ নেওয়ার কেউ নেই। আবার বিদেশে যাওয়ার আগে তিনি প্রায় ১ কোটি টাকা ব্যয় করে ৮৫টি তথাকথিত উন্নয়ন কাজের দায়িত্ব দেন স্থানীয় নেতাদের। এ টাকা তুলে নেওয়ার পর দেখা যায় ১১ প্রকল্পে কোনো কাজ হয়নি এবং ১৭ প্রকল্পে নামেমাত্র কাজ হয়েছে। অন্যদিকে এ টাকায় স্থানীয় এক নেতার বাড়ির ভিতর শৌচাগার পর্যন্ত রাস্তার কাজ হয়েছে জোরেশোরে। বলাবাহুল্য, ‘মেইড ইন ফরিদপুর’ মার্কা নেতা হওয়ার মন্ত্র হলো স্টেজে ওঠা, সেলফি তোলা, ব্যানার বানানো ইত্যাদি।
দেশের একটি দলে যখন এমন নেতার ছড়াছড়ি তখন অন্য দলে চলছে নেতার খরা, যা গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত। বাস্তবের প্রধান বিরোধী দলের মূল নেত্রী জেলে আর কাগুজে নেতা লন্ডনে। সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা-নেত্রী দলীয় ফোরামের বাইরে আদালতের মাধ্যমে ঠিক করার প্রক্রিয়া চলছে। বাম দলসহ বহু দল আছে নেতাসর্বস্ব। এসব দলের তথাকথিত নেতারা বড় দলের টিকিট বা আশীর্বাদ ছাড়া কখনো এমপি হননি। এমনকি বড় দলের সমর্থন না পেলে স্থানীয় মেম্বার বা চেয়ারম্যান হতে পারবেন না বলে সমর্থন দেওয়া বড় দলের নেতা-নেত্রীরাই বলে থাকেন। ভাবতে অবাক লাগে এমন নেতা মন্ত্রী হন! সারা জীবন সমাজতন্ত্রের কথা বলে বেসরকারি বিমান, টেলিভিশন বা রেডিওর অনুমোদন দেন! জীবনভর ডারউইনের মতবাদ প্রচার করে বিমানের সিটে বসে হজের জন্য এহরামের কাপড় পরা অবস্থায় ছবি তুলে প্রচার করেন! দেশে তেমনভাবে চলচ্চিত্র নির্মিত হয় না, হল বা দর্শকও নেই তেমন। অথচ চলচ্চিত্র শিল্পীদের অনেক নেতা আছেন। এমনকি শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক কে হবেন তা নির্ধারিত হয়েছে সর্বোচ্চ আদালতের মাধ্যমে। ফুটবল ফেডারেশনের বড় নেতা মেসির দল আর্জেন্টিনাকে ঢাকায় আনার আওয়াজ তুলে চুপসে গেছেন। আরেক নেতা, প্রাক্তন ফুটবলার ও বর্তমান এমপি সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন অবৈধভাবে ঢাকায় বাড়ি দখলের অভিযোগে। ফুটবল সংক্রান্ত বিষয়ে অবশ্য তারা একবার শিরোনাম হয়েছিলেন। দেশের নারী ফুটবল দল বিদেশের মাটিতে সাফল্য অর্জন করে দেশে ফিরলে নারী ফুটবলারদের কোণঠাসা করে এবং পেছনের সারিতে পাঠিয়ে সামনে অবস্থান নেন এ নেতারা। নেতার কারণে তাবলিগ জামাতের বিশ্ব ইজতেমাও আজ দুই পর্বে বিভক্ত। একসময় নেতা বলতে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর নাম উচ্চারিত হতো। মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী তাঁর উপাধির প্রতি সুবিচার করেছিলেন। একজন মুজিব ভাই, লিডার ও নেতা বহু জেল, জুলুম এমনকি পুঁতে ফেলার জন্য খোঁড়া কবরের কিনারে দাঁড়িয়েও টাকার কাছে বিক্রি হননি। তাই তো স্বাধীনতার রূপকার এবং জাতির পিতা। আর এভাবেই তিনি কর্মী থেকে নেতা হওয়ার শিক্ষা দিয়ে গেছেন। কিন্তু আজ নেতার নামে যা হচ্ছে তা দেখে কেবল একটি রবীন্দ্র সংগীতই শোনা চলে- “আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে, নইলে মোরা রাজার সনে মিলবো কী স্বত্বে, আমরা সবাই রাজা”।
লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট
Email : [email protected]