মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি আবদুল্লাহ বীরপ্রতীককে পেয়েছিলাম। একটা মানুষ কতটা সহজ সরল হতে পারে আবদুল্লাহ বীরপ্রতীক তার জ্বলন্ত প্রমাণ। কোনো লেখাপড়া জানে না। কিন্তু তার শরীরজুড়ে ভালোবাসা। জীবজন্তু, তরুলতা, আকাশ-বাতাস, নদীনালা সবকিছুকে যে একই রকম ভালোবাসতে পারে তার নাম আবদুল্লাহ বীরপ্রতীক। গ্রামের বাড়ি ভালুকার তামাইট। কী করে ১৫-১৬ বছর বয়সে টাঙ্গাইল এসেছিল জানি না। একজনের বাড়িতে কাজ করে খেতো। মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে পাহাড়ে গিয়েছিল। স্বাস্থ্যগতর ভালো ছিল না বলে মুক্তিবাহিনীতে নেওয়া হয়নি। মাসখানেক পর আবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিল। তৃতীয়বার গিয়েছিল ব্রিগেডিয়ার ফজলুর রহমানের কাছে। আবদুল্লাহর ইচ্ছা ছিল যদি মুক্তিবাহিনীতে নেয় নেবে, ভর্তি হতে পারে হবে, না হয় সে রাজাকারে যাবে। দেশে যুদ্ধবিগ্রহ চলছে। তাই কোনোক্রমেই ঘরে বসে থাকা চলবে না। কপাল ভালো তৃতীয়বার তাকে রাজাকারে যেতে হয়নি, মুক্তিবাহিনীতে ভর্তি হতে পেরেছিল। সহজসরল একজন দেশপ্রেমিক হিসেবে অবশ্যই আল্লাহ তাকে দয়া করেছিলেন। যে কারণে একজন সফল মুক্তিযোদ্ধা হয়েছিল, বীরপ্রতীক খেতাব পেয়েছে। দুই মেয়ে, দুই ছেলের বাবা। ছোট মেয়ে জুঁইয়ের চট করে বিয়ে হয়ে গেছে। তেমন বেশি লেখাপড়া করেনি। কিন্তু বড় মেয়ে জ্যোতি ভালো ফল নিয়ে এমএ পাস করেছে। বড় ধর্মভীরু মেয়ে। সব সময় বোরকা পরে থাকে। কেউ ভালো করে মুখ দেখতে পারে না। দুবার বিসিএস দিয়েছে। মাস্টার্সে জ্যোতির রেজাল্টও ছিল বেশ ভালো। আবদুল্লাহর মেয়েজামাইয়ের বাড়ি সখিপুর আড়াইপাড়ার কাছে। মেয়েজামাই মোর্শেদ খান দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকে। আয়-রোজগার খুবই ভালো। আড়াইপাড়া, মাওনা চৌরাস্তায় আরও বেশ কিছু জায়গাজমি বাড়িঘর আছে। বাপদাদার জমির ওপর কোটি টাকা খরচ করে বাড়ি করেছে। নাম দিয়েছে জুঁই ভবন। বেশ কিছুদিন হয় আবদুল্লাহ বীরপ্রতীক তার মেয়ের বাড়ি যেতে অনুরোধ করছিল। আবদুল্লাহর অনুরোধ ফেলতে পারি না। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে দেখা হওয়ার পর আজ ২০২৩ সাল কতজন কত রং বদল করেছে। কিন্তু আবদুল্লাহ আবদুল্লাহই। তার রঙে কোনো জোয়ারভাটা নেই। আমার সঙ্গে আছে তো আছেই। দীপ-কুঁড়ি-কুশিকে কোলেকাঁখে মানুষ করেছে, বড় করেছে। ৪ ফেব্রুয়ারি কচুয়ার আবদুল্লাহর ছেলে শুভর ছিল শুভ বউভাত। জীবনে প্রথম সখিপুর উপজেলা মাঠে কারও বউভাতের দাওয়াতে গিয়েছিলাম। কচুয়ার আবদুল্লাহ স্বাধীনতার পরপরই জাসদ করা শুরু করেছিল। গণবাহিনী করেছে। দাওয়াতে গিয়ে জাসদের অনেক লোকজন দেখলাম আর ভাবলাম, এরা যদি স্বাধীনতার পরপরই বঙ্গবন্ধুকে ধ্বংস করার চেষ্টা না করত আজ দেশের অবস্থা এমন হতো না। এর চাইতে অনেক ভালো হতো।
কয়েকদিন থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধা তামাইটের আবদুল্লাহ বীরপ্রতীকের অনুরোধ ছিল কচুয়ার আবদুল্লাহর ছেলের বিয়েতে গেলে আমি যেন ওর মেয়ে জুঁইয়ের শ্বশুরবাড়ি দেখে আসি। তাই গিয়েছিলাম। আড়াইপাড়া বাজারে জুঁইয়ের বরের বেশ অনেকটা জায়গা আছে। সেখানে ২-৩ ডেসিমলের ওপর পাঁচ তলা দালান করেছে। পাশে আরও ৪০-৫০ শতাংশ জায়গা খালি পড়ে আছে। মার্কেট বানাবে। আড়াইপাড়া বাজার থেকে ১ কিলোমিটার দূরে ডাকাতিয়া পশ্চিমপাড়া জুঁইয়ের শ্বশুরবাড়ি। আগে থেকেই ওরা ধনী। চার ভাইয়ের পূর্বে-পশ্চিমে লম্বা দক্ষিণমুখী কয়েক একর জায়গা জুড়ে বাড়ি। নতুন দালানঘরে নিয়ে গিয়েছিল। মনে হয় হাজার-বারো শ স্কয়ার ফুটের দোতলা নতুন ঘর। আমরা এক জায়গায় দুপুরের খাবার খেতে গেছি। তার পরও গিয়ে দেখি এলাহি কারবার। মাছ-মাংস-সবজি-ভাজি কত রকম কত কী যে করেছে, বলে শেষ করা যাবে না। ’৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে সখিপুর থেকে কচুয়া গিয়ে হামিদুল হক বীরপ্রতীক ও খোরশেদ আলমকে পেয়েছিলাম। অর্ধেক পথ গিয়ে খোরশেদ আলম চলে এসেছিল বাড়িতে বলে আসেনি বলে। কিন্তু হামিদুল হক আর বাড়ি ফেরেনি। আড়াইপাড়া, ফুলবাড়ি আরও বহু জায়গা ঘুরে ইপিআরের ফেলে যাওয়া অস্ত্রশস্ত্র ডাকাতিয়ার পরশুরাম মেম্বারের বাড়ির মাটির নিচ থেকে তুলে এনেছিলাম। অনেক অস্ত্র ছিল। ৩-৪ শ মুক্তিযোদ্ধার হাতে দেওয়া হয়েছিল। সেখানে টু ইঞ্চি মর্টার, রকেট লঞ্চার, এলএমজি, দুই-আড়াই শ থ্রি নট থ্রি রাইফেল ছিল। টাঙ্গাইলের মুক্তিযুদ্ধে কাদেরিয়া বাহিনীর জন্য দুটি ঘটনা ছিল আল্লাহর আশীর্বাদ। একটা একেবারে শুরুতে ডাকাতিয়া পরশুরাম মেম্বারের বাড়ির মাটির নিচে লুকিয়ে রাখা গোলাবারুদ, অন্যদিকে ১১ আগস্ট ধলেশ্বরী যমুনা নদীতে আক্রমণ করে হানাদারদের বিশাল অস্ত্রবোঝাই দুটি জাহাজ দখল। বিপুল পরিমাণ অস্ত্র জাহাজ থেকে নামানো হয়েছিল; কখনো তার হিসাব মেলাতে পারিনি। শুরুতেই ইপিআরের অস্ত্র, মাঝপথে জাহাজ দখল, স্বাধীনতাযুদ্ধের একেবারে শেষ পর্যায়ে জামালপুর এবং ময়মনসিংহ দুই ব্রিগেড হানাদার বাহিনীর সব মজুদ আমাদের হাতে পড়েছিল। সে কারণে আমাদের অস্ত্রভান্ডার ফুলে ফেঁপে উঠেছিল। তাই আড়াইপাড়ার কথা আমার দেহমনে সব সময় দোল খায়। ৪ ফেব্রুয়ারিও আড়াইপাড়া আমার মনে নাড়া দিয়েছে। বছর আট-দশ হলো নয়ন নামে একটি ছেলে আমার হৃদয়মন জুড়ে আছে। আট-দশ বছর আগে আড়াইপাড়া স্কুল-মাদরাসা মাঠে ইফতারের আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে আমার গা ঘেঁষে নয়ন নামে চটপটে একটি ছোট্ট ছেলে বসেছিল। তার কাছাকাছি ছিল আরও দুজন। তাদের বিরুদ্ধে বিচার দিচ্ছিল, জানেন দোস্ত, ওরা না মিটমিট করে হাসে। ওরা ভালো না। সেই থেকে নয়নের সঙ্গে আমার পরিচয়। নয়নের পাশের বাড়ি এক রাত ছিলাম। বছর কয়েক আগে আট-দশ জন আত্মীয় নিয়ে নয়ন আমার টাঙ্গাইলের বাড়ি এসেছিল। দুপুরে আমার সঙ্গে খেয়েছিল। অনেক মজার মজার গল্প করেছিল। আবদুল্লাহর মেয়ের বাড়ি আবদুল হালিম লাল মিয়া গিয়েছিল। গিয়েছিল আলমগীর, নুরু খান, আবদুল আজিজ, রাজু। দীর্ঘদিন ডায়াবেটিস থাকায় তেমন কোনো মিষ্টি মুখে দিই না। কিন্তু কী করে যে জুঁইয়ের তৈরি পায়েস মুখে দিয়েছিলাম। খুবই ভালো লেগেছিল। তাই ছেলেমেয়ে এবং বউয়ের জন্য পাঠিয়ে দিলাম। এমনিতে কোনো জিনিস ভালো লাগলে অচেনা বাড়ি হলেও ছেলেমেয়ের জন্য নিয়ে নিই। কে কী ভাবল ওসব আমার ভাবনায় নেই। অভ্যাসটা ছোটকাল থেকেই। তখন কেউ পাত্তা দিত না। মাঝেসাজে বিব্রত হতে হতো। মুক্তিযুদ্ধের পর অনেকেই ভালোবেসে সম্মান করে তাই কিছু নিয়ে আসতে চাই শুনলে ছোটলোক না ভেবে আগ্রহ করে অনেক কিছু দিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। আমিও অনেক কিছু নিয়ে আসি। সেদিনও পায়েস এনেছিলাম। সেখান থেকে সিলিমপুর হয়ে টাঙ্গাইল ফিরেছিলাম। সিলিমপুরে এক মজার ঘটনা ঘটেছিল। অনেক পানির কল আছে সেখানে। ৩ ইঞ্চি আর ২ ইঞ্চিই বেশি। ২ ইঞ্চি সাব মারসিবল পাম্পে জটিলতা কম। ৩ ইঞ্চি মোটর ওভারহেড পাম্পে জটিলতা একটু বেশি। তবে পানি ওঠে অনেক বেশি। মাসখানেক আগে একটা ৩ ইঞ্চি পাম্পের পাইপ নিচে ফেলে দেয়। কাকে কী বলব! ৫ ইঞ্চি বোরের একটি পাম্প। বোর করতে পাইপসহ খরচ পড়ে ৩০-৩৫ হাজার। তা-ও আজ থেকে ১০ বছর আগের কথা। ভিতরে ৩ ইঞ্চি থ্রেড পাইপ তার দামও প্রায় ১২ হাজার। পিতলের চেক বাল্বের দাম সাড়ে ৪ হাজার। সব মিলিয়ে প্রায় ৫০ হাজারের মতো। ভিতরে পাইপ পড়ে যাওয়ায় সবটাই অকেজো। নবাবপুরে যাদের কাছ থেকে এটাওটা কিনি, কৃষিকাজের যন্ত্রপাতি, পাম্প, মেশিন, কাপড়ের পাইপ তাদের কয়েকবার বলেছি। কেউ ১০ হাজার, কেউ ১৬ হাজার, নানা রকমের দরদাম করেছে। পাইপ ওঠাতে পারলে পুরোটাই, না পারলে হাফ। আজ প্রায় ২৫ বছর যাবৎ আমার বাড়ির পানির কাজ করে আসকর। ভালোও করে খারাপও করে। একটা ভাঙে আরেকটা লাগায়। ২৫ বছর একইভাবে চলছে। হঠাৎই আমাদের সর্বকর্মে বিশেষজ্ঞ রবীন্দ্রনাথ সূত্রধর বলছিল, আসকর বলেছে সে পড়ে যাওয়া পাইপ তুলতে পারবে। তাই তারা গিয়েছিল। সত্যিই পাইপ তুলেছে। একজন সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল তার মজুরি ৭০০। আসকরের ৮০০, রবীর ৫০০। এতেই তারা খুশি। আমার মনে হচ্ছিল একটা ছোটখাটো অবিচার হচ্ছে। কেউ কেউ ১২ হাজার, ১৬ হাজার চাচ্ছিল, আমিও রাজি ছিলাম। এদের ৮ আর ৭=১৫, রবি ৫। মোট ২ হাজার। মনে হলো বড় অবিচার হচ্ছে। তাই আসকরকে আরও ২ হাজার বকশিশ দিয়েছি। পড়ে যাওয়া সেই পাম্প থেকে এখন অবিরাম পানি উঠছে।
লেখক : রাজনীতিক
www.ksjleague.com