বাংলাদেশের মানুষ সবচেয়ে বেশি কর দিয়ে থাকে। দেশের ভোগ্যপণ্যের বেশির ভাগ আমদানিনির্ভর। অথচ সব আমদানি পণ্যের ওপর রয়েছে বিভিন্ন মাত্রার বিবিধ উচ্চ শুল্ককর। এই শুল্ককর থেকে কারও রেহাই নেই। অজপাড়া গ্রামের একজন খেটে খাওয়া মানুষ যে হারে এবং যে পরিমাণ বিভিন্ন শুল্ককর দেয়, একজন উচ্চ বিত্তশালীও একই পরিমাণ শুল্ক কর দেয়। কর মানে শুধু আয়কর বোঝায় না। জনগণ রাষ্ট্র থেকে সুবিধা পাইতে গিয়ে যত ধরনের কর দেয় তা সবই জনগণের প্রদেয় কর। আয়কর জনগণের আয়ের ওপর কর। কিন্তু আমাদের সার্বিক জীবন এত নিচুতে যে, বলতে গেলে দেশের প্রায় তাবৎ জনগোষ্ঠী তাদের স্বাভাবিক দৈনন্দিন চাহিদার অর্ধেকাংশ ভোগ করা সম্ভব হয় না। হয়তো তার ৫ লাখ টাকার ওপর আয় আছে। কিন্তু তার পরিবারের ব্যাপ্তি ও চাহিদা এর চেয়ে অনেক বেশি। একজন উপার্জনক্ষম ব্যক্তির পরিবার বলতে গেলে পশ্চিমা দেশের মতো শুধু স্বামী-স্ত্রী ও ১৮ বছরের নিচের সন্তানকে বোঝায় না। আমাদের পরিবারের ব্যাপ্তি অনেক। স্বামী-স্ত্রী তো আছেই, তার ওপর ১৮ বছরের বেশি বয়সের অনেক ছেলেমেয়ে, বাবা-মা, দাদা-দাদি, নানা-নানি, ভাই-বোন, ভাই-বোনের পরিবার, বিধবা বোন, তাদের সন্তান, মৃত ভাইয়ের বিধবা স্ত্রী, তাদের সন্তানাদিও রয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে সামাজিক দায়বদ্ধতা, সামাজিক প্রতিষ্ঠান তথা স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মাদরাসা, মন্দির, সামাজিক গোরস্থান প্রতিষ্ঠা ও রক্ষণাবেক্ষণ, স্থানীয় পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের সহযোগিতা করা, পাড়া-প্রতিবেশী ও গরিব আত্মীয়স্বজনকে সাহায্য-সহযোগিতা করা, রাজনৈতিক কর্মকান্ডে তহবিল জোগানো- ইত্যাকার খায়-খরচ একজন নাগরিককে প্রতিনিয়ত পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে বহন করতে হয়। তাছাড়া আয়কারী ব্যক্তিকে রাষ্ট্রীয় সুযোগ বা কোনো সেবা ভোগ করতে হলে উপজেলা, জেলা বা কেন্দ্রীয় পর্যায়ে ত্রাণ বা চাঁদা দিতে হয়। এ ছাড়া সামাজিক অনুষ্ঠান তথা বিয়েশাদি, জন্ম বা মৃত্যু দিন পালন, ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিতে আর্থিক অবদান রাখতে হয়। তারপর বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানাদি যেমন স্বাধীনতা বা বিজয় দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারি ইত্যাদি থাকে যেখানে আর্থিক অবদান না রাখলে সরকারের কুনজরে পড়ার আশঙ্কা থাকে।
আমাদের জীবনযাত্রা বিদেশি তথা পশ্চিমাদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। একটি সহজ-সরল ও সাধারণ জীবনযাপন করতে গিয়ে আমাদের ভিন্ন পরিবেশ ও পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়, যা কোনো উন্নত দেশের মানুষকে কখনই মোকাবিলা করতে হয় না। তাদের ব্যাপ্তি নিজেদের মধ্যেই। এমনকি স্বামী-স্ত্রী বা সন্তানদের দায়-দায়িত্ব যার যার নিজের। রাষ্ট্র তাদের সব ভোগ-বিলাসের ব্যবস্থা করে দেয় যা যার যার নিজের মতো করে মূল্যের বিনিময়ে ভোগ করতে পারে। আমাদের দেশে তার উল্টো। এখানে সরকারকে পালন করতে হয় জনগণকে শোষণ ও শাসন করার জন্য। রাষ্ট্র জনগণকে কিছুই দেবে না, কিন্তু বিভিন্ন বাহানায় জনগণের পকেট কাটবে। রাষ্ট্র সরকারের জন্য জনগণকে কর দিতে বাধ্য করবে। কিন্তু করের ব্যবহার কীভাবে হবে তাতে জনগণের মতামত দেওয়ার কোনো অধিকার থাকবে না। সরকারের বা ব্যবসায়ীদের নির্ধারিত মূল্যে জনগণ সব সেবা ক্রয় করতে বাধ্য হবে, কিন্তু প্রকৃত মূল্য যাচাই বা দর-কষাকষি করার কোনো সুযোগ পাবে না। প্রকৃত বা ন্যায্যমূল্যে কোনো সেবা জনগণকে দেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করার কোনো প্রচেষ্টা বা জনগণের কাছে জবাবদিহি করার কোনো দায়বদ্ধতা সরকারের নেই। পাশাপাশি বিচক্ষণতা ও পারদর্শিতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন না করে স্বেচ্ছা তথা যথেচ্ছারের মাধ্যমে অত্যন্ত নিম্নমানের ও অতি উচ্চমূল্যে সেবা প্রদান করে জনগণের অর্থের অপব্যয় বা অপচয় করে তার দায়ভার উচ্চকর দিয়ে জনগণকে বহন করতে বাধ্য করা হচ্ছে। অথচ জনগণ ব্যাপকহারে কর দিচ্ছে কিন্তু সেই পরিমাণ সেবা জনগণ সরকারের কাছ থেকে পাচ্ছে না। এর মূল কারণ হচ্ছে, কর আদায় ও ব্যবস্থাপনায় চরম দুর্বলতা, ভ্রান্ত করনীতি, সরকারের এক ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা ও জবাবদিহিতার চরম নেতিবাচক অবস্থান। এসব কারণ আরও বেশি প্রকট হয়ে যাচ্ছে বর্তমান সরকারের একচ্ছত্র রাজনৈতিক অবস্থা ও দাপট। যদিও এর জন্য দেশের নেতিবাচক বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষ মূলত দায়ী বলে অনেকে মনে করেন। বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষ সরকারকে তার কার্যক্রম পরিচালনায় কোনো চাপের মধ্যেই রাখতে পারছে না। তারা সরকারের কোনো কার্যক্রমকেই চ্যালেঞ্জ করতে পারছে না। আবার সমর্থনও দিতে পারছে না। সরকারের সব কাজ যেমন ভালো, তেমনি খারাপও নয়। সরকারের যে সব কাজ ভালো তথা জনগণের স্বার্থে নয় সেগুলোকে প্রতিহত করার কর্মসূচি অবশ্যই বিরোধী পক্ষের থাকতে হবে যাতে জনগণের মধ্যে ধারণা থাকবে বিরোধীদের বিকল্প কর্মসূচি সম্বন্ধে। বিরোধী পক্ষের বিকল্প কর্মসূচি দেখে জনগণ তাদের অবস্থান যেমন পরিবর্তন করতে পারে তেমনি প্রয়োজনে বিকল্প কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে সরকারকে বাধ্য করতে পারে। আবার সরকার জনগণের জন্য ভালো কোনো কর্মসূচি নিলে তা বিরোধী পক্ষ জনস্বার্থে তা সমর্থন ও বাস্তবায়নে সাহায্য বা সহযোগিতাও করতে পারে। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য হলো- বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষ এ ধরনের গঠনমূলক রাজনীতিতে অভ্যস্ত নয়। তারা যেন নিজেদের স্বার্থে নিজেদের চক্রেই ঘোরপাক খাচ্ছে!
উনার মূল্যবান বক্তব্যে আমি চারটি নেতিবাচক বা আশঙ্কামূলক বক্তব্য দেখতে পাই, তার প্রথমটি হলো, “তবে এটা ডলার সংকট এড়াতে খুব একটা কার্যকর ভূমিকা রাখবে না। কারণ পরিমাণ খুবই কম।” দ্বিতীয়টি হলো-“তবে ব্যাপারটা হলো, যেসব সংস্কারের কথা তারা বলেছে, সেগুলো তো আমরা অনেক আগে থেকেই বলে আসছি। কিন্তু সরকার তা করেনি। এখন তো বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়েছে। ফলে সংস্কারগুলো করতেই হবে। নইলে তো তারা ঋণের কিস্তি আটকে দেবে”। তৃতীয়টি হলো, “আর সংস্কার কর্মসূচিগুলো কিন্তু আমাদের জন্য বেশ ভালো এবং উপযোগী। বিশেষ করে ব্যাংক খাতের কাঠামোগত সংস্কার, খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনা, রাজস্ব খাতের সংস্কার ইত্যাদি। তবে এখানে একটা কথা বলা যায়, এই ঋণ অর্থনীতিতে রূপান্তরগত তেমন কোনো প্রভাব ফেলবে না। যেমন জিডিপি প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এসবের ক্ষেত্রে তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না।” চতুর্থ তিনি বলেছেন, আরও শর্ত আসিতেছে। তিনি বলেছেন, ‘এখানে আরেকটা বিষয় জানা জরুরি, প্রকাশিত সংস্কার কর্মসূচিগুলোর বাইরে আরও কী ধরনের শর্ত রয়েছে সেগুলো তো এখনো অপ্রকাশিত রয়েছে। সেটার জন্য আরও অপেক্ষা করতে হবে।”
একই দিনে একই সংবাদপত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সাহেবও উনার মূল্যবান বক্তব্য রেখেছেন যা আমি হুবহু তুলে ধরলাম। তিনি উনার বক্তব্যে বলেছেন, “এটা ইতিবাচক যে, ঋণ অনুমোদনের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তারা প্রথম কিস্তি ছাড়ও করেছে। এটা আমাদের জন্য বেশ ইতিবাচক। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে একটা ইতিবাচক বার্তাই যাবে। এতে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ (এডিবি) অন্য উন্নয়ন-সহযোগীরাও উৎসাহিত হবে, যা বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে এক ধরনের আশার সঞ্চার করবে। তবে ডলার সংকট এখনই কেটে যাবে, এমনটা নয়। ব্যালেন্স অব পেমেন্টেও খুব একটা প্রভাব ফেলবে না এই ঋণ। কিন্তু এই সংকটের মধ্যে এটার খুব প্রয়োজন ছিল। আইএমএফ তো একটা মানদন্ড মেনেই ঋণ কর্মসূচি চালায়। তারা অনেক কিছু হিসাব করে। অর্থনীতির গভীরতা, সক্ষমতা, ঝুঁকি মোকাবিলার সক্ষমতা এসবও তারা বিবেচনা করে। অর্থাৎ আমরা মোটামুটি সঠিক পথেই আছি। যেমন শ্রীলঙ্কায় কিন্তু যায়নি আইএমএফ। আমাদের কাছে এসেছে। এর মানে এটা প্রমাণ করে যে, আমরা সংকটের মধ্যেও অনেকটা ভালো আছি। কিন্তু একটা বিষয় খুবই জরুরি, আইএমএফ যেসব সংস্কারের কথা বলেছে সেগুলোতে আমাদের জোর দিতে হবে। সংস্কারমূলক কাজগুলো করতে পারলে অর্থনীতির ভিত আরও শক্তিশালী হবে। বিশেষ করে ব্যাংক খাতের আমাদের যে বদনামটা আছে, যেমন খেলাপি ঋণ, ঋণে অনিয়ম- এগুলো কমাতে হলে কাঠামোগত সংস্কার কিন্তু আনতেই হবে। আর আইএমএফের ঋণের বাকি কিস্তিগুলো পেতে হলে তো এসব সংস্কারে হাত দিতেই হবে। তবে তারা ভর্তুকি কমানোর ব্যাপারে যে শর্ত দিয়েছে সেটি তো আর গণহারে করা যাবে না। যেমন কৃষি খাতে তো আমাদের ভর্তুকি রাখতেই হবে। সরকারও অবশ্য এ ব্যাপারে অনড় অবস্থানেই রয়েছে। এটাও একটা ভালো দিক বলে তিনি মনে করেন।”
সাবেক গভর্নর সাহেবের বক্তব্যেও আশঙ্কার সম্ভাবনা ফুটে উঠেছে। তিনি রাখডাক না রেখেই বলেছেন, “তবে তারা ভর্তুকি কমানোর ব্যাপারে যে শর্ত দিয়েছে সেটি তো আর গণহারে করা যাবে না। যেমন কৃষি খাতে তো আমাদের ভর্তুকি রাখতেই হবে। সরকারও অবশ্য এ ব্যাপারে অনড় অবস্থানেই রয়েছে। এটাও একটা ভালো দিক।” আমরা সাবেক গভর্নরের সঙ্গে একমত। কৃষি খাতে ভর্তুকি কমানো তো প্রশ্নই ওঠে না এবং তা বাড়াতে হবে। একইভাবে গণহারে প্রতিশ্রুত সব সংস্কার করা যাবে না, কর ও সুদহার কোনোটাই বাড়ানো যাবে না। এমনিতেই সুদের হার বেশি এবং জনগণের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর অনেক বেশি।
রাজস্ব ফাঁকিতে ‘তেভাগা’ ব্যবস্থার ব্যাপারে সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদের সঙ্গে আমরাও একমত এবং মনে করি ‘যারা কর আদায় করে, তারা যদি আইন প্রণয়ন করে, তাহলে অবশ্যই স্বার্থের সংঘাত তৈরি করে।’ তাই আমাদেরও সুস্পষ্ট বক্তব্য করারোপ করার ক্ষমতা তথা এসআরও এর মাধ্যমে এনবিআর থেকে ফিরিয়ে আবারও সংসদে নিয়ে যেতে হবে।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য