শিরোনাম
রবিবার, ৫ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা
রৌদ্র ছায়া

কুঁজোরও ইচ্ছে করে চিত হয়ে শুতে

মাকিদ হায়দার

কুঁজোরও ইচ্ছে করে চিত হয়ে শুতে

‘বাপের যদি বেটা হই, লাফ দিয়ে পগার পার হই’। সেই পগার অনেকেই লাফ দিয়ে পার হয়ে গিয়েছিলেন ভারতে। আবার সাত সাগর চৌদ্দ নদী এবং হাজারখানেক পগার পাড়ি দিয়ে রাতের আঁধারে অনেকেই গিয়ে উঠেছিলেন ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। পগার পাড়ি দিয়ে এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় গিয়ে কেউ স্থায়ী হয়েছেন ইউরোপ এবং আমেরিকায়।  এমনকি ভারতের আসাম-মেঘালয়ে। ১৯৪৭-এ দেশকে ভাগ করেছিল ব্রিটিশরা এবং ’৪৬ সালের হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গায় দুই সম্প্রদায়ের নিরীহ মানুষগুলোকেই প্রাণ দিতে হয়েছিল, ’৪৭-এর পরে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে পাড়ি দিয়েছিলেন তৎকালীন পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জেলায়। ’৬৪-তে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পুনরায় দাঙ্গা বাধায় তৎকালীন সরকারের উদ্দেশ্য ছিল সাম্প্রদায়িকতাবাদী মনোভাব উসকে দেওয়া। একই উদ্দেশে ’৬৫ সালে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পাকিস্তান পরাজিত হলেও স্বীকার করেনি। আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে, পাকিস্তান এয়ারফোর্সের পক্ষ থেকে একটি বোমা ফেলা হয়েছিল কুর্মিটোলার আশপাশে। তাতে এক কিশোর নিহত হয়েছিল। তৎকালীন রেডিও পাকিস্তান করাচি থেকে রাতের বাংলা খবরে ভারতের কথিত বিমান হামলার খবর জানালেন খবর পাঠক সরকার কবির উদ্দিন। পরের দিন রাতে ওই খবরটি একটু ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে পাঠ করেছিলেন সম্ভবত ইমরুল চৌধুরী অথবা মুজিবুর রহমান খাঁ। যেন পূর্ব-পাকিস্তানিরা ভারতবিদ্বেষী মনোভাব পোষণ করেন। তৎকালের গভর্নর মোনেম খাঁ এক ভাষণে জানিয়েছিলেন, ’৬৫ সালের যুদ্ধে পাকিস্তান জিতেছে। আসলে পুরোটাই ছিল মিথ্যা কথা। যুদ্ধের সময়কাল ছিল মাত্র ১৭ দিন। এরই মধ্যে পাকিস্তান সরকার হাজার হাজার বিহারি নামধারী ভারতীয় উর্দুভাষী মুসলমানকে ভারত থেকে এনে তাদের চাকরিসহ জায়গা দিলেন চট্টগ্রাম, ঈশ্বরদী, পার্বতীপুর, ঢাকার মোহাম্মদপুর এবং মিরপুরে। শুধু যে ভারতের উর্দুভাষীরা এসেছিল তা নয়, বাঙালিরাও এসে রাজশাহী, ঢাকায় এবং চট্টগ্রামসহ সমগ্র উত্তরবঙ্গে আশ্রয় নেয়। দিনাজপুরে রিফিউজিরা চাকরি পেলেন রেলে এবং সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে।

পরবর্তীতে সেই রিফিউজিদের ভিতরে একজন হয়েছিলেন সংসদের স্পিকার। গত শতকে ধানের শীষ যখন রাষ্ট্র ক্ষমতায়, মাঝখানে অনেক বছর পেরিয়ে এলো ইয়াজউদ্দিন সরকার ২০০৭-০৮ সালে। সেই সময়ে আজকের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ২০০১-০৬ সালের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ইয়াজউদ্দিন গং জেলে পাঠিয়েছিলেন। অনেকে আত্মগোপন করেছিলেন। নির্বাচনে জিতে ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করলেন। ধানের শীষের পরাজয় অনেকেই মেনে নিতে পারেননি। কেউ কেউ পালিয়ে গিয়ে নিজের জীবন রক্ষা করেছেন পশ্চিমা দেশে। ইতোমধ্যে অনেক বছর পর একটি চমৎকার লেখা বাংলাদেশ প্রতিদিনে প্রকাশিত হয়েছিল। লিখেছিলেন মাননীয় সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। তার লেখায় পাঠকদের জানিয়েছিলেন পুরনো কথা। ভারত থেকে রিফিউজি হয়ে আসা, বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদের মহাসচিবের পিতা ছিলেন পাকিস্তানপ্রেমী। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের পর মহাসচিবসহ পালিয়ে গিয়েছিলেন তাদের পূর্বপুরুষের ভিটেবাড়ি ভারতে। জনাব মানিক বাংলাদেশ প্রতিদিনের পাঠকদের জানিয়েছিলেন ধানের শীষের মহাসচিবের পিতা ছিলেন রাজাকার। স্বাধীন হওয়ার পরেও দীর্ঘদিন ভারতে কাটিয়ে ’৭৫-পরবর্তী সময়ে দেশে ফিরেছিলেন দিনাজপুরের ঠাকুরগাঁও মহকুমায়।

আমি বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থার জনসংযোগ কর্মকর্তা ছিলাম তখন একদিন বিসিকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীন (সিএসপি)-সহ গিয়েছিলাম ঠাকুরগাঁওয়ে বিসিক শিল্পনগরী স্থাপনের লক্ষ্যে। আমরা ঢাকায় ফিরে আসার কিছুদিন পরেই ঠাকুরগাঁওয়ের মির্জা পরিবারের ঢাকায় ইডেন গার্লস কলেজ অথবা হোম ইকোনমিক্স কলেজের একজন শিক্ষিকা- আকতারী বেগমকে বিসিকে নিয়োগ দিলেন, আমেরিকান এইডের উইডিপিতে [উইমেন্স এন্টারশিপ প্রজেক্টে]। তখনই আকতারী আপা চেয়ারম্যান মহোদয়ের নির্দেশে এমএ পাস করা মেয়েদের অনেককে চাকরি দিলেন এবং তার কিছুদিন পরেই মেয়েগুলোকে নেদারল্যান্ডস, সিঙ্গাপুর ও ফিলিপাইনে পাঠালেন। বিসিকের আগের দুর্নাম ঘুচে গেল এবং চেয়ারম্যান মহোদয়ের সাক্ষাৎকার বিটিভিতে, পত্র-পত্রিকায় প্রচার হওয়ার ফলশ্রুতিতে অন্য জনাকয়েক সিএসপি শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীনের নামে অপবাদ দেওয়ায় তাকে অন্যত্র যেতে হলো। সিরাজুদ্দীন সাহেব যাওয়ার দিনকয়েক পরেই এলেন সিএসপি মুশফিকুর রহমান। তিনি বিসিকে ছিলেন প্রায় পাঁচ বছর। তিনি বদলি হওয়ার পরে এলেন সিএসপি ফয়জুর রাজ্জাক।

আমার চাকরিজীবনে পেয়েছিলাম অনেক ইপিসিএস। সর্বশেষ এলেন সিএসপি আবদুল মান্নান। বর্তমানে সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী। ইতোমধ্যে সব চেয়ারম্যানই আমাকে একাধিকবার বিদেশ পাঠিয়েছিলেন। এমনকি সিরাজুদ্দীন সাহেব প্রথম পাঠিয়েছিলেন হিউম্যান রিসার্চের ওপর লেখাপড়া করতে ফিলিপাইনের ম্যানিলা বিশ্ববিদ্যালয়ে। মুশফিকুর রহমান এবং ফয়জুর রাজ্জাক পাঠিয়েছিলেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশে দীর্ঘ এবং স্বল্পমেয়াদি কোর্সে একাধিকবার। চাকরির অবসরে যাওয়ার সময় এগিয়ে এলেও ইতোমধ্যে ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত সময়ের সরকার বিসিক থেকে নির্বাসনে পাঠালেন। কারণ আমরা ছিলাম নৌকার লোক। জাতির পিতার আওয়ামী লীগের সমর্থক। তবে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়নি। পালিয়েছে অনেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসার পরপরই ২০০৭-০৮ সালে। দেশ ছেড়ে পালালেন অনেকেই। সেই পলাতকের ভিতর আছেন অনেকের সঙ্গে জনাব তারেক রহমানও। এখন তিনি সপরিবারে লন্ডন প্রবাসী। আইনের চোখে তিনি অপরাধী। এমনকি তার মা বেগম খালেদা জিয়াও। তারেক রহমান অপরাধী ও পলাতক হলেও লন্ডনে রাজকীয় জীবনযাপন করছেন। দেশের পত্র-পত্রিকায় প্রায়শই দেখি তার অমর বাণী। পড়ি মনোযোগ দিয়ে। এ রকম একটি অমর বাণী তারেক রহমান দিয়েছিলেন লন্ডনে বিএনপির এক সভায়। তিনি সেই সভায় যা কিছু বলেছিলেন, সেটি প্রকাশ পেয়েছিল প্রথম আলো পত্রিকায়। সংবাদটির প্রেরক প্রথম আলোর লন্ডন প্রতিনিধি, তারিখ ০৬/০১/২০১৫- লন্ডনে তারেক। ‘শেখ হাসিনার পদত্যাগ ছাড়া ঘরে ফেরা নয়।’

বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান দুর্বার আন্দোলনের মাধ্যমে শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন নিশ্চিত করতে নেতা-কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এর আগে তিনি নেতা-কর্মীদের ঘরে না ফেরার পরামর্শ দেন।

পূর্ব লন্ডনের এট্রিয়াম হলে ‘৫ জানুয়ারি গণতন্ত্র হত্যা ও কালো দিবস’ শীর্ষক আলোচনায় তিনি এ আহ্বান জানান। ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনের বছরপূর্তি উপলক্ষে যুক্তরাজ্য বিএনপি এ সভার আয়োজন করে।

তারেক রহমান বলেন, যখন খবর পাবেন শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছে, ঠিক তখনই রাজপথ ছাড়বেন। বিএনপির জন্য আন্দোলনে ঢাকাসহ সারা দেশে লাখ লাখ নেতা-কর্মী ঝাঁপিয়ে পড়েছেন বলে দাবি করেন তারেক রহমান। তিনি বলেন, আজ আমাদের নেতা-কর্মীরা রাস্তায়। তাদের গন্তব্য একটি। সেটি হচ্ছে দেশকে মুক্ত করা, গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনা। এ আন্দোলন থেমে গেলে দেশ এবং দেশের মানুষের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন। আন্দোলনে নিরীহ মানুষের যাতে ক্ষতি না হয়, সেদিকে সতর্ক থাকারও পরামর্শ দেন তিনি। এ সময় তিনি তরুণ প্রজন্মকে ফেসবুক বাদ দিয়ে দেশ রক্ষার আন্দোলনে শামিল হওয়ার আহ্বান জানান। এ ছাড়া বিএনপি ক্ষমতায় এলে ‘বেটার বাংলাদেশ’ বানানোর প্রতিশ্রুতি দেন তিনি।

সভায় সভাপতিত্ব করেন যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি শায়েস্তা চৌধুরী। সভা পরিচালনা করেন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কয়সর এম আহমদ। এ ছাড়া গতকাল স্থানীয় সময় বেলা ১টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সামনে যুক্তরাজ্য বিএনপির বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করার কথা রয়েছে।  একই সময় যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগও সেখানে ‘৫ জানুয়ারি গণতন্ত্রের বিজয় দিবস’ পালন করার ঘোষণা দিয়েছে।

এখন কথা হলো, শেখ হাসিনা কবে পদত্যাগ করবেন, সে কথা জনাব রহমান জানেন না। মাঝখানে আট বছর পেরিয়ে গেল। শেখ হাসিনাই একমাত্র ব্যক্তি যিনি জাতির পিতার আদর্শে লালিত।  তিনি কখনই বলবেন না, ‘বাপের যদি বেটি হই লাফ দিয়ে পগার পার হই।’ প্রবাদ আছে, ‘কুঁজোরও ইচ্ছে করে চিত হয়ে শুতে’। কথাটি প্রযোজ্য লন্ডনে পলাতক দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত সেই লোকটির জন্য।

                লেখক : কবি

সর্বশেষ খবর