রবিবার, ৫ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

ফসলের মাঠে নারীর প্রতি সীমাহীন বৈষম্য

লাকী আক্তার

ফসলের মাঠে নারীর প্রতি সীমাহীন বৈষম্য

‘শস্যক্ষেত্র উর্বর হলো, পুরুষ চালাল হাল/ নারী সেই মাঠে শস্য রোপিয়া করিল সুশ্যামল/ নর বাহে হাল, নারী বহে জল, সেই জল-মাটি মিশে/ফসল হইয়া ফলিয়া উঠিল সোনালী ধানের শীষে!’ কবি কাজী নজরুল ইসলাম নারীর অবদানের এমন স্বীকৃতি দিলেও বাস্তবিক অর্থে ফসলের মাঠে নারীর ভূমিকা স্বীকৃত নয়। যদিও বাংলাদেশের কৃষিতে নারীর রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

সরকারের কৃষি তথ্য সার্ভিস তথ্যানুসারে, বাংলাদেশে মোট নারীর মধ্যে শুধু কৃষিতেই নিয়োজিত ৭১.৫% নারী। এর মধ্যে কৃষিতে ৪৫.৬% নারী বিনামূল্যে শ্রম দেন আর বাকি ৫৪.৪% নারী পারিশ্রমিক পান। দেশের শ্রম জরিপ ২০১৬-১৭ এর তথ্যানুসারেও নারীদের কর্মসংস্থানের ৬০ ভাগই ঘটে কৃষিতে। এই বিপুল নারী শ্রমশক্তির ৬৮ শতাংশই কৃষি, বনায়ন ও মৎস্য খাতের সঙ্গে জড়িত। মোদ্দাকথা, ফসল উৎপাদনের ২১টি ধাপের ১৭টিতেই নারী সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। এত সব পরিসংখ্যান থাকার পরও কিন্তু কৃষিতে নারীর অবদান উপেক্ষিত। কৃষক হিসেবে নারীর স্বীকৃতি নেই।

কৃষিতে নারীর ভূমিকা সমাজের মধ্যে গৌণ হওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে বলা যায়, কৃষি উৎপাদনের মূল কাজের সঙ্গে নারীরা জড়িত থাকলেও বাজারব্যবস্থার সঙ্গে তাদের সংযোগ একেবারেই সীমিত। এমনিতেই কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণে রয়েছে মধ্যস্বত্বভোগী ও সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য। সেই দৌড়ে নারীরা একেবারেই পেছনের সারিতে। ফলশ্রুতিতে নারীরা বাংলাদেশে কৃষিপণ্যের আয়ের ওপর নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারছে না, যার দরুন কৃষক হিসেবেও স্বীকৃতি অনুপস্থিত। দেখা যাচ্ছে, কৃষিতে নারীর বিস্তৃত ভূমিকা থাকলেও নারীদের হাতে ফসলের জমি অনুপস্থিত। খোদ সরকারের কৃষি তথ্যের পরিসংখ্যান বলছে- বাংলাদেশে ৮১% জমির মালিকানায় পুরুষের দখলে যেখানে নারীর অবস্থান মাত্র ১৯%। সম্পদের অভিগম্যতায় নারীরা বৈষম্যের শিকার হন। নারীরা তাদের পরিবারের সঙ্গে ফসলের মাঠে কাজ করলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ফসলের জমি কিংবা সম্পদে নারীর অভিগম্যতা নেই। তাছাড়া আমাদের দেশের বিভিন্ন ধর্মীয় আইন অনুসারেও নারীরা তার প্রাপ্য অধিকার পান না। এখনো গ্রামের অনেক নারী, এমনকি শহরেও বাবার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হন নারী। কৃষি তথ্য সার্ভিসের ওয়েবসাইটে কৃষিতে নারী শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে জমির মালিকানা পুরুষের ৮১ শতাংশ, নারীর ১৯ শতাংশ। ৭২.৬ শতাংশ নারী কৃষিকাজের সঙ্গে সরাসরি জড়িত; অথচ ভূমিতে তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ বা মালিকানা নেই, কৃষক হিসেবে তারা স্বীকৃত নন এবং শ্রমের ন্যায্য মজুরি পাওয়া থেকেও তারা বঞ্চিত। বাজারব্যবস্থায়ও নেই তাদের প্রবেশাধিকার। এ কারণে তারা অধিকতর ও বহুমাত্রিক দরিদ্রতার শিকার। এ ছাড়া জাতীয় কৃষি নীতিমালায় নারী কৃষকদের সুস্পষ্ট কোনো সংজ্ঞায়ন নেই।

ফসল উৎপাদনের প্রাথমিক কাজ, বপন, ফসল উত্তোলন, বীজ সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ এমনকি বিপণন পর্যন্ত অনেক কাজ নারী এককভাবে অগ্রসর করলেও প্রাতিষ্ঠানিক পরিসংখ্যানে নারীর স্বীকৃতি অনুপস্থিত। মূলত কৃষিতে নারীর কাজকে নারী জীবনের প্রাত্যহিক বিনা শ্রমের সাংসারিক কাজ হিসেবেই বিবেচিত হয়। যারা কৃষি শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন, সেখানেও নারীরা মজুরি বৈষম্যের শিকার হয়ে থাকেন। পরিসংখ্যান বলছে- নারীরা ফসলের মাঠে যে শ্রম দেন তার ৪৫.৬ শতাংশের ক্ষেত্রে তাঁরা কোনো পারিশ্রমিক পান না। আর বাকি ৫৪.৪ শতাংশের ক্ষেত্রে তাঁরা যে পারিশ্রমিক পান, তা বাজারমূল্যের চেয়ে কম। কৃষিকাজ করতে গিয়ে নারীদের দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, জমির অভাব, অর্থায়নের সংকট, বাজারে নারীদের অভিগম্যতার অভাব, কৃষি প্রশিক্ষণ ও শিক্ষার অভাব, কম মজুরি, চিকিৎসার অভাবসহ আরও নানান ধরনের নিপীড়নের শিকার হতে হয়। এর ফলশ্রুতিতে নারীদের ফসলের মাঠে বৈষম্য তীব্র হয়। সিপিডির এক গবেষণা বলছে, জাতীয় আয়ে নারীর যে পরিমাণ কাজের স্বীকৃতি আছে তার চেয়ে ২.৫ থেকে ২.৯ গুণ কাজের স্বীকৃতি নেই। নারীর যে পরিমাণ কাজে স্বীকৃতি আছে সে হারে ২.৫ গুণ কাজের স্বীকৃতি নেই। জিডিপিতেও নারীর এই ভূমিকা একেবারেই উপেক্ষিত। এমনকি বাংলাদেশ জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১-তে, নারীর সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য প্রণীত ২২টি লক্ষ্যের মধ্যে নবম লক্ষ্য হলো, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিমন্ডলে নারীর অবদানের যথাযথ স্বীকৃতি প্রদান করা, কিন্তু তা সত্ত্বেও বাংলাদেশে কৃষি খাতে নারী শ্রমিকের কোনো বৈধ পরিচিতি নেই। বেশির ভাগ নারী-কৃষকরা কৃষি কার্ড পান না।

এমনিতে আপামর কৃষক ফসলের লাভজনক দাম পান না। ফসলের ন্যায্যমূল্য না থাকায় নারীরাও নানামাত্রিক সমস্যায় পড়েন। যখন হাতে ফসল থাকে তখন সরকার কৃষকদের কাছ থেকে ধান কেনে না। তা ছাড়া নারী শ্রমিকদের সমন্ডমজুরি অনেক জমির মালিক দেন না। নারীরা যখন জমির মালিকদের মজুরি বৈষম্যের কথা বলেন, তখন জমি মালিকরা তারা অন্য গ্রাম থেকে শ্রমিক এনে কাজ করানোর হুমকি দেন।

জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি-২০১১ এর ৩১.১ ধারায় বলা হয়েছে, জাতীয় অর্থনীতিতে নারী কৃষি শ্রমিকের শ্রমের স্বীকৃতি প্রদান করা এবং ৩১.৩ ধারায় বলা হয়েছে, কৃষিতে নারী শ্রমিকের মজুরি বৈষম্য দূরীকরণ এবং সমকাজে সমন্ডমজুরি নিশ্চিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা। কিন্তু তা বাস্তবায়নের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ নেই। কেননা বাংলাদেশে কৃষকের সংকট বরাবরই উপেক্ষিত। এসব সংকট দূরীকরণে দেশে নারী কৃষকদের গ্রামে গ্রামে সংগঠিত করতে হবে। ফসলের মাঠে নারীর প্রতি সীমাহীন বৈষম্য রোধে বাংলাদেশ কৃষক সমিতি নারী কৃষকদের সংগঠিত করে মাঠের লড়াইকে অগ্রসর করতে সংকল্পবদ্ধ।

লেখক : নির্বাহী সদস্য, বাংলাদেশ কৃষক সমিতি

সর্বশেষ খবর