শুক্রবার, ৩১ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

চীনা কথায় কান দিলে আম-ছালা দুটোই যাবে

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

চীনা কথায় কান দিলে আম-ছালা দুটোই যাবে

চীন রোহিঙ্গা ইস্যুতে নতুন খেলায় মেতে উঠেছে মূলত বাংলাদেশকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য। সম্প্রতি বাংলাদেশে কর্মরত চীনের নতুন রাষ্ট্রদূত ইয়াউ ওয়েন বাংলাদেশের সাংবাদিকদের বলেছেন, চীন রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে যে ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগ নিয়েছিল, করোনা মহামারির কারণে তা ২০২১ সাল থেকে গতি হারিয়েছে। তিনি আরও বলেছেন, রোহিঙ্গা বিষয়ে বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের হস্তক্ষেপও নাকি রোহিঙ্গা সমস্যা জটিল করে তুলেছে। তিনি বলেছেন,  রোহিঙ্গাদের প্রথম দলটি শিগগিরই মিয়ানমারে যেতে পারবে।  এই দলে কতজন থাকবে রাষ্ট্রদূত তা উল্লেখ না করলেও আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, এতে থাকবে মাত্র ১ হাজার রোহিঙ্গা।

যেখানে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা, সেখানে মাত্র ১ হাজার ফেরত যাওয়ার কথা হাস্যস্কর বৈকি। তাছাড়া করোনা কি করে চীনের তথাকথিত প্রচেষ্টার গতি শ্লথ করে দিল, তাও প্রণিধানযোগ্য নয়। এ কথা কারও অজানা নেই যে, চীনা প্রত্যক্ষ সমর্থন পেয়েই মিয়ানমার রোহিঙ্গা সমস্যা জিইয়ে রাখছে। ২০১৭ সালে চীন এবং রাশিয়া নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমারের পক্ষে ভেটো প্রদান না করলে সে বছরই রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। কেননা নিরাপত্তা পরিষদের রয়েছে পুলিশি এবং বাস্তবায়ন ক্ষমতা। ভেটো দেওয়ার পক্ষে চীনের যুক্তিটি ছিল উদ্ভট এবং আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। দেশটি বলেছে, রোহিঙ্গা সমস্যা নাকি মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যা হওয়ায় এটি নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদ সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। চীন বেমালুম ভুলে গিয়েছিল যে, রোহিঙ্গা সমস্যা বিশ্ব শান্তির প্রতি হুমকিস্বরূপ। পরবর্তীতেও নিরাপত্তা পরিষদ এবং এমনকি সাধারণ পরিষদেও চীন একটি ব্যতিক্রমী ছাড়া, মিয়ানমারের পক্ষই নিয়েছে বারংবার।

বিদেশি রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ রোহিঙ্গা ইস্যুকে জটিল করছে বলে চীনা দাবি সত্যিই অবান্তর এবং আমাদের স্বার্থের পরিপন্থী। ইউরোপ-আমেরিকা, এশিয়া এবং আফ্রিকার বেশ কিছু দেশের ইতিবাচক ভূমিকার কারণেই রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে বিশ্ববাসী এখনো চিন্তিত রয়েছে, নয়তো বহু আগেই এটি অতল জলে হারিয়ে যেত, রোহিঙ্গা সমস্যা বলে কোনো সমস্যা রয়েছে তা কেউ জানত না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কিছু বিদেশি রাষ্ট্র মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অবরোধ জারি করার ফলে অন্তত কিছুটা হলেও সেই দেশের ওপরে চাপ সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছে। সেই অর্থে বিদেশি রাষ্ট্রগুলো মিয়ানমার ইস্যুতে নাক না গলালে আমাদের আমের সঙ্গে সঙ্গে ছালাও যাবে, অথচ চীন এমনটিই চাচ্ছে। মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চালানোর বিষয়টি আন্তর্জাতিক আদালত এবং আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে উঠেছে বিদেশি রাষ্ট্রসমূহেরই প্রচেষ্টায়। সে ব্যাপারগুলোতেও চীন শুধু নিশ্চুপই ছিল না, পরোক্ষভাবে চীন সেসব আদালতে রোহিঙ্গা ইস্যু তোলার বিপক্ষেই ছিল। আন্তর্জাতিক আদালত দুটোতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা করায় সে দেশটি নিশ্চয়ই চাপের মুখে রয়েছে, অথচ চীন বলছে বিভিন্ন দেশের নাক গলানোর কারণেই নাকি রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। চীনের নিরঙ্কুশ সহায়তার কারণেই মিয়ানমার প্রতিনিয়ত আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) অন্তর্বর্তীকালীন আদেশসমূহ ভঙ্গ করে চলছে। কেননা আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের আদেশ ভঙ্গের বিরুদ্ধে একমাত্র নিরাপত্তা পরিষদই ব্যবস্থা নিতে পারে আর মিয়ানমার ভালো করেই জানে, চীন সে ক্ষেত্রেও আগের মতোই সে দেশটির পক্ষে ভেটো দিয়ে তাদের রক্ষা করবে।

চীনের মিয়ানমারপন্থি অবস্থানের কারণ অতি পরিষ্কার। সে দেশে চীনের এমন স্বার্থ রয়েছে যার কোনো বিকল্প নেই। বহু ধরনের বাণিজ্যিক স্বার্থ ছাড়াও চীনের অতি লোভী “বেল্ট অ্যান্ড রোডস” প্রকল্পের সূত্রপাতের মূল স্থান হচ্ছে মিয়ানমার। সেখান থেকে আফ্রিকা-ইউরোপে চীনা জাহাজ পৌঁছানো অতি সহজ, যা না হলে চীনের সরঞ্জাম মালাক্কা প্রণালি হয়ে যেতে হবে, যা সময় এবং ব্যয়সাপেক্ষ এবং কোনো কারণে মালাক্কা প্রণালিতে কেউ অবরোধ দিলে তা চীনের জন্য ক্ষতিকর হবে আর তাই মিয়ানমারের ওপর চীনের অতুলনীয় নির্ভরতা এবং সে নির্ভরতা প্রাপ্তির জন্য অন্ধ সমর্থন। মিয়ানমার সামরিক একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার পর চীনই একমাত্র দেশ যে সামরিক সরকারকে শুধু কূটনৈতিক নয়, বরং সামরিক সাহায্য দিয়ে যাচ্ছে। মিয়ানমার সরকারের ওপর চীনের এমন প্রভাব রয়েছে যে চীন চাইলে অল্প দিনেই রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান করতে পারে। কারণ মিয়ানমার সরকার চীনের ওপর এত নির্ভরশীল যে, সে দেশটির পক্ষে চীনা সিদ্ধান্ত খর্ব করা অচিন্তনীয়। অথচ চীন যে মিয়ানমারের ওপর তার কার্যকর প্রভাব খাটাবে না, চীনা দূতের ভাষায় সেটি পরিষ্কার। তিনি বলে দিয়েছেন তার দেশ কোনো পক্ষ নেবে না। বলাবাহুল্য, রোহিঙ্গা সমস্যার সত্যিকারের সমাধান চাইলে অবশ্যই চীনকে বাংলাদেশের পক্ষ নিতে হবে। রোহিঙ্গাদের ভূমি রাখাইন এলাকাই হচ্ছে চীনের মূল স্বার্থ। সেখানকার খনিজ পদার্থ চীনের লোভের বস্তু। বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পের শুরুও সেই রাখাইন এলাকা। তাই রোহিঙ্গারা সেখানে ফিরুক চীন তা চায় না। এটা মনে করার পক্ষে জোরালো যুক্তি রয়েছে যে চীনের তথাকথিত সাহায্যে কখনো রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হবে না। 

চীনের নতুন রাষ্ট্রদূত তার পূর্বসূরির পদাঙ্ক অনুসরণ করে একইভাবে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারণী বিষয়ে নাক গলানোর চেষ্টায় লিপ্ত হয়েছেন। এবার তিনি এটি করছেন খুবই সুচতুর পন্থায়। দ্বিচারিতার ভূমিকায়। এক মুখে তিনি বলছেন, তার দেশ বাংলাদেশের ঘোষিত “সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারও সাথে বৈরিতা নয়” নীতিকে শ্রদ্ধা করে, আবার অন্য মুখেই এই মর্মে হুমকি দিচ্ছেন যে, বাংলাদেশ কোয়াড কিংবা এশিয়া প্যাসিফিক সমঝোতায় গেলে বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তার পূর্বসূরি আরও কঠিন ভাষায় বলেছিলেন, এটি হলে বাংলাদেশের প্রতি চীনের নীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। চীনা দূতের এহেন বক্তব্য শুধু বাংলাদেশের নীতিনির্ধারণী বিষয়ে চীনের হস্তক্ষেপেরই নামান্তর নয়, বরং ব্ল্যাকমেলিংও বটে। চীন এসব কথা এ জন্যই বলছে, যাতে বাংলাদেশ ভীত হয়ে তাদের কথামতো কাজ করে। বাংলাদেশের বহু প্রকল্পে চীন ঋণ দিতে চুক্তিবদ্ধ। এসব প্রকল্পে চীনা ঋণের টাকার পুরোটা এখনো পাওয়া যায়নি, বেশির ভাগই পাইপ লাইনে রয়েছে। তাছাড়া প্রকল্পগুলোর কাজ চালাচ্ছে চীনা প্রকৌশলী, কারিগর এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এমতাবস্থায় চীন পাইপলাইনে থাকা টাকা বন্ধ করে দিলে বাংলাদেশের প্রকল্পগুলো মাঝপথে প্রচন্ড ধাক্কা খেতে পারে জেনেই চীন তাদের হুমকি চালিয়ে যাচ্ছে, যা ব্ল্যাকমেল বৈ কিছু নয়।

বাংলাদেশ কোয়াড বা ইন্দো-প্যাসিফিক কার্যক্রমে যোগ দেবে কিনা, সেটি একান্তই বাংলাদেশের ব্যাপার, যে বিষয়ে কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের নির্দেশনা অনভিপ্রেত, যে কথা চীনের সাবেক রাষ্ট্রদূতের বক্তব্য প্রসঙ্গে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয় স্পষ্ট ভাষায়ই বলেছিলেন। প্রতিটি দেশের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারিত হয়ে থাকে স্ব স্ব দেশের স্বার্থ বিবেচনায়, যে কথা বহু শতক আগে সর্বকালের প্রসিদ্ধ পন্ডিত কৌটিল্য (চানক্য) ব্যক্ত করেছিলেন, যে তত্ত্ব বহু দেশে আজও অনুসৃত হচ্ছে। কোয়াড এবং ইন্দো-প্যাসিফিক দুটি ভিন্ন ধরনের কাঠামো। অনেকে বলছেন, কোয়াড সিয়াটো-সেন্টো-ন্যাটোর মতোই একটি সামরিক জোটসম। কিন্তু ইন্দো-প্যাসিফিক সমঝোতা কোনো সামরিক প্রকল্প নয়, সে কথা সর্বজন স্বীকৃত। সুতরাং কোয়াডে যোগ দিলে বাংলাদেশের জোট নিরপেক্ষ অবস্থানে প্রশ্ন উঠলেও ইন্দো-প্যাসিফিকে সে ধরনের কিছুই বলা যাবে না। বস্তুত দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের বেআইনি একচ্ছত্র মালিকানার দাবি এবং তা বাস্তবায়িত করার জন্য চীনা কার্যক্রমকে ঠেকানোর জন্যই ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল। চীন আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন, বিশেষ করে ১৯৮২ সালে গৃহীত “ইউনাইটেড নেশনস কনভেনশন অন দি ল অব সি” (আনক্লোজ-৩)-এ যেসব শর্তাদি রয়েছে, তার অন্যতম হলো এই যে কোনো রাষ্ট্রের ভৌগোলিক জলসীমা, টেরিটোরিয়াল ওয়াটারের বাইরে অবস্থিত সাগর বিশ্বের সব দেশের সমান অধিকারভুক্ত, তা কোনো দেশের একক নিয়ন্ত্রণে থাকতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্র উক্ত কনভেনশনে দস্তখত করলেও সে দেশের সিনেট তাতে অনুমোদন দেননি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র যথার্থই দাবি করছে, উক্ত কনভেনশনে যেসব শর্ত রয়েছে তার সবই সমুদ্র সংক্রান্ত কাস্টমারি আন্তর্জাতিক আইনেই রয়েছে। বিশেষ করে সমুদ্রের ওপর সব দেশের দাবির কথা আন্তর্জাতিক আইনের জনক হিসেবে স্বীকৃত, ১৬ শ’ দশকের ডাচ আইনজ্ঞ হিউগো গ্রটিয়াসও উল্লেখ করেছিলেন।

উক্ত কনভেনশন, চীন যাতে ১৯৯৬ সালে দস্তখত করেছে এবং পাশাপাশি যে বিধানগুলো কাস্টমারি আন্তর্জাতিক আইনে বলবৎ রয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, কোনো দেশের ভৌগোলিক সীমানার বাইরের সমস্ত এলাকা সব দেশের জন্য উন্মুক্ত থাকবে, যাতে সব দেশ শুধু নৌ-চলাচলের অধিকারই ভোগ করবে না, সমুদ্রের ওপরে আকাশ পথ, সমুদ্রের মৎস্য সম্পদসহ তলদেশে সমস্ত খনিজ পদার্থের ওপর, যাকে মানব জাতির হেরিটেজ বলা হয়েছে, সমান অধিকার থাকবে, সমান অধিকার থাকবে সমুদ্রের নিচে ক্যাবল (তার) বসানোরও। কিন্তু চীন সেসব শর্ত লঙ্ঘন করে দক্ষিণ চীন সাগরে কৃত্রিম দ্বীপ প্রতিষ্ঠা করে এবং তার সশস্ত্র নৌবাহিনী প্রেরণ করে সমস্ত দেশের আইনি অধিকার খর্ব করছে, যার দ্বারা নিশ্চিতভাবে অন্য সব দেশের মতো বাংলাদেশের স্বার্থও ক্ষতিগ্রস্ত হতে বাধ্য, আর সে অর্থে চীনের এই অবৈধ সাগর দখল প্রক্রিয়া প্রতিহত করার প্রচেষ্টায় বাংলাদেশকে নিজ স্বার্থেই এশিয়া-প্যাসিফিক কৌশলে অংশ নিতে হবে। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ব্রুনাই, ফিজি, নিউজিল্যান্ড, ফিলিপিন্স, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত, মালয়েশিয়া এতে শরিক হয়েছে।  এটিকে একটি অর্থনৈতিক কৌশল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

চীনা দূতের বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে এটি পরিষ্কার যে, তিনি যা বলেছেন তা মান্য করলে আমরা রোহিঙ্গা ইস্যু এবং মহাসমুদ্র উন্মুক্ত রাখার ইস্যুতে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হব। অথচ আমাদের দেশে এমন অনেকেই রয়েছেন যারা চীন বলতে পাগল। সময় হয়েছে আন্তর্জাতিকভাবে চীনের কর্মকান্ড বিশ্লেষণ করে চীনের আসল উদ্দেশ্য ভেবে দেখা।  তাই সাধু সাবধান।

                লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি

 

সর্বশেষ খবর