বঙ্গবাজারের সর্বগ্রাসী অগ্নিকান্ড জাপানের হিরোশিমায় আণবিক বোমা বিস্ফোরণের মতোই দেখাচ্ছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ সবাই বাকরুদ্ধ। হওয়ারই কথা। এই আগুন পথে বসিয়েছে বহু খুদে থেকে মাঝারি ব্যবসায়ীকে, যাদের অনেকের সারা জীবনের সঞ্চয় নিঃশেষিত হয়েছে, যারা স্থানীয়ভাবে কেনা এবং বাইরে থেকে আমদানি করা বস্ত্র বিক্রি করে কিছুটা সুখের স্বপ্ন দেখছিলেন, যাদের বেশির ভাগ ব্যাংক থেকে উচ্চসুদে ঋণ নিয়ে পরিশোধের কথা মনে করে পাগলপ্রায়। এটি যে শুধু বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীদেরই ক্ষতি করেছে, তা নয়। এটি গোটা দেশের সব মানুষ, বিশেষ করে তৈরি পোশাকের ব্যবসার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের জন্যও বয়ে এনেছে চরম দুর্যোগ। উল্লেখ্য, বঙ্গবাজারের দোকানগুলো সারা দেশের কাপড় ব্যবসায়ীদের কাছে মালামাল পাঠাত।
দমকল বাহিনী প্রধান জানিয়েছেন, বেশ কয়েক বছর আগেই তার সংস্থা বঙ্গবাজার দোকান মালিক সমিতিকে সেখানে আগুনের ঝুঁকির ব্যাপারে সতর্ক করেই ক্ষান্ত হয়নি, এলাকায় বড় করে সতর্কতামূলক নোটিসও টানিয়েছিল। কিন্তু মালিক সমিতির নেতারা তাতে কান দেননি। বঙ্গবাজারের মালিকানা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের, যা একটি বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান। সেই সংস্থার নির্বাচিত প্রধান ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস আগুন লাগার ভীতি সম্পর্কে বলেছেন, সেই আশঙ্কার কথা বিবেচনায় নিয়ে তার করপোরেশন পুরনো স্থাপনা ভেঙে সেখানে আধুনিক, অগ্নি এবং অন্যান্য দুর্যোগ প্রতিরোধক স্থাপনা তৈরির সিদ্ধান্ত নিলে মালিক সমিতির তথাকথিত নেতারা তাতে শুধু বাধাই দেননি, বরং হাই কোর্টে রিট মামলা করে স্থিতাদেশ আদায় করতে সক্ষম হওয়ায় করপোরেশন সেই পরিকল্পনা নিয়ে যথাসময়ে এগোতে পারেনি। মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস ঐতিহ্যগতভাবেই একজন আদর্শিক, সৎ চিন্তার, দেশপ্রেমী, মানবপ্রেমী ব্যক্তি। আইন পেশায় থাকাকালেও অন্যায় বা গণবিরোধী রায় হাসিলের জন্য আইনের ফাঁকফোকর খোঁজার কোনো প্রবণতা তার মধ্যে দেখা যেত না, যিনি একনিষ্ঠ সততা এবং নৈতিকতা সব সময় অনুসরণ করতেন। মামলা জেতার জন্য তিনি কখনো এথিকস বিরোধী কোনো পন্থা বা আরগুমেন্ট করতেন না, একজন বিচারপতি হিসেবে আমি যা সব সময়ই দেখেছি। তাই তার কথা অবিশ্বাস করার এবং তিনি যে এ বিষয়ে সচেতন ছিলেন, সেটি বিশ্বাস না করার কারণ নেই।
ব্যারিস্টার তাপস এবং দমকল বাহিনী প্রধানের ভাষ্য থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, মালিক সমিতির স্বার্থান্বেষীদের কারণেই পুরনো ভয়ার্ত স্থাপনা চূর্ণ করে ঝুঁকিমুক্ত স্থাপনা নির্মাণ সম্ভব হয়নি। জানা গেছে, এসব তথাকথিত নেতা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত। মূলত এদের কোনো রাজনৈতিক আনুগত্য নেই। ক্ষমতা পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় যে দল ক্ষমতায় যায়, তারাও রাতারাতি সে দলে নাম লিখিয়ে তাদের অপকর্ম চালিয়ে যেতে থাকেন। এসব অমানুষের দল নিরীহ খুদে বা মাঝারি ব্যবসায়ীদের, যাদের অনেকেই দিন এনে দিন খাওয়া মানুষ, অনেক ক্ষেত্রে ভয়ভীতি দেখিয়ে, অথবা কোনো কোনো সময় মিষ্টি কথা বলে, প্রতারণামূলকভাবে খুদে, মাঝারি ব্যবসায়ীদের নাম ভাঙিয়ে নিজেদের ভাগ্য প্রসন্ন করে থাকেন, যার একটি অনন্য নজির আমরা সম্প্রতি দেখেছি যখন গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক নেতারা অধ্যাপক ইউনূসের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের উৎকোচ গ্রহণ করে মেহনতী শ্রমিকদের স্বার্থ ধ্বংস করেছিলেন। (এমনকি শ্রম![](/assets/archive/images/Print-Edition/2023/04.%20April/07-04-2023/Bd-pratidin-07-04-23-F-17.jpg)
শুধু বঙ্গবাজারই নয়, ঢাকা শহরের বহু দোকানপাট, হাসপাতাল, বিদ্যায়তন, ভবন ইত্যাদিও ভয়াবহ অবস্থায় রয়েছে বলেও দমকল বাহিনী প্রতিনিয়ত জানাচ্ছে। বিপদ ঘটে যাওয়ার আগেই সেসব স্থাপনার ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে, যার প্রাথমিক দায়িত্ব রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের। তাদের বিরুদ্ধে সীমাহীন দুর্নীতির অভিযোগ নতুন নয়; আর দুর্নীতিতে গা ভাসিয়ে সংস্থার কর্মকর্তারা অনুমোদনবিহীন বা অপরিকল্পিত স্থাপনার বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয় থাকছেন, যে বিষয়টিতে কঠোর অবস্থানে গিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রতিটি দোকান, অফিস, শিক্ষায়তন, ভবন এবং এমনকি বসবাস করার ফ্ল্যাটেও অগ্নিনিরোধক যন্ত্রপাতি বসানো বাধ্যতামূলক করতে হবে এবং সে বিধান পালন করা হচ্ছে কি না প্রতিনিয়ত তা তদারকি করতে হবে। প্রতি দুই বছর অন্তর সমস্ত স্থাপনায় বিদ্যুৎ এবং গ্যাস লাইন পরীক্ষা করা বাধ্যতামূলক করতে হবে। দোকানের ভিতর বা আশপাশে ধূমপান করতে হবে নিষিদ্ধ। দোকান এবং অন্যান্য স্থাপনায় সংশ্লিষ্ট সবাইকে অগ্নিকান্ডসহ অন্যান্য দুর্যোগে কী করণীয়, সে বিষয়ে প্রতিনিয়ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। মাঝারি বা বড় ধরনের শপিং মলে অগ্নিনির্বাপক বিশেষজ্ঞদের সার্বক্ষণিক অবস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। বঙ্গবাজারে এ ধরনের ব্যবস্থা থাকলে সেখানে আগুন লাগলেও তা ছড়াতে পারত না। বঙ্গবাজারের আগুন আয়ত্তে আনার জন্য দমকল বাহিনী ছাড়াও পুলিশ, র্যাব, বিজেবি, সেনা, নৌ এবং বিমান বাহিনীর কর্মকর্তা ও সদস্যরা যে ভূমিকা পালন করেছেন, তা সত্যিই অভূতপূর্ব। সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার পানি ছিটিয়ে যা করেছে, পুলিশের পানি ছিটানো গাড়ি আগুন নেভানোর জন্য যেভাবে ব্যবহৃত হয়েছে, তা আগে কখনো দেখা যায়নি। এ দৃশ্য দেখে আমার মনে হচ্ছিল ১৯৮৬ সালের এপ্রিল মাসে সে সময়ের সোভিয়েত ইউনিয়নের চেরনোবিলে পারমাণবিক কেন্দ্রের অগ্নিকান্ডের কথা, যে সময় সংশ্লিষ্ট সবাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সে আগুন নিয়ন্ত্রণে এনেছিলেন গোটা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে। তখন বিলেতে বসবাসরত প্রবাসী হিসেবে তা টেলিভিশনের পর্দায় দেখার সুযোগ আমার হয়েছিল। আমাদের উল্লিখিত বাহিনীগুলোও বঙ্গবাজার অগ্নি নিয়ন্ত্রণে আনতে দেশপ্রেমের যে নজির স্থাপন করেছে তার জন্য তারা দেশের সব মানুষের প্রশংসা প্রাপ্তির দাবিদার।
অগ্নিকান্ডটি অন্তর্ঘাতী ষড়যন্ত্রের ফসল কি না, সে প্রশ্নও সরব হয়েছে। অনেকে মনে করছেন, মালিক সমিতির স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী পুরনো দোকানদারদের জায়গা খালি করে বহু পয়সার বিনিময়ে নতুন দোকানদার বসানোর জন্য এটি করে থাকতে পারেন।
এ ধরনের প্রশ্ন উড়িয়ে ফেলার মতো নয়। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তদন্তের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যাকে সাধুবাদ জানাতে হয়। আশা করা যায়, তদন্তে সত্য উদঘাটিত হবে। শেষ কথা হলো বঙ্গবাজারে যা ঘটেছে, তার যেন পুনরাবৃত্তি আর কোথাও না হয়।
লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি