শনিবার, ৮ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

বাণিজ্যিক চাষের আগে প্রয়োজন পরীক্ষামূলক চাষ

শাইখ সিরাজ

বাণিজ্যিক চাষের আগে প্রয়োজন পরীক্ষামূলক চাষ

টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইলের শালিয়াবহ গ্রামের আবদুল আজিজ মাটির প্রতি দায়িত্বশীল ও দারুণ প্রকৃতিপ্রাণ এক কৃষক। অনেকবার তার খামারে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। আজিজ কিছুটা খ্যাপাটে গোছের কৃষক। কিন্তু যা কিছু করেন, তাতেই আলোড়ন সৃষ্টি হয়। পেয়ারা, লেবু, মাল্টাসহ বিভিন্ন ফসল ফলিয়ে নিজের সুনাম কুড়িয়েছেন।  এখন শারীরিক সক্ষমতা আগের মতো নেই, তবুও গোটা এলাকার মানুষের উন্নয়নের কথা ভাবেন। নিজের চাষাবাদ থেকে আসা টাকা-পয়সা খরচ করে প্রতি বছর বৈশাখে সমাজকল্যাণমুখী কাজ করেন। শত শত মানুষের কাছে বিনামূল্যে পৌঁছে দেন গাছের চারা। গাছ রোপণের মধ্য দিয়ে এ ধরিত্রী বদলে যাক, সবুজে সবুজে ভরে যাক চারপাশ এমন প্রত্যাশা তার। নিজেকে চাষা পরিচয় দিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন কৃষক আজিজ। গত দেড় দশকে বহুবার তিনি উঠে এসেছেন হৃদয়ে মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানে। ২০০৮ সালে তিনি পান চ্যানেল আই কৃষি পদক। এখন তিনি দেশে পরিচিত এক উদ্ভাবনী কৃষক হিসেবে। দু-এক বছর পর পরই তিনি দেখান নতুন বৈচিত্র্য। এখন দেশে উচ্চমূল্যের ফলবাগান কিংবা পরিকল্পিত খামার গড়ে তোলার ধুম পড়ে গেছে। অথচ অনেক আগেই যখন এ উদ্যোগগুলো মানুষের কাছে বিস্ময় জাগাত চাষা আজিজ তখন থেকেই চমক দেখিয়ে আসছেন। লেবুবাগান, মাল্টাবাগান, কুলবাগান, ট্যাং ফল বা প্যাশন ফলের বাগান গড়ে চাষা আজিজ সাড়া ফেলেছেন। অনেকবারই তার বাড়িতে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে আমার। আজিজের বিত্ত- বৈভব কিংবা চাকচিক্যের প্রতি মোহ নেই। তার গভীর আকর্ষণ মাটির প্রতি। কৃষি ও কৃষকের প্রতি। গত ২০ বছরে তার বাড়িটিরও কোনো পরিবর্তন নেই। কারণ এখানে তিনি যে প্রাণের সন্ধান পান, বিশ্বাস করেন নতুন কিছু করে সেখানে তা পাবেন না। গত ফেব্রুয়ারিতে আবার যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল চাষা আজিজের বাড়িতে। এবার তিনি নতুন এক বার্তা নিয়ে এসেছেন উদ্যোগী খামারিদের জন্য। দেশের মাটিতে ছড়িয়ে পড়া কমলার বাগান নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ তার। তার মতে, আমাদের দেশে এখন নার্সারি ব্যবসায়ীরা সুযোগ নিয়ে বহু জাতের চারা বিক্রির চেষ্টা করছেন। কিন্তু আমাদের মাটিতে কোনটি উপযুক্ত হতে পারে সে বিষয়ে জানা জরুরি। আজিজ তার বাগান ঘুরিয়ে দেখালেন বেশ কিছু গাছে উপরিভাগের কমলা শুকিয়ে যাচ্ছে। শুকিয়ে যাচ্ছে পাতাও। আবার বিভিন্ন ধরনের রোগের আলামতও লক্ষ্য করা যায়। আজিজ বলছিলেন, সব ধরনের কমলা আমাদের দেশের মাটিতে ভালো ফলন দেয় না। করোনার কঠিন সময়ে একবার এসে দেখেছিলাম চাষা আজিজ প্রযুক্তিনির্ভরতায় নতুন বা উচ্চমূল্যের ফসল উৎপাদনে নিয়োজিত হয়েছেন। চাষ শুরু করেছিলেন বলসুন্দরী কুলের। সেখানে এখন আটকে নেই তিনি। সেই কুলের বাগানের জায়গাতে এখন উৎপাদন হচ্ছে কমলা। কুল গাছ কেটে দিয়ে কমলার গাছকে বড় করা হয়েছে। তিন একর জমিতে ১ হাজার চায়না ম্যান্ডারিন জাতের কমলা আর ১ হাজার দার্জিলিং জাতের কমলা গাছ লাগিয়েছেন। গাছে গাছে প্রচুর কমলা ধরেছে। চাষা আজিজ বলেন, কমপক্ষে ১০ হাজার কেজি কমলা উৎপাদন হবে, যা থেকে ১০ লাখ টাকা আয় হতে পারে।

পাঠক, আগেই বলেছি, কৃষক আবদুল আজিজের ধৈর্য ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা সত্যিই বিস্মিত করে। তিনি শুধু নিজেকে ভালো রাখতে চান না। তিনি চান গোটা এলাকার মানুষও কৃষিমুখী হোক। মনে পড়ে গেল আজিজের প্রথম মাল্টা উৎপাদন করার কথা। বছর দশেক আগে তিনি যখন মাল্টা চাষ শুরু করলেন, প্রথম ফলন তিনি গ্রামবাসী এবং শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণ করে দিয়েছিলেন। এত দিন পরেও তিনি চিন্তা-চেতনায় অবিচল রয়েছেন। প্রতি বছরই নতুন নতুন ফসলের সাফল্য আনতে কঠিন পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। এবার প্রমাণ করছেন চায়না কমলা উৎপাদনের।

নতুন মিশ্র ফলবাগানটি সত্যিই অভিভূত হওয়ার মতোই! গাছে গাছে কমলার দারুণ ফলন। থরে থরে ধরে আছে সুমিষ্ট কমলা। দেখে মনে হয় বিদেশের কোনো কমলা বাগানে এসেছি। গ্রামীণ কৃষি পরিবারের কাছে বছরব্যাপী সুবিধা পাওয়ার জন্য মিশ্র ফলবাগান সবচেয়ে ভালো বলছিলেন আজিজ। এ এলাকার মাটি ও ফসল নিয়ে এখনো তিনি বহুদূর পৌঁছানোর স্বপ্ন দেখেন। বিশেষ করে বাণিজ্যিক কমলা উৎপাদনের ব্যাপারে দারুণ আশাবাদী তিনি। তবে এ ক্ষেত্রে আমদানি নীতিকে আরও অনুকূল করা দরকার। তারও আগে প্রয়োজন মাটির সঙ্গে কমলার কোন জাতটির উৎপাদন ভালো হয় সেটা পরীক্ষা করে দেখা।

তিনি বাণিজ্যিক চাষে যাওয়ার আগে তার বাড়ির সামনে বড় একটা জমিতে কমলার বেশ কয়েকটি জাতের চারা লাগিয়ে পরীক্ষা করে দেখে নিয়েছিলেন কোন জাতটির ফলন ভালো। তিনি বলেন, মানুষ ভালো-মন্দ বিচার না করে, জাতের পরীক্ষা না করেই বড় বিনিয়োগ শুরু করে। আর যখন দেখে ফলন আসছে না তখন অন্যের ওপর দোষারোপ শুরু করে। কৃষিক্ষেত্রে বড় বিনিয়োগের আগে যাচাই-বাছাইয়ের প্রয়োজন আছে। আমি বললাম, শুধু কৃষির ক্ষেত্রে নয়, যে কোনো বড় বিনিয়োগের আগে যাচাই-বাছাই করে নিতে হয়।

আজিজ আমাদের নিয়ে গেলেন স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। সেখানে স্কুলের শিক্ষার্থীদের তার গাছের কমলা খাওয়ালেন। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর হাতে কমলার চারা তুলে দিলেন বিনা পয়সায়। শিক্ষার্থীরা প্রত্যেকেই হাতে হাতে একটি করে কমলার চারা নিয়ে বাড়ি ফিরছে লাইন ধরে। দৃশ্যটির সৌন্দর্য দেখার মতো। এ শিশু কিশোরদের কমলার চারা দিয়ে নতুন এক সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের বীজ যেন বপন করেছেন আবদুল আজিজ। তার ব্যতিক্রমটা এখানেই। বাণিজ্যিক কৃষিতে যুক্ত হলেও নিজেকে এখনো মাটিঘেঁষা রেখেছেন। স্বাদ ও গুণের বিচারে সেরা ফসলটি মানুষের কাছে এখনো পৌঁছে দিতে চান তিনি। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের কৃষির প্রতি আগ্রহ করে তোলার জন্য তার উদ্যোগগুলো সত্যি প্রশংসনীয়। মনে পড়ে, একবার পহেলা বৈশাখে তার বাড়িতে উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়েছিল। সেদিন গ্রামের সাধারণ মানুষকে তিনি গাছের চারা উপহার দিয়েছিলেন। তিনি চান কৃষির নানামুখী উদ্যোগ ছড়িয়ে পড়ুক সবার মাঝে। গ্রাম থেকে গ্রামে। তিনি বলেন, সবাই মিলে ভালো থাকতে পারলেই আসলে ভালো থাকা সম্ভব। গ্রামের সবাই যখন ভালো ফল-ফসল উৎপাদন করবে, ভালো খাবে, তখনই প্রকৃতপক্ষে সবার ভালো থাকা সম্ভব হবে।

সারা দেশেই কৃষকদের হাত ধরে কমলার উৎপাদন বাড়ছে। তবে এখনো দেশি কমলার বাজার ততটা সমৃদ্ধ হয়নি। এ ক্ষেত্রে আমদানি নীতির পরিমার্জন প্রয়োজন বলে মনে করছেন কৃষকরা। আজিজও সে কথাই বললেন। দেশীয় ফল-ফসলের উৎপাদন বাড়াতে একটা মৌসুমে আমদানি কমিয়ে কৃষকদের ফলানো ফল বাজারে তুলে ধরা প্রয়োজন।

যাই হোক, টাঙ্গাইলের কৃষক আজিজ দেড় দশক ধরে তার সাফল্য একই রকমভাবে ধরে রেখেছেন।  পুরনো ফসলের বাগান ধরে রাখার পাশাপাশি আধুনিক ধ্যান-ধারণা গ্রহণ করে নতুন ফসল ফলিয়েও চমক দেখিয়ে যাচ্ছেন তিনি। টেকসই ও লাভজনক কৃষির অঙ্কেও তিনি যে দক্ষতার উদাহরণ সৃষ্টি করছেন তা দেশের অনেক বেকার তরুণকে যেমন পথ দেখাবে, একইভাবে উচ্চ ফলনশীল কিংবা নতুন ফল-ফসলের বাজার সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আমার বিশ্বাস।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব

[email protected]

সর্বশেষ খবর