বুধবার, ১২ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

সংবাদপত্রের স্বাধীনতার অপব্যবহার

ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বল

সংবাদপত্রের স্বাধীনতার অপব্যবহার

সাংবাদিক শামসুজ্জামান পরিবেশিত একটি খবর ও তার পরিপ্রেক্ষিতে তাকে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের আওতায় গ্রেফতারের ঘটনাটি সারা দেশের মানুষের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে।  ঘটনার সূত্রপাত ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে প্রথম আলোর করা একটি অনলাইন প্রতিবেদন ফেসবুকে প্রকাশের মধ্য দিয়ে।

উল্লেখ্য, ওই প্রতিবেদনটি ফেসবুকে প্রকাশের সময় জাকির হোসেন নামে এক দিনমজুরের উদ্ধৃতি দিয়ে ‘পেটে ভাত না জুটলে স্বাধীনতা দিয়া কী করুম? বাজারে গেলে ঘাম ছুটে যায়। আমাগো মাছ, মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগব’ এই শিরোনামে একটি ‘কার্ড’ তৈরি করা হয়। ওই কার্ডটিতে বিবৃতি প্রদানকারী হিসেবে জাকির হোসেনের নাম থাকলেও ছবি দেওয়া হয় একটি সাত বছরের শিশুর।

সংবাদটি প্রকাশের ১৭ মিনিটের মাথায় নিজেদের অবস্থান থেকে পিছু হটে পত্রিকাটি। খবরটি সংশোধন করে তারা। কিন্তু ততক্ষণে বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনার পর ২৯ মার্চ বুধবার ভোরে সাংবাদিক শামসুজ্জামানকে তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ ওঠে সাদা পোশাকের সিআইডির বিরুদ্ধে।

বাংলাদেশের প্রথম সারির দৈনিকগুলোর একটি তালিকা করলে প্রথম আলোর নাম নিঃসন্দেহে ওপরের দিকেই থাকবে। দেশের শীর্ষ এই দৈনিকটি পাঠকপ্রিয়তার দিক থেকেও অনেকটা এগিয়ে আছে। সব সময়ই গঠনমূলক এবং বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশ করে বলে তারা দাবি করে আসছে। এই সংবাদ প্রকাশের জের ধরে তাদের ভাবমূর্তি অনেকটাই ক্ষুণœ হয়েছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।  এ ঘটনাটি যে দুটি বিষয়কে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে তা হলো- আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক গ্রেফতার ও রিমান্ড সংক্রান্ত উচ্চ আদালতের নীতিমালা লঙ্ঘন এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার অপব্যবহার।

এখানে উল্লেখ্য, গ্রেফতার ও আটক সম্পর্কে উচ্চ আদালতের একটি সুস্পষ্ট নীতিমালা থাকলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রায়ই একে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এর ব্যত্যয় ঘটায়। সাংবাদিক শামসুজ্জামানের ঘটনাটি এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

ব্লাস্ট বনাম বাংলাদেশ (রিট পিটিশন নম্বর ৩৮০৬, ১৯৯৮) মামলায় আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী গ্রেফতারের সময় একজন পুলিশ অফিসারকে তার পরিচয় প্রকাশ করতে হবে এবং গ্রেফতারকৃত ব্যক্তি বা গ্রেফতারের সময় উপস্থিত ব্যক্তিদের কাছে তার পরিচিতিপত্র দেখাতে হবে। তবে সাংবাদিক শামসুজ্জামানকে গ্রেফতারের সময় এই নিয়মটি মানা হয়নি। তাকে কোন বাহিনী ধরে নিয়ে গেছে সে বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরুতে কিছুই জানা যায়নি। সিআইডি বা স্থানীয় পুলিশের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই আটকের বিষয়টি তাদের জানা নেই। গ্রেফতারকৃত প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিকটতম ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে গ্রেফতারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হাজির করার নিয়ম রয়েছে (গ্রেফতারের স্থান থেকে ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে আনয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সময় ব্যতিরেকে) এবং ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ব্যতীত তাকে এর বেশি সময় আটক রাখা যাবে না। এটি একজন ব্যক্তির সাংবিধানিক অধিকার। প্রায় ৩০ ঘণ্টা নিখোঁজ থাকার পর বৃহস্পতিবার সকালে ওই সাংবাদিককে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করা হয়।

যদিও শামসুজ্জামানকে তার বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয় কিন্তু আদালতে হাজির করার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তার কোনো খোঁজখবর তার পরিবারের কেউ পাননি। নির্দেশনা অনুযায়ী আটককৃত ব্যক্তিকে অবশ্যই তার পছন্দের একজন আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করতে বা নিকটতম সম্পর্কের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দিতে হবে। সাংবাদিক শামসুজ্জামানকে এ অধিকার থেকেও বঞ্চিত করা হয়। 

শামসের বিরুদ্ধে দায়ের করা দুটি মামলার প্রথম মামলাটি দায়ের করা হয় ২৯ মার্চ তেজগাঁও থানায়। সে মামলার বাদী ছিলেন সৈয়দ মো. গোলাম কিবরিয়া নামে এক ব্যক্তি। তার অভিযোগ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসে ‘ভুল তথ্য, মিথ্যা পরিচয় ও মিথ্যা উদ্ধৃতি’ দিয়ে সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে। তবে অভিযোগ হচ্ছে, এই মামলা দায়েরের আগেই শামসকে তার বাড়ি থেকে বুধবার ভোররাতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।

সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন হচ্ছে, সিআইডি না গিয়ে পুলিশ কি পোশাক পরে আরও বেলা করে যেতে পারত না? শামসুজ্জামানকে কি সরাসরি আদালতে নিয়ে যাওয়া যেত না? আশা করি, রাষ্ট্রের সব বাহিনী এ বিষয়গুলোর প্রতি আরও মনোযোগী হবে। এবার সংবাদপত্রের স্বাধীনতার অপব্যবহারের বিষয়ে আলোকপাত করা যাক।

একটি সংবাদপত্রের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে তথ্য বিকৃত না করে পক্ষপাতহীনভাবে পাঠকের কাছে তুলে ধরা। তবে সেই তথ্য বিকৃত করে ভুলভাবে পাঠকের কাছে পৌঁছানো হলে সেটি সাংবাদিকতার মূল উদ্দেশ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে যায়। প্রকাশিত প্রতিবেদনটিতে মূলত সেটিই প্রতীয়মান হয়েছে।

বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের সংবাদপত্র আচরণবিধি, ১৯৯৩ (২০০২ সালে সংশোধিত)-এর ৮(খ) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ‘সংবাদপত্র ও সাংবাদিক বিতর্কিত বিষয়ে নিজস্ব মতামত জোরালোভাবে ব্যক্ত করার অধিকার রাখেন, কিন্তু এরূপ করতে গিয়ে পাঠককে প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে কোন ঘটনাকে বিকৃত’ করা যাবে না। তাছাড়া একই নীতিমালার ৮(গ) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ‘পাঠককে প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে কোন ঘটনাকে বিকৃত না করা’ সংবাদপত্রের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।

সংবাদটির দিকে তাকালে দেখা যায় মূল সংবাদে যেখানে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে একজন দিনমজুরের, সেখানে ছবি দেওয়া হয়েছে একজন শিশুর যা স্পষ্টতই সংবাদ বিকৃতির শামিল এবং একই সঙ্গে বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের সংবাদপত্র আচরণবিধির পরিপন্থী।

অভিযুক্ত সাংবাদিক আরও একটি ভুল বা অপরাধ যেটি করেছেন তা হলো সাত বছরের একটি শিশুর ছবি প্রকাশের আগে তার বাবা-মাকে সেটি অবহিত করা হয়েছে কি না বা শিশুটিকে আগে জানানো হয়েছে কি না যে তার ছবি পত্রিকায় প্রকাশিত হতে যাচ্ছে সেটি নিশ্চিত করা। যদি তিনি সেটা না করে থাকেন তবে তিনি এবং পত্রিকাটি নিঃসন্দেহে সাংবাদিকতার নৈতিকতার পরিপন্থী কাজ করেছেন। আরেকজনের উদ্ধৃতির সঙ্গে একজন শিশুর ছবি প্রকাশ এবং ছবিটি ব্যবহারের ফলে শিশুটির কোনোরূপ ক্ষতি হবে কি না সেটি পত্রিকাটির বিবেচনা করা উচিত ছিল।   

জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদের অনুচ্ছেদ ৩৬-এ বলা আছে, শিশুদের সব ধরনের শোষণের হাত থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। অভিযোগ উঠেছে, এই সংবাদে সাত বছরের একটি শিশুকে ১০ টাকা দিয়ে ভুলিয়ে তার ছবি নিয়ে বিকৃতভাবে পত্রিকায় উপস্থাপন করা হয়েছে- যা এই অনুচ্ছেদের স্পষ্ট লঙ্ঘন।

সাংবাদিকতায় শিশুদের নিয়ে রিপোর্ট করার ক্ষেত্রে ইউনিসেফের কিছু গাইডলাইন আছে। গাইডলাইনটিতে যে ছয়টি নীতিমালার উল্লেখ রয়েছে, সেখানে ‘প্রিন্সিপলস ফর ইথিকাল রিপোর্টিং অন চিলড্রেন’ শিরোনামের দ্বিতীয় নীতিমালায় বলা হয়েছে, শিশুদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের প্রাইভেসি বা গোপনীয়তার বিষয়টিকে প্রাধান্য দিতে হবে। তবে সেটা পত্রিকাটি কতটুকু করতে পেরেছে সেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। এ ছাড়া একই শিরোনামের ৬ নম্বর নীতিমালায় আরও বলা হয়েছে, সংবাদ বা ছবি প্রকাশের ক্ষেত্রে একটি শিশু যাতে কোনো ঝুঁকিতে না পড়ে সেটাও খেয়াল রাখতে হবে। অথচ এই ঘটনাতে শিশুটির নিরাপত্তা যে ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর শিশুটির নিরাপত্তার কথাটি কিন্তু আমরা বেমালুম ভুলতে বসেছি। 

যুক্তরাজ্যের বহুল প্রচারিত দৈনিক ‘দ্য গার্ডিয়ান’ তাদের সাংবাদিকদের জন্য প্রণীত নীতিমালায় বলেছে, ১৬ বছরের কম বয়সী শিশুদের সাক্ষাৎকার বা ছবি প্রকাশের ক্ষেত্রে তাদের পিতা-মাতার অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের দ্য নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা তাদের সাংবাদিকদের জন্য প্রণীত নীতিমালার ১৩ নম্বর অনুচ্ছেদে তথ্য সঠিকভাবে উপস্থাপন করার প্রয়োজনীয়তা এবং ছবি প্রকাশের ক্ষেত্রে ন্যায়পরায়ণতার ওপর বিশেষভাবে জোর দিয়েছে।  এই নীতিমালাগুলোর কোনোটি কি এখানে অনুসরণ করা হয়েছে? প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যাচ্ছে।

বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম বিবিসি তাদের সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে শিশুদের সুরক্ষার বিষয়টিতে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছে। বিবিসির সম্পাদকীয় নীতিমালার অনুচ্ছেদ ৯.১-এ বলা হয়েছে ১৬ বছরের কম বয়সী একজন মানুষকে শিশু বলে গণ্য করা হবে এবং বিবিসি সব সময় সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে তাদের সুরক্ষার বিষয়টিতে গুরুত্ব প্রদান করার পাশাপাশি সংবাদ প্রকাশের কারণে তাদের যাতে কোনো প্রকার ক্ষতিসাধন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখবে এবং একই সঙ্গে তাদের পিতা-মাতার মতামত নেবে। এমনকি ডয়েচে ভেলে তাদের নীতিমালায় সাংবাদিকদের গোপনীয়তা রক্ষা, তথ্য ও ছবি ব্যবহারের ক্ষেত্রে যথাযথ অধ্যবসায় ও বিচক্ষণতার পরিচয় দেওয়া এবং তথ্য সংগ্রহে যে কোনো ধরনের উপহার দেওয়ার বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বনের কথা বলেছে। পৃথিবীজুড়ে বহুল পঠিত সব পত্রিকার দিকেও যদি আমরা খেয়াল করি তাহলে দেখা যায়, সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে তারা সবাই কিছু নীতিমালা বেশ ভালোভাবেই মেনে চলার চেষ্টা করে। সংবাদ প্রকাশের জন্য তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক এই মানদন্ডগুলোর প্রতি বোধহয় খেয়াল রাখা প্রয়োজন। এখন বিষয় হলো, পত্রিকাটি কি এই মানদন্ডগুলো সম্পর্কে জানত না? নাকি জেনেও এই মানদন্ডগুলোর প্রতি উদাসীনতা প্রদর্শন করছে? পাঠক হিসেবে এই নীতিমালাগুলো পত্রিকাটি মেনে চলবে সেটাই আমরা আশা করি। সরকার যদি সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় মনে করে থাকে যে, প্রথম আলো বা সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক কোনো অপরাধমূলক কাজ করেছে, তাহলে সরকারের উচিত ছিল প্রথমেই তা সুষ্ঠুভাবে তদন্ত করে দেখা।

তদন্ত করার পর পত্রিকাটির বিরুদ্ধে প্রাথমিক অভিযোগ পাওয়ার পরই শুধু পত্রিকাটির সম্পাদকের নাম নেওয়া উচিত ছিল। সুষ্ঠু তদন্তের আগেই দেশের শীর্ষ একটি দৈনিকের সম্পাদককে যখন এ ধরনের একটি মামলায় জড়ানো হয় এবং ফলশ্রুতিতে তাকে যখন জামিনের জন্য আবেদন করতে হয় সেটা নিশ্চিতভাবেই ভালো কোনো ইঙ্গিত দেয় না।  পরিশেষে এটা বলা যায়, প্রথম আলোর এই সংবাদ প্রকাশ এবং তার পরবর্তী ঘটনায় একদিকে যেমন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক গ্রেফতার ও রিমান্ড সংক্রান্ত উচ্চ আদালতের নীতিমালা লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে, তেমনি সংবাদপত্রের স্বাধীনতার অপব্যবহারের মতো ঘটনারও আভাস পাওয়া গেছে- যা কোনোভাবেই কাম্য ছিল না।

লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট প্রসিকিউটর, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল

সর্বশেষ খবর