বুধবার, ১২ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

শিক্ষাবিদের ইতিহাসচর্চা আর রাজনীতির দৈন্য

খায়রুল কবীর খোকন

শিক্ষাবিদের ইতিহাসচর্চা  আর রাজনীতির দৈন্য

হালাকু খান, চেঙ্গিস খানদের আসল উত্তরসূরি বর্বরতম এক সামরিক বাহিনী পাকিস্তানি ইয়াহিয়া খান-টিক্কা খান-নিয়াজির চরম নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে আমরা বাঙালিরা বীরবেশে লড়তে পেরেছি ৯ মাসের একটি স্বাধীনতাযুদ্ধ। সংক্ষিপ্ত সময়কালের স্বাধীনতার সশস্ত্র-যুদ্ধ সমাপন এবং একটি জাতির হাজার বছরের শোষণমুক্তির লড়াইটা অসমাপ্তই থেকে গেল।

ভৌগোলিক স্বাধীনতার জন্য একটা মানচিত্র- বিশ্ব-মানচিত্রের ভিতরে একটা সুনির্দিষ্ট সার্বভৌম-এলাকা চিহ্নিত একটা ভূমিখন্ড, একটা সুশোভন জাতীয় পতাকা, একটা জাতীয় সংগীত এসব পাওয়া সব কিছুই হলো, কিন্তু নিপীড়িত দেশবাসীর শোষণমুক্তি, প্রত্যেকের জন্য প্রতিটি বেলায় দুমুঠো খাবার আর পরনের মোটা কাপড় এসবসহ শান্তিময় সুখময় একটা সুশাসনের সমাজ পাওয়া আর হলো না। পাওয়া হলো না স্বাধীনতার সবচেয়ে বড় উপাদান গণতন্ত্র। অধরা রয়ে গেল আমাদের কোটি কোটি দেশবাসীর মানবাধিকার; সব মৌলিক অধিকার অর্জন, সেসব তো অনেক দূরের কথা! দুঃশাসন আর দূর হলো না! আমরা জাতি হিসেবে এই বাংলাদেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে পেয়েছি-একটা বড় প্রত্যাশা-নিজেদের ভাগ্য নিজ হাতে-গড়ার অধিকার। সেটা অবশ্যই অনেক বড়-পাওয়া। তবে তার যথার্থ ব্যবহার চাই, অপব্যবহার নয়, কোনোমতেই।

একাত্তরে এত বড় গণহত্যাকান্ডটি ঘটাল বর্বর পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী, তার সমর্থনে ছিল মার্কিন-চীন নয়া সাম্রাজ্যবাদী জোট, তাদের পরোক্ষ সমর্থকরাও রাষ্ট্রীয়ভাবে বিশ্ব মানবসভ্যতার দোহাই দিয়েও এই ভয়ংকর, নিষ্ঠুর, আর পৈশাচিকতার বিরুদ্ধে সামান্যতম প্রতিবাদও করলেন না, ধ্বনিত হলো না এতটুকু প্রতিবাদ-ধ্বনি। এমনকি গণহত্যা-পরবর্তী বছরগুলোতে এমন ভয়ংকর গণহত্যার বিশ্বব্যাপী নিন্দা-স্বীকৃতি জুটল না, পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি পাত্তা পেল না আন্তর্জাতিক বিশ্বে।

তবে বাঙালি জাতির আছে বিশাল অর্জন। তারা সাধারণ মানুষকে যুদ্ধে নামাতে পেরেছিল। সেটা সম্ভব না হলে বাঙালি জাতির সার্বিক জয় বলে পরিগণিত হতো না এই মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার সশস্ত্র লড়াই। এবারকার স্বাধীনতা দিবসে প্রথম সারির বাংলা দৈনিকটিতে চমৎকার মন্তব্য করেছেন শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার একজন সেরা পন্ডিত প্রফেসর ড. সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম। তাঁর মতে- ‘১৯৭১ সালে ইতিহাসটাই পাল্টে দিয়েছিল বাংলাদেশের মানুষ। এ জন্য এই ইতিহাস পৃথিবীর উচ্চবর্গের দেশের উচ্চবর্গের নেতাদের অস্বস্তিতে ফেলেছিল, যেমন ১৯৪৭ সাল থেকে বাংলাদেশের ২৪ বছরের ইতিহাস অস্বস্তিতে ফেলেছিল, পাকিস্তানের উচ্চবর্গ সামরিক-শিল্পপতি-ভূমি-মালিকবর্গকে। ১৯৭১-এর মার্চজুড়ে, এর পরের প্রতিটি মাসজুড়ে ইতিহাস প্রত্যক্ষ করেছে গণমানুষের অভ্যুত্থান। এক জনযুদ্ধ একত্র করেছিল সারা দেশের মানুষকে এবং এর ‘সাধারণ মানুষজন’ যদি যুদ্ধে না নামত, বাংলাদেশের জন্মই হতো না। এই সাধারণ মানুষজন থেকেই এসেছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা, এঁরাই একাত্তরে সারা গ্রামে তাঁদের দরজা খুলে দিয়েছিলেন শহর থেকে পালিয়ে আসা মানুষজনের জন্য। যে ৩০ লাখ মানুষ প্রাণ দিয়েছিলেন একাত্তরে, তাঁদের সিংহভাগ ছিলেন তাঁরাই। তাঁদের মাতা-স্ত্রী-কন্যারা তাঁদের সম্ভ্রম হারিয়েছেন, অনেকে হারিয়েছেন প্রাণও।’ শিক্ষাবিদ সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম স্বাধীনতার ইতিহাসচর্চার সময় নানান বিভাজিত তথ্যাবলির উপস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে অভিমত দিয়েছেন-‘আমরা সব কিছুর মধ্যেই ইতিহাসটাকে যেন সঠিকভাবে পড়ি।’

একই দিনের পত্রিকায়ই ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদকের বাণী দেখা যায়- ‘বিএনপির কর্মকান্ডের বিষয়ে’, ঠিক যেন শিক্ষাবিদ গবেষকরা যা বলছেন তার উল্টো আচরণ। দেশের সব ইতিহাস গবেষকই আমাদের স্বাধীনতার পুরো সংগ্রাম এবং সশস্ত্র যুদ্ধটার পুরো ইতিহাস অবধি সঠিক পন্থায় বিশ্লেষণ করা ও তারপর মূল্যায়ন এবং যথাযথ অভিমত দেওয়ার ওপর গুরুত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদকসহ সব নেতা ঢালাও অভিযোগ করে যাচ্ছেন- ‘বিএনপি পাকিস্তানের দালাল পার্টি, তারা ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস পালন করে না, পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানোর জন্য একবারও নিন্দা করে না।’ অথচ এ কথাগুলো সত্য নয়, বিএনপি গণহত্যা চালানোর জন্য অবশ্যই পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রকাশ করে। বিএনপি নেতা জিয়াউর রহমান তো একাত্তরের ২৫ মার্চ মধ্যরাতের পরে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের ক্যান্টনমেন্টে ও বন্দরনগরীতে সরাসরি বিদ্রোহ করেন এবং সশস্ত্র যুদ্ধ আরম্ভ করেন, সামান্যতম দেরিও তিনি করেননি, দেশপ্রেমিক সেনা-অফিসারের দায়িত্ব ভোলেননি ১ মিনিটের জন্যও। সমগ্র চট্টগ্রামবাসী, দেশবাসী অনেকেই সেসব ঘটনার সাক্ষী। জিয়াউর রহমানের সেই যুদ্ধের সরাসরি সাথী অনেকেই বিএনপি নেতা, তা ছাড়া সমগ্র বিএনপি নেতা ও সংগঠকদের মাঝে এখনো অনেকে জীবিত রয়েছেন, কারও কারও স্বাভাবিক প্রাণত্যাগ ঘটেছে হয়তো, তবে তাদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের ঘটনা তো কেউ মুছতে পারবে না। এমনকি ‘গ্যালান্ট্রি অ্যাওয়ার্ড’ পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যাও বিএনপিতে কম নয়। সরকারি দলের যেসব নেতা মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র লড়াইয়ে যুদ্ধক্ষেত্রের ধারেকাছেও ছিলেন না, নিজের ও স্বজনদের জানমাল নিয়ে পালিয়ে গেছেন, তারাও আজ অন্যদের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার, বিষোদগার করেন, দলবাজির রাজনীতির নোংরামি জাহির করার জন্য। এসব তাদের পরিহার করা উচিত, নিজেদের আরও উদারতা প্রদর্শন জরুরি। স্বাধীনতা সংগ্রামের সবকিছু নিয়ে সঠিক ইতিহাসচর্চা, অনুশীলন জরুরি, তবে অবশ্যই তা হতে হবে শতভাগ সত্যনিষ্ঠার ভিত্তিতে, প্রকৃত দেশপ্রেমের ভিত্তিতে। কেবল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতি গাত্রদাহ ঝাড়ার পরিণাম কখনো সঠিক ইতিহাসচর্চার নমুনা বহন করতে পারে না, পারে না জাতীয় দায়িত্ব পালন করতে।

লেখক : বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব, সাবেক সংসদ সদস্য ও ডাকসু সাধারণ সম্পাদক

সর্বশেষ খবর