মঙ্গলবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

স্থানীয় সরকারের উপজেলা স্তর

মোশাররফ হোসেন মুসা

স্থানীয় সরকারের উপজেলা স্তর

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার পদসংক্রান্ত উপজেলা পরিষদ আইনের ৩৩ ধারা সম্প্রতি বাতিল করেছেন হাই কোর্ট। এর ফলে উপজেলা পরিষদে ইউএনওরা মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। উপজেলা পরিষদে ইউএনওরা শুধু সাচিবিক সহায়তা দেবেন। উল্লেখ্য, উপজেলা পরিষদের ৩৩(১) নম্বর ধারায় বলা হয়েছে : উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হবেন এবং তিনি পরিষদকে সাচিবিক সহায়তা দেবেন। ২ নম্বর ধারায় বলা আছে : পরিষদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন, আর্থিক শৃঙ্খলা প্রতিপালন এবং বিধির মাধ্যমে নির্ধারিত অন্য কার্যাবলি পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা সম্পাদন করবেন। ২০২১ সালে উপজেলা চেয়ারম্যান অ্যাসোসিয়েশনের নেতৃবৃন্দ হাই কোর্ট বিভাগে এ-সংক্রান্ত একটি রিট দায়ের করেন। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২৯ মার্চ রুলের চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে হাই কোর্ট উপরোক্ত রায় দেন (সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন ৩০ মার্চ)। এ রায়ের ফলে ১৭টি দফতরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা উপজেলা পরিষদের অধীনে থেকে চাকরি করতে বাধ্য থাকবেন। ইতোমধ্যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় উপজেলা পরিষদে ন্যস্ত এবং উপজেলা পরিষদে ন্যস্ত নয় এমন কর্মকর্তাদের তালিকা চেয়ে পত্র পাঠিয়েছে। স্থানীয় সরকার হতে হলে তার নিজস্ব আয়ের ব্যবস্থা থাকতে হবে। প্রথমে তার আয় দ্বারা অফিস খরচ নির্বাহ করবে, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করবে। তারপর অবশিষ্ট আয় দ্বারা (প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় সরকারের সহযোগিতা নিয়ে) এলাকায় উন্নয়ন সাধন করবে। উপজেলার নিজস্ব আয় বলতে বোঝায় হাটবাজারের ইজারালব্ধ আয়, ১% ভূমি হস্তান্তর কর, জলমহাল কর, বাসা ভাড়া, বিভিন্ন ভ্যাট-ট্যাক্স ইত্যাদি। এ সামান্য আয় দিয়ে ১৭টি দফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন প্রদান মোটেই সম্ভব নয়। বর্তমান স্থানীয় সরকারমন্ত্রী এর আগে এক সেমিনারে বলেছিলেন, যেসব পৌরসভা নিজস্ব আয় দিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দিতে অক্ষম সেসব পৌরসভাকে ইউনিয়ন পরিষদে রূপান্তর করা হবে। অর্থাৎ নিজস্ব আয় থাকা স্থানীয় সরকারের পূর্বশর্ত।

আমরা জানি, উপজেলা প্রশাসনের ১৭টি দফতরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা উপজেলা পরিষদ নামক কথিত স্থানীয় সরকারের অধীনে চাকরি করতে বাধ্য থাকবেন এমন ঘোষণা দিয়ে চাকরিতে যোগ দেননি। যেমনিভাবে ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের কর্মচারীরা করে থাকেন। তবে এ দেশে একটি মাত্র ‘সরকারব্যবস্থা’ বহাল থাকায় সরকার যে কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীকে স্থানীয় সরকারে ন্যস্ত করতে পারে। এটি আইনত অবৈধ নয়; কিন্তু নীতিগত দিক থেকে কতটুকু সঠিক তা প্রশ্ন করার অবকাশ রয়েছে। এরশাদ সরকার ১৯৮২ সালে প্রশাসনিক নীতি বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে (গণতান্ত্রিক নীতি বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্য নয়) ‘উপজেলা পরিষদ এবং উপজেলা প্রশাসন পুনর্গঠন’ অধ্যাদেশ জারি করে। এ অধ্যাদেশ অনুযায়ী একজন নির্বাচিত চেয়ারম্যান, প্রতিনিধি সদস্য, অফিশিয়াল সদস্য এবং মনোনীত সদস্য নিয়ে উপজেলা পরিষদ গঠন করা হয়। ১৯৮২ সালে সরকারি রেজুলেশন অনুযায়ী উপজেলা পর্যায়ে সরকারি কার্যাবলি মূলত দুই ভাগে ভাগ করা হয়। তা হলো, ১৩টি সংরক্ষিত কাজ ও ১০টি হস্তান্তরিত কাজ। এ পদ্ধতির আওতায় সংরক্ষিত ও হস্তান্তরিত কাজগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে উপজেলা পরিষদে ন্যস্ত করা হয়। তখন বিধান অনুযায়ী সংরক্ষিত বিষয়াদির কর্মকর্তাদের (মুনসেফ এবং ম্যাজিস্ট্রেট ছাড়া) উপজেলা পরিষদের কাছে জবাবদিহি করতে হতো। উপজেলা গ্রামীণ স্থানীয় সরকারের মধ্যবর্তী স্তর হলেও এ পদ্ধতিটি নতুন হওয়ায় এর প্রয়োজনীয়তা ও অপ্রয়োজনীয়তা তেমন বোঝা যায়নি। তা ছাড়া সে সময় উপজেলায় বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়। সে অর্থ দ্বারা উপজেলায় ন্যস্তকৃত বিভাগগুলোর অফিস, আদালত ভবন, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ইত্যাদি নির্মাণ ছাড়াও উপজেলামুখী রাস্তাঘাট নির্মাণ করা শুরু হয়। সরকারের এসব উন্নয়ন কর্মকান্ডে বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক নেতা-কর্মী জড়িয়ে পড়েন। ফলে এটি স্থানীয় সরকার না কেন্দ্রীয় সরকারের মাঠ প্রশাসন তা বুঝে উঠতে অনেকেই সক্ষম হননি। কিন্তু ১৯৯২ সালে বিএনপি সরকার এটির বিলুপ্তি ঘোষণা করলে গোমর ফাঁস হতে শুরু করে। যেমন এ স্তরটি ইউনিয়ন পরিষদের (এবং যদি পৌরসভা থাকে তাদের) নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত পরিষদ দ্বারাও পরিচালনা করা সম্ভব তা প্রমাণ হয়ে পড়ে। সরকারি কর্মকর্তারা স্থানীয় কোনো কর্তৃপক্ষের অধীনে চাকরি করতে রাজি নন। অথচ উন্নত বিশ্বে গিয়ে তারা নগর সরকারের অধীনে চাকরি করেন। মানুষের যৌথভাবে বেঁচে থাকার প্রচেষ্টা থেকে সরকারব্যবস্থার উৎপত্তি ঘটেছে। প্রশাসন ছাড়া সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচালনা করা অসম্ভব ব্যাপার। একটি দেশের সব শ্রেণির মানুষের উন্নয়নের জন্য দাফতরিক পদক্রমে শ্রেণিবিভাজিত কর্মচারী দ্বারা প্রশাসন পরিচালনা করতে হয়, যা আমলাতন্ত্র নামে পরিচিত। তবে বিদ্যমান প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে গণতান্ত্রিক করার দাবি যৌক্তিক।

এ দেশের আয়তন, ভৌগোলিক অবস্থান, ইতিহাস-ঐতিহ্য, চিন্তাভাবনা ইত্যাদি বিবেচনায় নিলে দুই ধরনের কাজ রয়েছে। তা হলো জাতীয় কাজ ও স্থানীয় কাজ। স্বাভাবিক কারণে দুই ধরনের সরকারব্যবস্থা তথা কেন্দ্রীয় সরকার ও স্থানীয় সরকারব্যবস্থাই বাস্তবায়নযোগ্য। তখন জাতীয় কাজ কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য এবং যাবতীয় স্থানীয় কাজ (গ্রামীণ ও নগরীয়) স্থানীয় সরকারের জন্য (তথা জেলা সরকার, নগর সরকার, ইউনিয়ন সরকার ইত্যাদিতে) নির্দিষ্ট থাকবে। তখন স্বাভাবিক কারণে জাতীয় কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে এবং স্থানীয় কাজের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা স্থানীয় সরকারের অধীনে চাকরি করতে বাধ্য থাকবেন। প্রয়োজনে স্থানীয় সরকারের জন্য আলাদা ক্যাডার সার্ভিস চালু করা যেতে পারে। তা ছাড়া এখন পর্যন্ত স্থানীয় সরকারের সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ স্তরও নির্ধারিত হয়নি। সে কারণে বর্তমানের নগরায়ণমুখী অবস্থা সামনে রেখে স্তরবিন্যাস করতে হবে। পুরো দেশটি নগর হয়ে গেলে উপজেলার আপনাআপনি বিলুপ্তি ঘটবে। ভবিষ্যৎ ভাবনায় ‘জেলা সরকার’ হতে পারে ইউনিয়ন সরকার ও নগর সরকারের সর্বোচ্চ স্তর।

লেখক : গণতন্ত্রায়ণ ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারবিষয়ক গবেষক

সর্বশেষ খবর