১৫ জুন ২০১৩। রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট- এই চার সিটি করপোরেশন নির্বাচন একযোগে অনুষ্ঠিত হলো। নির্বাচনে সব সিটি করপোরেশনেই পরাজিত হলেন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীরা। এর কদিন পরই (৬ জুলাই) অনুষ্ঠিত হলো গাজীপুর সিটি নির্বাচন। সেখানেও আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হেরে গেলেন। রাজশাহীতে আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট প্রার্থী খায়রুজ্জামান লিটন পেয়েছিলেন ৮৩ হাজারের কিছু বেশি ভোট। আর বিএনপি প্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল পান প্রায় ১ লাখ ৩২ হাজার ভোট। খুলনায় আওয়ামী লীগ প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেক পেয়েছিলেন ১ লাখ ২০ হাজারের কিছু বেশি ভোট। অন্যদিকে বিএনপি প্রার্থী মনিরুজ্জামান মনি তার চেয়ে প্রায় ৬০ হাজার বেশি ভোট পান। বরিশালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শওকত হোসেন হিরণ, তার প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির আহসান হাবিব কামালের চেয়ে প্রায় ২৫ হাজার ভোট কম পেয়ে পরাজিত হন। সিলেটে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বদরউদ্দিন কামরান, বিএনপির আরিফুল হক চৌধুরীর কাছে ৩০ হাজারের বেশি ভোটে হেরে যান। আর ৬ জুলাই গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আজমত উল্লা ১ লাখেরও বেশি ভোটে পরাজিত হন বিএনপির এম এ মান্নানের কাছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এই পাঁচ সিটির নির্বাচন আওয়ামী লীগকে কোণঠাসা করেছিল। বিএনপি ক্ষমতার সুবাস পাচ্ছিল। এ সময় যদি এই বিজয়ের ধারাবাহিকতায় বিএনপি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিত, তাহলে আওয়ামী লীগ যে বড় ধরনের চাপে পড়ত এ নিয়ে কোনো সংশয়ই নেই। কিন্তু পাঁচ সিটি নির্বাচনে বিপুল বিজয়ের ফসল ঘরে তুলতে পারেনি বিএনপি। পাঁচ সিটিতে জয়ের পর বিএনপি নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে অনড় অবস্থান গ্রহণ করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া কোনো নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না বলেও ঘোষণা দেয়। শুরু হয় সহিংস আন্দোলন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে একের পর এক সমঝোতা প্রস্তাব দেন। প্রথমে তিনি নির্বাচনকালীন জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। এ প্রস্তাবে শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বয়ে একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাব দেন। ওই সরকারে বিএনপিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ সব মন্ত্রণালয় দিতে রাজি হন। কিন্তু বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ওই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এরপর শেখ হাসিনা বিএনপি চেয়ারপারসনকে গণভবনে চায়ের আমন্ত্রণ জানান। প্রধানমন্ত্রী হরতাল, জ্বালাও- পোড়াও ছেড়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সংকট সমাধানের আহ্বান জানান। বেগম জিয়াকে টেলিফোন করেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু বেগম জিয়া টেলিফোনে ছিলেন আক্রমণাত্মক। তার কিছু বক্তব্য ছিল রাজনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত। কুরুচিপূর্ণ। একজন রাজনৈতিক নেতা এমন অশ্লীল ভাষায় কথা বলতে পারেন! এটি সাধারণ মানুষকে বেগম জিয়ার ব্যাপারে নেতিবাচক ধারণা দেয়। এ সময় সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচনের জন্য আন্তর্জাতিক উদ্যোগও নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বিএনপি তাদের অবস্থান থেকে সরে আসেনি। অবশেষে বিএনপির অংশগ্রহণ ছাড়াই ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিএনপির পুরোপুরি নির্বাচন বর্জন, জাতীয় পার্টির আংশিক বর্জনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই নির্বাচন ছিল উত্তেজনাহীন। ১৫৩টি আসনে প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। বাকি আসনেও ভোট হয় নামমাত্র। অনেকেই এটি ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনের মতো মনে করেছিলেন। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা পূরণের নির্বাচন। আওয়ামী লীগের প্রায় সবাই ধরেই নিয়েছিল খুব শিগগিরই দেশে আরেকটি নির্বাচন হবে। কিন্তু ২০১৪-এর ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর গঠিত জাতীয় সংসদ মেয়াদ পূর্ণ করে। জনগণ বিএনপির জেদকে, সহিংস রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করে। বিনা ভোটে অর্ধেক এমপি হওয়ার পরও সাধারণ মানুষ ওই সরকারকে সমর্থন দেয়। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে বেগম জিয়া সারা দেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য অবরোধের ডাক দিয়েছিলেন। ওই সময় পেট্রলবোমা, অগ্নিসংযোগ, বাসে গানপাউডার দিয়ে মানুষ হত্যার এক নারকীয় তান্ডব শুরু হয়। মানুষ এসব সন্ত্রাস এবং নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ করে। অকার্যকর হয়ে যায় বিএনপির আন্দোলন। জনগণ বিএনপির ওপর রীতিমতো ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত বিএনপির ওই আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। বিএনপির রাজনৈতিক ভুলের তালিকা করা হলে ২০১৪-এর নির্বাচন বর্জন প্রথম দিকে থাকবে। ওই নির্বাচন যদি বিএনপি বর্জন না করত তাহলে হয়তো তাদের পরিণতি আজকের মতো হতো না। ২০১৩ সালের জুন-জুলাইয়ে পাঁচ সিটি নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপির পক্ষে একটি জোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু ভুল কৌশলের কারণে সেই জোয়ারকে কাজে লাগাতে পারেনি দলটি। উপরন্তু জ্বালাও-পোড়াও এবং অগ্নিসন্ত্রাসের কারণে বিএনপি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। ভুল রাজনীতি এবং ভুল কৌশল একটি রাজনৈতিক দলকে যে কতটা বিপর্যস্ত করতে পারে ২০১৩ এবং ২০১৪-এর ঘটনা প্রবাহ তার বড় প্রমাণ।
২০১৩ সাল থেকে ২০২৩। ঠিক ১০ বছর পর প্রায় একই রকম রাজনৈতিক পরিস্থিতির সামনে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ। নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যে পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে। আগামী ২৫ মে অনুষ্ঠিত হবে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন।
আওয়ামী লীগ যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা দেশগুলোকে এই নির্বাচনকে উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করতে পারবে। বলতে পারবে, বিএনপি ছাড়া ভালো নির্বাচন হয় না, এরকম ধারণা সঠিক নয়। এটি সংবিধান অনুসরণ করে জাতীয় নির্বাচন করার সুযোগ সৃষ্টি হবে। বলাই বাহুল্য, ২০১৪ সালের মতো সেই নির্বাচন হবে না। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, ইসলামী দলসমূহ, ১৪ দলের শরিকরা যদি আলাদা আলাদাভাবে নির্বাচন করে, সেক্ষেত্রে নির্বাচন একেবারে ঠান্ডা থাকবে না। কাজেই আগামী নির্বাচনের রোডম্যাপ চূড়ান্ত করতে এই নির্বাচন ক্ষমতাসীনদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যদি সব সিটিতেও পরাজিত হয় তাহলেও তাদের ক্ষতি নেই। এই বোধ আওয়ামী লীগের অতি উৎসাহীদের মধ্যে সঞ্চালিত হতে হবে। নির্বাচনে যে কোনো উপায়ে জয়ী হওয়ার এক অযৌক্তিক মানসিকতা আওয়ামী লীগের কারও কারও মধ্যে ইদানীং প্রবলভাবে লক্ষ্য করা যায়। এটা আওয়ামী লীগের সর্বনাশ করছে। ভবিষ্যতে আরও করবে। ২০১৩-তে সব সিটিতে হেরেই আওয়ামী লীগ জিতেছিল। এবারও আওয়ামী লীগকে সেই পরীক্ষাই দিতে হবে। একদিকে ভালো ভোট, অন্যদিকে জয়। এটা আওয়ামী লীগের জন্য দ্বিমুখী সংকট। জনপ্রিয়তা প্রমাণ করতে গিয়ে যদি নির্বাচনে অতি উৎসাহী আওয়ামী লীগাররা কারচুপি করে, প্রশাসনকে ব্যবহার করে কিংবা অনিয়ম ও আধিপত্য বিস্তার করে, সেটি ক্ষমতাসীনদের জন্য হবে আত্মঘাতী। এর ফলে বিরোধী পক্ষের দাবিকে জোরালো করবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে জনমত এবং আন্তর্জাতিক চাপ তৈরি হবে। তাই পাঁচ সিটি নির্বাচন আওয়ামী লীগের জন্য অনেকটা ‘জলে কুমির, ডাঙায় বাঘের মতোই।’ আওয়ামী লীগ কী করবে?
প্রশ্ন হলো, গত ১৪ বছরে আওয়ামী লীগের এত উন্নয়ন, এত অর্জন, তারপরও স্থানীয় নির্বাচনে জয় নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের এত সংশয় কেন? এত অনিশ্চয়তা কেন? কেন কারচুপি করে জিততে চায়? নির্বাচনে জয়ী হতে কেন পুলিশ লাগে? প্রশাসন প্রয়োজন হয়? এর কারণ আওয়ামী লীগ নিজেই। পাঁচ সিটিতে প্রার্থী ঘোষণার পর আওয়ামী লীগের গৃহদাহের খবর পাওয়া যাচ্ছে। গাজীপুরে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন দলের দীর্ঘদিনের ত্যাগী নেতা আজমত উল্লা। কিন্তু সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর তার পক্ষে নেই। তিনি নির্বাচন করবেন, এমন কথা গাজীপুরে কান পাতলেই শোনা যায়। শেষ পর্যন্ত যদি আজমত-জাহাঙ্গীর এক না হতে পারেন, তাহলে ‘দ্বিতীয় গোপালগঞ্জ’ খ্যাত গাজীপুরে আওয়ামী লীগের জন্য অপ্রত্যাশিত ফলাফল আসতে পারে। সিলেটে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন লন্ডন প্রবাসী আনোয়ার। সিলেট মহানগরের একটি বড় অংশ তার বিরুদ্ধে গোপনে কাজ করছেন, এমন খবর কে না জানে। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণেই গত সিটি নির্বাচনে বদরউদ্দিন কামরানের মতো জনপ্রিয় প্রার্থী হেরেছিলেন। এখন সেই কোন্দল কমেনি, বরং বেড়েছে। বরিশালে মনোনয়নে আওয়ামী লীগ সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বর্তমান মেয়র সাদিক আবদুল্লাহকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। জাতীয় নির্বাচনের আগে এটি শেখ হাসিনার একটি বার্তা। যারা জনপ্রতিনিধি হিসেবে দুর্নাম কুড়াবেন। ক্ষমতার দাপট দেখাবেন। অনিয়ম-স্বেচ্ছাচারিতা করবেন। তাদের আগামীতে সাদিক আবদুল্লাহর মতোই পরিণতি বরণ করতে হবে- এ বার্তাটি শেখ হাসিনা দিয়েছেন। কিন্তু বরিশালে কি আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ? সাদিক আবদুল্লাহপন্থিরা কি আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছেন? খোকন সেরনিয়াবাতকে হারাতে কি বিএনপির চেয়েও ভয়ংকর হবে না আওয়ামী লীগের একাংশ? কোন্দলে জর্জরিত, বিভক্ত আওয়ামী লীগই এখন আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় শত্রু। এই কোন্দল সহজ জয়কেও কঠিন করে তোলে। জয়ী হতে নির্বাচন ব্যবস্থাকেই কলুষিত ও কলঙ্কিত করে। তাই সিটি নির্বাচন আওয়ামী লীগের জন্য অগ্নিপরীক্ষা। নিজেদের অন্তর্কলহ পাশ কাটিয়ে ক্ষমতাসীনরা কীভাবে সুষ্ঠু নির্বাচন করে তা দেখবেন দেশবাসী এবং বিশ্ব।
আগামী প্রায় দুই মাস সিটি নির্বাচন, তাই শুধু ভোটের লড়াই হবে না, হবে রাজনৈতিক কৌশলের লড়াই। দেখার বিষয় এই কৌশলের লড়াইয়ে কে জেতে, আওয়ামী লীগ না বিএনপি?
লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত