মায়াবিশারদ মারীচ অদ্ভুত শোভাময় স্বর্ণ মৃগের রূপ ধারণ করে সীতার মন হরণ করে এবং সেই মৃগ ধরার জন্য রাম-লক্ষণ দূরে সরে যাওয়া মাত্রই রাবণ এসে সীতাকে হরণ করে নিয়ে যায়। স্বর্ণালি বর্ণের মনোহর এই মৃগ শত শত রৌপ্য বিন্দুতে চিত্রিত। সীতাকে প্রলোভিত করার জন্য সে ঘাস ও পাতা খেতে খেতে একবার একদিকে, আবার অন্যদিকে যায়। কখনো বিচিত্র সব ক্রীড়া করে, কখনো বসে, একটু দূরে সরে গিয়ে আবার ফিরে আসে। অন্যান্য মৃগ তাকে দেখে কাছে যায়, কিন্তু গা শুঁকেই পালায়। বাল্মিকী রচিত এবং রাজ শেখর বসু অনূদিত পৌরাণিক কাহিনি রামায়ণে মায়াবিশারদ রাক্ষস মারীচের যে চিত্র দেখি, আশ্চর্যজনক হলেও তার সঙ্গে আজ বাংলাদেশের বিভিন্ন আঙিনায় সুবেশিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত একশ্রেণির মানুষের চরিত্রের হুবহু মিল দেখা যায়। তারা মায়াবিশারদ মারীচের মতোই রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ রূপে সুন্দর সুন্দর আকর্ষণীয় কর্মকান্ড এবং সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় তারা যে নিবেদিতপ্রাণ, এটাই সব সময় প্রমাণের চেষ্টায় থাকেন। যাতে তরুণ প্রজন্ম রাজনৈতিক চিন্তায় তাদের কথায় আকর্ষিত হয়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় পাগলপারা হলেও জাতির পিতা এবং স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের প্রতি সম্মান দেখায় না, এমন সব রাজনৈতিক দলের জন্য তাদের মায়াকান্নার শেষ নেই। প্রায় দুই দশক ধরে এ রকম কর্মকান্ড বৈচিত্র্যময় ধারায় চললেও কতজন তাদের আসল উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছেন জানি না। তবে এদের পরিচিত ও আসল চরিত্রের এক রূপ দেখা গেছে ২০০৭-০৮ মেয়াদে।
গণতন্ত্রের কথা বলতে বলতে এখন তাদের গলা শুকিয়ে এলেও তখন ২০০৭-০৮ মেয়াদে বলতে শোনা গেছে, দেশের স্বার্থে ১০ বছর নির্বাচন না হলেও গণতন্ত্রের কোনো ক্ষতি হবে না। তখন প্রথম দিকে মানুষ কিছুটা বিভ্রান্তিতে থাকলেও অল্প দিনের মধ্যেই তাদের আসল উদ্দেশ্য মানুষের কাছে ধরা পড়ে যায়। রাজনীতির মাধ্যমে জনমানুষের মন জয় ও তাদের সমর্থন নিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার সামর্থ্য তাদের নেই। তাই দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক সংকট, সংঘাত, সংঘর্ষ, অস্থিরতা সৃষ্টি হলে তাদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি হয়। তখন বলতে পারেন রাজনৈতিক দলগুলো দেশকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং তাদের মতো ভদ্র-সুশীলদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিলেই কেবল দেশ রক্ষা পাবে। বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতির হিসাবে বাংলাদেশকে নিয়ে যাদের কিছু নিজস্ব লক্ষ্য আছে, এমন আন্তর্জাতিক কিছু সংস্থা ও দেশ তখন তাদের জন্য ছাতা নিয়ে এগিয়ে আসে। রাজনীতিকে শেকড়হীন এই সুশীলবৃন্দ ক্ষমতায় বসে তখন দেশ ও মানুষের কল্যাণ নয়, ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করার জন্য যা প্রয়োজন সেটাই তারা করেন। তাদের মধ্যে সংবিধান বিশেষজ্ঞের অভাব নেই। এসব ুবিশেষজ্ঞ বলতে দ্বিধা করেন না যে, ১০ বছর জরুরি আইন থাকলেও সংবিধান তাতে কোনো বাধা হবে না। তারা এখন মুক্তিযুদ্ধের বড় বিরুদ্ধ পক্ষ বিএনপির জন্য মায়াকান্না করছেন। তবে তখন কিন্তু বিএনপিকেও রাজনীতি থেকে মাইনাস করতে তাদের চেষ্টার অন্ত ছিল না। এরও শানে নুজুল আছে। আওয়ামী লীগের বিপরীতে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি। তারা ভালো করে জানে আওয়ামী লীগ বিশেষ করে শেখ হাসিনা রাজনীতিতে শক্তিশালী অবস্থানে থাকলে উনাদের অভীষ্ট লক্ষ্য কখনো পূরণ হবে না। আওয়ামী লীগকে দুর্বল ও শেখ হাসিনাকে মাইনাস করা তাদের জন্য কোনো ব্যাপার নয়। তারা হয়তো বুঝেছেন, ২০০৭-০৮ মেয়াদে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি, দুই বড় দলকে একসঙ্গে মাইনাস করতে যাওয়া তাদের জন্য ভুল ছিল। তারপর গত ১৪ বছরে দেশের ভিতরে ও বহির্বিশ্বে অবস্থান আরও শক্তিশালী হওয়ায় আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে হটানো বা রাজনীতি থেকে মাইনাস করা তাদের জন্য এখন আরও কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং লক্ষ্য ঠিক রেখে কৌশলটা এখন একটু ঘষামাজা করে নতুনভাবে সাজিয়েছে। তাতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে তরুণ প্রজন্মকে যেমন কাছে টানতে চাইছে, তেমনি একই সঙ্গে রাজনীতির মাঠকে অস্থির করার জন্য মুক্তিযুদ্ধের চরম বিরোধী বিএনপির জন্য মায়াকান্না করছে। একটু গভীরে প্রবেশ করলেই যে কেউ এই দ্বিমুখী চরিত্র ও তার উদ্দেশ্য ধরতে পারবেন। গত ২৬ মার্চ তারা একটা ঘটনা ঘটিয়ে একদিকে যেমন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে জনগণকে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা করেছে, তেমনি টেস্ট কেস হিসেবে দেখতে চেয়েছে স্বাধীনতার প্রতি কটাক্ষ করা হলে জনগণের প্রতিক্রিয়া কেমন হয়। কারণ, ছদ্মবেশে হোক অথবা অন্যভাবে হোক, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের মহিমা তরুণ প্রজন্মের মনে যতই প্রোথিত হবে, ততই তার রাজনৈতিক ফল যাবে আওয়ামী লীগের ঘরে। কারণ, বিএনপি যে চরম মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দল তা এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য হয়ে গেছে। স্বাধীনতা ও সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা একই পাল্লায় মাপার কোনো সুযোগ আছে কি? কেউ সরকারের ব্যর্থতা দেখলে তার জন্য সব ধরনের সমালোচনা করতে পারেন। কিন্তু তার সঙ্গে জাতীয় গৌরব স্বাধীনতা শব্দ জুড়ে দেওয়া কেন? স্বাধীনতা চলে গেলে কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, নাকি সমস্যা আরও বাড়বে? এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর সবাই জানেন। তাই দেখা গেছে, ২৬ মার্চের সুপরিকল্পিত ঘটনার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষ চরম প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছে এবং ভীষণভাবে ক্ষেপে উঠেছে। তাই দেখা গেল, মানুষের প্রতিক্রিয়াকে সামাল দেওয়ার জন্য তারা নিজস্ব পত্রিকায় ডজনের পর ডজন কলাম লিখে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষেই তাদের অবস্থান এবং এর সপক্ষে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার জন্য বিগত দিনে তারা কী কী কাজ করেছেন তারও অনেক ফিরিস্তি তুলে ধরেছেন। একই সঙ্গে তারা গণতন্ত্র, নির্বাচন মানুষের বাকস্বাধীনতা ইত্যাদিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হিসেবে তুলে ধরলেও এসবের উৎপত্তি, স্থল বা শেকড় কোথায় সে সম্পর্কে একেবারে সম্পূর্ণ নীরব থাকেন। কারণ, সেটা বললেই তা আবার আওয়ামী লীগের পক্ষে চলে যায়। জাতির পিতা ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং সেগুলোকে আনুষ্ঠানিকভাবে মেনে নেওয়ার জন্য বিএনপির প্রতি আহ্বান জানাতে তাদের কখনো দেখা যায়নি। বাকস্বাধীনতার কথা বলে তারা সবকিছুকেই জায়েজ করতে চান। কিন্তু সব স্বাধীনতারই একটা সীমা আছে। সেই সীমা রক্ষিত না হলে কারও স্বাধীনতাই থাকবে না। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের বাস্তবতা তো বটেই, বৈশ্বিক বাস্তবতায় বড় বড় বোদ্ধা ধরেই নিয়েছেন জনগণ ও রাষ্ট্রের উন্নতি-সমৃদ্ধির জন্য গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা অপরিহার্য। গত বছর ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিট কর্তৃক প্রস্তুতকৃত প্রতিবেদনে দেখা যায়, পৃথিবীর যে কয়টি দেশের মূল্যায়ন তৈরি করা হয়েছে তার মধ্যে বাংলাদেশ মাঝামাঝি অবস্থানে আছে। যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ ইউরোপের কিছু দেশেরও গণতন্ত্রের মান নিম্নগামী, সেখানে বাংলাদেশ কিছুটা হলেও ওপরে উঠেছে। গণতন্ত্রের বৈশ্বিক যে গড় মান তার থেকেও বাংলাদেশের অবস্থান ওপরে। বিএনপি যদি মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধবাদী রাজনীতি থেকে ফিরে আসে, তাহলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে গণতান্ত্রিক মানে বাংলাদেশের অবস্থান পৃথিবীর প্রথম ৫০টি দেশের মধ্যে একটি হবে। বিএনপি গণতন্ত্র উদ্ধারের সংগ্রামে নেমেছে। কিন্তু তাদের গণতন্ত্রের স্বরূপ কি এমন হবে, যেখানে তাদের মন্ত্রীরা বলবেন একাত্তরে কোনো মুক্তিযুদ্ধ হয়নি, যে কথা ২০০১-০৬ মেয়াদে বিএনপি সরকারের মন্ত্রী আলী আহসান মুজাহিদ বলেছেন। বিএনপি সরকারের ওই মন্ত্রীর ওই কথা যদি সত্য হয় তাহলে তো কোনো মুক্তিযোদ্ধারই অস্তিত্ব থাকে না, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, জাতির পিতা এবং একাত্তরের অসাধারণ যে বিজয় তার কিছুই থাকে না। এ সম্পর্কে তথাকথিত নিরপেক্ষদের কোনো মন্তব্য দেখি না। এ বছরের শেষের দিকে বা আগামী জানুয়ারির প্রথম দিকে জাতীয় নির্বাচন হবে। তাতে কারা বিজয়ী হবে সেটা আগ বাড়িয়ে বলা বাস্তবসম্মত নয়। কিন্তু বিশ্বের গণমাধ্যম থেকে বলা হচ্ছে, আগামী নির্বাচনে জয়ী হয়ে টানা চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রী হতে চলেছেন শেখ হাসিনা। এই ভবিষ্যদ্বাণী কতটুকু যৌক্তিক তার বিচার-বিশ্লেষণও ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। করোনা মহামারি ও ইউক্রেন যুদ্ধের বিরূপ প্রভাবে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার পূর্বাভাস পাওয়া গেলেও বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের বাংলাদেশের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির যে বহির্প্রকাশ দেখতে পাচ্ছি তাতে বোঝা যায় বাংলাদেশ আপাতত কোনো বিপদের মধ্যে নেই। ভবিষ্যতে অর্থনীতির গতিকে সচল রাখতে এ বছরই চালু হচ্ছে বড় বড় অবকাঠামোগত সুবিধা। গত ২৫ এপ্রিল পানামার একটা বড় মাতৃজাহাজ ৮০ হাজার টন কয়লা নিয়ে মাতারবাড়ীতে নোঙর করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ গভীর সমুদ্রবন্দরের তালিকায় নাম লিখেছে। পায়রার গভীর সমুদ্রবন্দরও প্রায় প্রস্তুত, চলতি মাসেই হয়তো উদ্বোধন হবে। চট্টগ্রাম ও মোংলার সঙ্গে নতুন দুটি গভীর সমুদ্রবন্দর যোগ হওয়াতে বৈদেশিক বাণিজ্য পরিচালনার গতি যে হারে বৃদ্ধি পাবে তার মধ্য দিয়ে আগামীতে বিশাল সম্ভাবনাময় এক বাংলাদেশের চিত্র চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক