সোমবার, ১ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

মে দিবস ও আমাদের শ্রমিক

আফরোজা পারভীন

মে দিবস ও আমাদের শ্রমিক

মে দিবসের কথা মনে হলেই চোখে ভেসে ওঠে কতগুলো শ্রমজীবী মানুষের চেহারা। যাদের কপাল বেয়ে নামছে ঘাম, কারও কানে গোঁজা পেনসিল, কারও মাথায় ইটের বোঝা, কেউ ভাঙছে খোয়া, কারও হাতে শাবল বা হাতুড়ি। তারা কাজ করে চলেছে অবিরাম। কারখানায়, গার্মেন্টে, খেতে-খামারে, বাসা-বাড়িতে। দিন শেষে সামান্য যে টাকা পাবে, সেই টাকা দিয়ে চাল-ডাল কিনে বাড়ি যাবে। কোনো কোনো শ্রমিকের ভাগ্য ভালো, বাঁধা কাজ আছে। কারও কাজ আছে চুক্তিতে বা মাসকাবারি। অনেকেরই তা নেই। তারা দিনমজুর। দিনে কাজ দিনে মজুরি। যে দিন কাজ নেই, সে দিন উপোস, যেদিন অসুখ-বিসুখ সে দিন উপোস।

১৮৮৬ সালেু আমেরিকার শিকাগোর হে মার্কেটের শ্রমিকরা ৮ ঘণ্টা শ্রমের দাবিতে মালিকপক্ষের সামনে রুখে দাঁড়িয়েছিল। সে দিনের বাস্তবতায় তাদের কাজের কোনো বাঁধাধরা সময় ছিল না। ১০ ঘণ্টা, ১২ ঘণ্টা, ১৬ ঘণ্টা যে যেমন পারত খাটিয়ে নিত। মাত্র এক থেকে দেড় ডলারের জন্য যন্ত্রের মতো খাটত শ্রমিকরা। তাদের জীবনে ‘বিশ্রাম’ নামের শব্দটি ছিল অনুপস্থিত। মালিকের ভয়ে কথাও বলতে পারত না, যদি মালিক কাজ থেকে ছাঁটাই করে দেন। কিন্তু কোনো অন্যায়ই বেশি দিন টিকে থাকতে পারে না।

আস্তে আস্তে সংঘবদ্ধ হতে থাকে শ্রমিকরা। ৮ ঘণ্টা শ্রম, ৮ ঘণ্টা বিশ্রাম আর ৮ ঘণ্টা নিজের এই দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠে। সে দিন শ্রমঘণ্টা ছাড়াও দাবির মধ্যে ছিল ন্যূনতম মজুরি, নিয়োগপত্র দান। মালিকপক্ষ চালিয়েছিল দমন-পীড়ন। পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছিল পুলিশসহ ১০-১২ জন শ্রমিক। সে দিন এ দাবি পূরণ হয়নি। কিন্তু দাবিটি বেঁচে ছিল। জিইয়ে রেখেছিল শ্রমিকরা। তাই এক সময় মালিকপক্ষ মানতে বাধ্য হয়। সেই আন্দোলনের ফসল এই দিনটিকে শ্রমিকদের দাবি আদায়ের দিন হিসেবে মেনে নেয় বিশ্ব। তাই এ দিনটি ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস’ হিসেবেও পরিচিত। পৃথিবীর প্রায় ৮০টি দেশ দিবসটি পালন করে। শ্রমিকরা শোভাযাত্রা বের করে, আলোচনা সভা হয়। অনেক দেশে সরকারি ছুটিও ঘোষণা করা হয়েছে দিনটিতে। কিন্তু যে আমেরিকায় ঘটনাটি ঘটল সেই আমেরিকাই দিনটি শ্রমিক দিবস হিসেবে পালন করে না। তারা পালন করে সেপ্টেম্বর মাসের একটি দিন। তারা নাকি ভেবেছিল, এই দিনটি পালন করলে দাঙ্গা-হাঙ্গামা হতে পারে। কারণটা যুক্তিগ্রাহ্য মনে হয় না।

আমাদের জীবনে এখন দিবসের ছড়াছড়ি। অসংখ্য দিবসের ভিড়ে আমরা বেসামাল। কোনটা যে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কোনটা ততটা না, তা গুলিয়ে ফেলি। সামনে কোনো দিবস এলে আমরা বড়ই সম্পৃক্ত হয়ে পড়ি দিনটিকে নিয়ে। সে হোক না নারী দিবস, শ্রমিক দিবস, বাবা দিবস, মা দিবস কিংবা বিশ্ব হাত ধোয়া দিবস। তখন শুধু সামনের দিবসকে নিয়েই আমরা মেতে থাকি। সোশ্যাল মিডিয়ার বরাতে দেখানোর প্রবণতায় আমরা এখন বড়ই অভ্যস্ত। কাজেই সবাই সোচ্চার হয়ে উঠি দিনটিকে নিয়ে। দিনটি আসে, চলে যায় তারপর আলোচনায় ভাটা পড়ে। আবার পরের বছরের জন্য অপেক্ষা করি আমরা।

মে দিবসের ক্ষেত্রেও একই কথা। আমি ভেবে পাই না, এসব আলোচনা করে, সহমর্মিতা দেখিয়ে, ভালোবাসা জানিয়ে লাভ কী! আমরা বাস্তবিক এই খেটে খাওয়া শ্রমিকদের নিয়ে কতটা ভাবি? তাদের জীবনের সমস্যা আমাদের কতটা নাড়া দেয়? আমাদের বাড়িতে যখন তারা কাজ করে তখন কি আমরা তাদের নিংড়ে নিতে চাই না? আমরা কি চেষ্টা করি না, ওরা যাতে আরও বেশি সময় কাজ করে? চাই, এটাই বাস্তব কথা। আমাদের সারাক্ষণ মনে হয় ওরা কাজে ফাঁকি দিচ্ছে। ফাঁকি যাতে না দিতে পারে তাই আমরা রোজে না দিয়ে চুক্তিতে দিই। তারপরও আমাদের খুতখুতি যায় না।

আমার দৃষ্টিতে এই শ্রমিকরা প্রত্যেকেই এক একজন শিল্পী। যিনি আলমারি, চেয়ার-টেবিল বানান তিনি একজন জাতশিল্পী। কাঠের গায়ে তার হাতের নিখুঁত নকশা আমি অবাক হয়ে দেখি! যিনি দালান বানান তিনিও একজন বড় শিল্পী। এমনকি যারা মাটি কাটেন বা ইটের বোঝা বয়ে নিয়ে যান তাদের কোদালের কোপে আর ইট সাজানোতেও শিল্প থাকে। কিন্তু বেদনার কথা, পেটের ক্ষুধায় প্রতিদিন তাদের শিল্পীসত্তা বিক্রি হয়। তারা মনমতো কোনো ভালো কাজ করার সুযোগ পান না।

এখনকার শ্রমিকরা নিঃসঙ্গ, বিচ্ছিন্ন। যে গার্মেন্ট কর্মী গার্মেন্টে সেলাই করেন বা বোতাম লাগান তিনি যেমন একা, তেমনি যারা বাড়িতে শ্রম দেন তারাও একা। গার্মেন্ট মালিকদের দৌরাত্ম্যে শ্রমিকরা নিজেদের মধ্যে সম্প্রীতি-সৌহার্দ্য গড়ে তোলার সুযোগ পান না। সুপারভাইজাররা কঠোর দৃষ্টি রাখেন তাদের ওপর। বাড়িতে কাজে দৃষ্টি রাখেন গিন্নি। যেন মিস্ত্রি বা মজুর একটা লম্বা শ্বাস পর্যন্ত না নিতে পারে, পা ছড়িয়ে বসতে না পারে।

আগে কিন্তু এমন ছিল না। আমাদের বাড়িতে দুটো পুকুর। আমাদের বাড়ির বাঁধা মিস্ত্রি মনোরঞ্জনদা সারা বছর পুকুরের ঘাট বাঁধত। বর্ষা হলেই বাঁধা ঘাট ভেসে যেত। মনোরঞ্জনদা আবার বাঁধত। আব্বা কতদিন বলেছেন, ঘাট বাঁধিয়ে দেবেন। মা রাজি হননি।

আমাদের টিউবওয়েল একবার নষ্ট হলে বহুদিন মা সারাই করাতেন না। বাড়িতে কুয়ো ছিল। কুয়ো থেকেও পানি তোলাতেন না। দূরের টিউবওয়েল থেকে পানি আনাতেন। সর্দারপাড়ার বুনোদের কেউ কাজ দিত না। প্রেমো আর হারিদাসী পানি আনার কাজ করত। তখন বুঝিনি, এখন বুঝি মা ঘাট বাঁধাতেন না, টিউবওয়েল সারাতেন না ওদের কাজে রাখবেন বলে। স্থায়ী সমাধান হয়ে গেলে ওদের করার মতো কাজ থাকবে না। ওরা বেকার হয়ে যাবে তাই এ ব্যবস্থা। আমরা কিন্তু তাদের কখনো শ্রমিকের দৃষ্টিতে দেখিনি। তাদের কখনো নাম ধরে ডাকিনি। পরিবারের একজন ছিলেন তারা। দুপুরে মা কখনো তাদের অভুক্ত রাখতেন না। যা নিজে খেতেন তাই-ই খাওয়াতেন। বাড়িতে যে গোয়ালা দুধ দিত, যে সকালে ঘি-মাখন দিত, তারা সবাই ছিল নিজের লোক। তারা সহজেই শোবার ঘরে ঢুকে পড়তে পারত। তা নিয়ে কারও মাথায় কোনো প্রশ্ন ঘুরপাক খেত না। বাড়ির কাঠমিস্ত্রির কাছে আমি কাগজ কেটে উড়োজাহাজ বানাতে শিখেছি, গৃহকর্মীর কাছে রূপকথা শুনেছি। সে কালের গৃহকর্মীরা গৃহকর্ত্রীর কাছে টাকা জমা রেখে সোনার দুল গড়াতেন, নাকছাবি বানাতেন এটা আমার নিজের দেখা। কম পড়লে মা দিতেন, পরবর্তী জীবনে আমিও দিয়েছি। এ সংস্কৃতি তখন আমাদের বাড়িতে শুধু নয়, ঘরে ঘরে চালু ছিল। পালা-পার্বণে এই মজুর কামলারা দাওয়াত পেত। তাদের বাড়িতে সন্তান হলে মা নিমন্ত্রণ পেতেন। অন্য বাড়িতে যাওয়া হোক না হোক এসব বাড়িতে মা যেতেন মাটির বড় হাঁড়িতে মিষ্টি নিয়ে। তাদের প্রতি সমীহ ছিল, শ্রদ্ধা ছিল, গরিব বলে জাত গেল ভাবটা ছিল না।

এখন শ্রেণিবিভেদ এতটাই প্রকট যে, বাসার ঠিকা কাজের বুয়ার বাথরুম চাপলে বাথরুম করতে পারে না। গোসল করা তো দূর অস্ত। কোনো কোনো বাড়িতে নাকি দুই রকম চাল রান্না হয়। নিজেদের জন্য একরকম বাড়ির বুয়ার জন্য অন্যরকম। এতে কয় টাকা বাঁচে কে জানে! সেই টাকা বাঁচিয়ে তারা কোন স্বর্গে যাবেন, তাও জানি না।

একটা দেশে নানান রকম মানুষ থাকে। তাদের লেখাপড়া যোগ্যতা ভিন্ন হবে-এটাই স্বাভাবিক। কেউ বিজ্ঞানী হবে, কেউ হবে কৃষক। কিন্তু কাজ যাই করুক, সম্মান তো থাকবে। বিদেশে কোনো কাজই ছোট নয়। সেখানে একজন গার্ডেনার আর একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক একই। সবাই খেটে খায়। আমরাই ভিআইপি, ভিভিআইপি এসব শব্দ সৃষ্টি করেছি আর তার নার্সিংও করছি।

আমরা মে দিবস নিয়ে উচ্ছ্বসিত ঠিক আছে। হে মার্কেটের শ্রমিকদের লড়াই, আত্মত্যাগকে আমরা সাধুবাদ জানাই। কিন্তু শ্রমঘণ্টা, মজুরিবৈষম্য এখনো বিরাজমান। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে মজুরি ঠিকমতো পরিশোধ করা হয় না বলে মাঝে মাঝেই অভিযোগ শুনি। আইএলও নির্ধারিত শ্রমঘণ্টা মানা হয় না। নারী শ্রমিকদের মজুরি/বেতন এখনো অনেক জায়গায় পুরুষের চেয়ে কম। এখনো দেশে দুই রকম শ্রমবিভাজন রয়েছে। সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য একরকম, বেসরকারিদের জন্য অন্যরকম। সরকারি চাকরির কর্মসময় কম, সপ্তাহে দুই দিন ছুটি, সরকারি সব ছুটিই তারা পান। কিন্তু বেসরকারি ক্ষেত্রে ছুটি এক দিন, সরকারি সব ছুটি তারা পান না, ছুটি পান প্রতিষ্ঠানের মর্জিমাফিক। অফিস টাইম একটা ঠিক থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা মানা হয় না। ইচ্ছামতো খাটিয়ে নেওয়া হয়। সাপ্তাহিক ছুটির দিনও কোনো না কোনো অফিশিয়াল প্রোগ্রাম জুড়ে দেওয়া হয়। খাটতে খাটতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নাভিশ্বাস ওঠে। তাদের ব্যক্তিজীবন বলতে কিছুই থাকে না।

এদের শ্রমের বিনিময়ে মালিকরা মুনাফা বানায়। ব্যাংকসহ অনেক অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠানে টার্গেট বেঁধে দেওয়া হয়। টার্গেট পূরণ করতে পারবে কি না এই আশঙ্কায় থাকে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তটস্থ থাকে চাকরি চলে যাওয়ার ভয়ে। অনেক জায়গায় নিয়ম পারফরম্যান্স দেখে পদোন্নতি দেওয়ার। সেই পারফরম্যান্স করতে গিয়ে গলদঘর্ম হয় কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। বাড়ে হতাশা, ডিপ্রেশন। ভিন্ন চিত্রও আছে। কোথাও কোথাও নামমাত্র কাজ করে মোটা বেতন পাওয়ার, নিজের প্রতিষ্ঠান ছাড়াও বাইরে ক্লাস নেওয়া, কনসালটেন্সি, চেম্বার করার সুযোগ আছে।

নেই কর্মোপযোগী পরিবেশ। শ্রমিকের স্বাস্থ্যের কথা কেউ ভাবে না। অনেক শিল্প-কারখানায় শ্রমিকের জীবন ঝুঁকিপূর্ণ। অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা, আলো-বাতাস চলাচল, জরুরি নির্গমন ব্যবস্থা কিছুই নেই। হালের রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি তার জ¦লন্ত প্রমাণ। অথচ অনেক সরকারি অফিস আছে যেখানের ফ্যান, এসি, বাতি কখনোই বন্ধ হয় না। লাক্সারি বসার ব্যবস্থা তাদের।

একই দেশ কিন্তু কী ভীষণ বৈপরীত্য! তাই বৈশি^ক প্রেক্ষাপটে না গিয়ে নিজের দেশ দেখেই বলতে পারি, শ্রমিকদের জীবনে আসেনি তেমন কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন। আসেনি স্থিতি। মেলেনি সমতা। ওরা এখনো নীচুতলার, নিগৃহীত, বঞ্চিত!

 

লেখক : কথাশিল্পী, গবেষক, সাবেক যুগ্ম সচিব

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর