সোমবার, ১ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

ঋণখেলাপিদের ধরুন

মাজহারুল ইসলাম

ঋণখেলাপিদের ধরুন

ইউটিউবে ‘পথে হল দেরি’ নামের পুরনো দিনের বাংলা সিনেমা দেখলাম। উত্তম-সুচিত্রা অভিনীত সিনেমাটিতে ধনী-গরিবের বৈষম্যের ব্যবধান এবং প্রেম-ভালোবাসার এক নিখুঁত চিত্র চিত্রায়িত হয়েছে। সিনেমাটিতে একটি চমৎকার ডায়ালগ আছে- ‘ভালোবাসা দিয়ে অনেক কিছু জয় করা যায়; কিন্তু বৈষম্য জয় করা যায় না’। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ৫২ বছর। একটি সুখী সমৃদ্ধশালী বৈষম্যহীন জাতি গঠনই ছিল স্বাধীনতার মূলমন্ত্র। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ট্র্যাজেডির পর সে লক্ষ্যে জাতির পথ চলা মন্থর হয়ে পড়ে। ১৯৯০ সালে সামরিক তন্ত্রের পতন ঘটলেও ষড়যন্ত্র বন্ধ হয়নি। বিশেষ করে ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোটের উত্থান, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, বাংলা ভাই তথা জঙ্গিবাদের উত্থান, ১০ ট্রাক অস্ত্র আটক, হাওয়া ভবন দ্বারা দ্বৈত শাসনব্যবস্থা চালু হওয়ার ঘটনা দেশকে সেই পাকিস্তান আমলে ফিরিয়ে নেয়। বর্তমান সরকারের ১৪ বছরে দেশ অগ্রগতির পথে হাঁটলেও দেশের অর্থনীতি জিম্মি হয়ে পড়েছে ঋণখেলাপিদের কাছে। দেশে ঋণখেলাপির সংখ্যা ৭ লাখ ৮৬ হাজার ৬৫ জন। এ বছরের জানুয়ারিতে জাতীয় সংসদে এ তথ্য প্রকাশ করে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, এর মধ্যে ২০ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ঋণের পরিমাণ ১৯ হাজার ২৮৩ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। যার মধ্যে খেলাপি ঋণ ১৬ হাজার ৫৮৭ কোটি ৯২ লাখ টাকা। সংসদে দেওয়া মন্ত্রীর তথ্য অনুযায়ী শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপির শীর্ষে রয়েছে সিএলসি পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড। তাদের খেলাপি ঋণ ১ হাজার ৬৪০ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড ১ হাজার ৫২৯ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। রিমেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের খেলাপি ঋণ ১ হাজার ৭৭ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। রাইজিং স্টিল কোম্পানি ৯৯০ কোটি ২৮ লাখ টাকা। মোহাম্মদ ইলিয়াস ব্রাদার্স ৯৬৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা। রূপালী কম্পোজিট লেদার ৮৭৩ কোটি ২৯ লাখ টাকা। ক্রিসেন্ট লেদার্স ৮৫৫ কোটি ২২ লাখ টাকা। কোয়ান্টাম পাওয়ার সিস্টেমস ৮১১ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। সাদ মুসা ফেব্রিকস ৭৭৬ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। বিআর স্পিনিং মিলস ৭২১ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। এসএ অয়েল রিফাইনারির খেলাপি ঋণ ৭০৩ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। মাইশা প্রপার্টি ডেভেলপমেন্ট ৬৬৩ কোটি ১৮ লাখ টাকা। রেডিয়াম কম্পোজিট টেক্সটাইলের ৬৬০ কোটি ৪২ লাখ টাকা। সামান্নাজ সুপার অয়েলের ৬৫১ কোটি ৭ লাখ টাকা। মানহা প্রিকাস্ট টেকনোলজি লিমিটেডের খেলাপি ঋণ ৬৪৭ কোটি ১৬ লাখ টাকা। আশিয়ান এডুকেশন লিমিটেডের ৬৩৫ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। এসএম স্টিল রি-রোলিং মিলসের ৬৩০ কোটি ২৬ লাখ টাকা। অ্যাপোলো ইস্পাতের ৬২৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। এহসান স্টিল রি-রোলিংয়ের ৫৯০ কোটি ২৩ লাখ টাকা এবং সিদ্দিকী ট্রেডার্সের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫৪১ কোটি ২০ লাখ টাকা। বাংলাদেশে ঋণখেলাপির যে অপসংস্কৃতি গড়ে উঠেছে এর সঙ্গে ব্যাংক পরিচালক ও কর্মকর্তাদের যোগসাজশ ওপেন সিক্রেট। ব্যাংক থেকে ঋণ হিসেবে নেওয়া অর্থের এক বড় অংশ বিদেশে পাচারের অভিযোগও রয়েছে। যা নিয়ে তদন্ত হওয়া দরকার। বাংলাদেশে ১০ কিংবা ২০ হাজার টাকা ব্যাংক ঋণ নিতে গিয়ে কৃষকের পায়ের স্যান্ডেল ছিঁড়ে যায়। প্রাপ্ত ঋণের একটা অংশ যে ব্যাংক কর্মকর্তাদের উৎকোচ হিসেবে দিতে হয়, এটি একটি ওপেন সিক্রেট। বন্যা, টর্নেডো, খরার কারণে ফসলহানি হলে কৃষক ঋণ শোধ করতে না পারলে তাদের কোমরে দড়ি বেঁধে জেলহাজতে ভরা হয়। কিন্তু যারা শত শত কোটি টাকা লোপাট করে বিদেশে পাচার করছে, তাদের কোমরে দড়ি বেঁধে গ্রেফতারের একটাও নজির নেই।

বছরখানেক ধরে সারা দুনিয়ার মতো বাংলাদেশেও অনুভূত হচ্ছে অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব। কভিডের কারণে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিশ্বের সব দেশের উৎপাদন ব্যবস্থা। বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে প্রতিটি দেশের অর্থনীতি। ভয়াবহ ওই মহামারি মোকাবিলায় বাংলাদেশের সাফল্য ছিল ঈর্ষণীয়। ঘনবসতির এই দেশে লাখ লাখ মানুষ আক্রান্ত হলেও মৃত্যুর হার ছিল তুলনামূলক বিচারে কম। কভিডের মধ্যেও মোটামুটি সচল ছিল অর্থনীতি। বিস্ময়কর হলেও সত্যি, পাঁচ দশকের মধ্যে কভিডের সময় বাংলাদেশের মুদ্রা টাকার দাম প্রথমবারের মতো ডলারের বিপরীতে বেড়েছে। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতিতে যে মহামন্দার আঘাত হেনেছে তা বাংলাদেশের জন্যও অশনিসংকেত বলে বিবেচিত হচ্ছে। ডলার সংকটে ভুগছে দেশ। বিশ্ববাজারে চাল, গম, ভোজ্য তেল, চিনির দাম বেড়েছে অবিশ্বাস্যভাবে। গ্যাস ও জ্বালানি তেলের দামও আকাশছোঁয়া। ফলে রপ্তানির তুলনায় আমদানিতে অর্থব্যয় বেড়েছে ব্যাপকভাবে। গাড়ি, মোটরসাইকেল, মোটর পার্টস, ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী, বিভিন্ন ফলসহ বিলাসী পণ্য আমদানির নামে হুন্ডিতে টাকা পাঠানোর কারণে অর্থনীতির সর্বনাশ হচ্ছে। অল্প টাকার এলসি খুলে হুন্ডিতে বাকি টাকা পাঠানোর কারণে শিল্প-কারখানার এলসিতে জটিলতা তৈরি হচ্ছে। ফল আমদানিতে অর্থ পাচার হচ্ছে ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, ফল আমদানিতে প্রকৃত মূল্যের ২০ থেকে ২০০ ভাগ পর্যন্ত অতিরিক্ত দেখিয়ে এলসি করা হচ্ছে।

যা বিদেশে অর্থ পাচার নিশ্চিত করছে। দেশে ধনী-গরিবের ব্যবধানও বাড়ছে বিদেশে অর্থ পাচারের ঘটনায়। যা রোধ করা সরকারের দায়িত্ব বলে বিবেচিত হওয়া উচিত।

                লেখক : প্রাবন্ধিক

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর