বৃহস্পতিবার, ৪ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

দাতা ও আত্মবিজ্ঞাপনদাতা

হানিফ সংকেত

দাতা ও আত্মবিজ্ঞাপনদাতা

আমরা জানি যিনি দান করেন তিনি দাতা আর যিনি লোক দেখিয়ে দান করেন, তিনি আত্মবিজ্ঞাপনদাতা। এই বিজ্ঞাপন পণ্যের নয়, অন্যেরও নয়-সুকৌশলে নিজের বিজ্ঞাপন নিজেই প্রদান করেন, আর এই আত্মবিজ্ঞাপনে আত্মতুষ্টি লাভ করেন। কথায় বলে, ‘ধনে নয়-মানে নয়, কর্মের মাধ্যমেই পাই মানুষের সত্য পরিচয়’। তারপরও কিছু মানুষ নিজেকে প্রচার পণ্য বানিয়ে ফেলেন। অনেককেই দেখা যায় নিজের প্রচার-প্রসারের জন্য লোক দেখানো দান করেন। এ যেন অন্যকে সহায়তা করে নিজের মর্যাদাকে জাগিয়ে তোলার প্রচেষ্টা। দান-প্রতিদান-অনুদান এর অবদানের কথা নিয়ে লেখালেখি আর ছবি তুলে দেখাদেখি হরহামেশাই দেখা যায়। যদিও আমরা জানি ‘ডান হাত যা দান করবে বাম হাতও তা যেন জানতে না পারে’, কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে তা উল্টো। দান করে তা না জানানো পর্যন্ত চিত্তে শান্তি নেই। এই দানক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত ক্যামেরাও বন্ধ নেই। ফলে বেচারা দানগ্রহীতার দুর্ভোগেরও শেষ নেই। ছবি না তোলা পর্যন্ত গলা পানিতে দাঁড়িয়ে ত্রাণ নিতে গিয়ে কারও প্রাণ যায় যায় অবস্থা। ঝড়ে বিধ্বস্ত ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে করতে সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়। কখনো বা প্রখর রৌদ্রে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিতে হয়, কিছু দান লাভের আশায়। এসব দুর্গত মানুষ দান নিয়ে বাড়িতে যাওয়ার আগেই অনলাইনে সচিত্র সংবাদ প্রকাশিত হয়- ‘বন্যার্তদের সাহায্যে অমুক ভাইয়ের অবদান’, ‘ঘূর্ণিঝড় বিধ্বস্ত অমুক ভাইকে অমুক ভাইয়ের প্রাণভরা দান’, ‘দুর্গতদের সহায়তায় ট্রাকভর্তি ত্রাণ’। করোনা এবং বন্যার সময় এ ধরনের অনেক সংবাদ দেখা গেছে। চাল-তেল-নুন-পিঁয়াজ-রসুনের বস্তা মাথায় নিয়ে চলছেন দরিদ্র মানুষ। টিভিতে, পত্রিকায় নিজের ছবি দেখে বস্তাদাতা পুলকিত হলেও বস্তা মাথায় নিয়ে হেঁটে যাওয়া ওইসব অসহায় মানুষের মুখে হাসি নেই। এটুকু দান পাওয়ার জন্য কত না কষ্ট করতে হয়েছে, হাঁটতে হয়েছে কত পথ। এখন রোদে পুড়ে নইলে বৃষ্টিতে ভিজে যেতেও হবে তত পথ। আর যিনি দিলেন ক্যামেরায় ছবি তোলা শেষ হতেই তিনি এক গাল হেসে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়িতে উঠে মোবাইলে দান নিয়ে আলাপে মশগুল। অনলাইনে নিজের সংবাদ পড়ে খুশিতে বাকবাকুম। এই মশগুল কতটা গুল আর কতটা ভুল তা বোঝা সহজ। আবার কিছু মানুষ আছেন যারা স্বার্থ নয়-ক্ষমতা নয়-প্রচার কাঙাল হয়ে টিভি প্রদর্শনীতেও নয়, লোক দেখানো প্রচারণার জন্য নয়-এমনকি ভোটপ্রত্যাশী সাময়িক দরদি হয়েও নয়-দান করেন নীরবে নিভৃতে, তারাই সত্যিকারের মানুষ, দরদি মানুষ।

দান শব্দটির অর্থ হচ্ছে অর্পণ বা অনুদান। আমি দান নিয়ে জ্ঞান দান করছি না। এই দান-প্রদান ব্যক্তির ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে। তিনি দিতেও পারেন, নাও দিতে পারেন। দিলে দানগ্রহীতা খুশি হন। অন্যকে খুশি করার জন্য নিজে খুশি হয়ে অর্থ বা অন্য কিছু প্রদান করাকে দান বলা হয়। আবার অনেকের কাছে দান একটি মহৎ ইবাদত। কিন্তু দান করতে গিয়ে দাতা সেজে কেউ যদি প্রচার মত্ততায় মেতে ওঠেন তবে সেটা আর দান থাকে না। তিনিও দাতা থাকেন না, হয়ে যান বিজ্ঞাপনদাতা। প্রচারণাই যার মূল লক্ষ্য। কারণ দান সব সময় গোপনে করাই উত্তম। ক্ষেত্রবিশেষে অন্যকে উৎসাহ বা উদ্বুদ্ধ করার জন্য প্রকাশ্যেও দান করা যায়। তবে তা বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে আত্মপ্রচার করার জন্য নয়। যেমন আমাদের দেশে দানটা এখন মৌসুমি বা সিজনাল হয়ে গেছে। কোনটা দান কোনটা ঘুষ বোঝা যায় না। যেমন ইলিশের মৌসুমে অনেকে অনেক স্থানে ইলিশ দান করেন। আমের মৌসুমে ঝাঁকাভর্তি পাকা আম, কোরবানির সময় লাল গরু ইত্যাদিও থাকে দানের তালিকায়। এ সময় শহর-নগর-বন্দরে গরু যে কত গুরুত্বপূর্ণ, কত গরিয়ান, কত গর্বের একটি প্রাণী তা বোঝা যায়। আর গরু চতুষ্পদ বলে বিপদ কম, তবে দ্বিপদ মানুষের বিপদ পদে পদে। কোরবানি মানে উৎসর্গ করতে পারার খুশি। তবে কোনোক্রমেই কাউকে ঘুষ দিয়ে উৎসর্গ করে নয়। কথায় আছে, ‘প্রচারেই প্রসার’। সেই প্রচার যত অসারই হোক না কেন মানুষকে প্রেশার দিয়ে হলেও সেটাকে সার করার চেষ্টা ঠিক নয়। মনে রাখতে হবে দাতা এবং বিজ্ঞাপনদাতা যেমন এক নয়, সে রকম অতি আত্মপ্রচারও সুলক্ষণ নয়। এই প্রচারের জন্য অনেকে আবার স্বনামে বিজ্ঞাপনও দেন।

আসলে নিজের জন্য ব্যাকুল নয়, অন্যের জীবন বাঁচাতে প্রাণপণ করা মানুষের বড়ই অভাব এখন। তবে আমরা ইত্যাদিতে এই তিন যুগে এমন অনেক মানুষকেই পেয়েছি যারা নিভৃতে দান করেন, যেমন দানবীর কুতুবউদ্দিন আহমেদ। বিত্তবান হলেও যিনি চিত্তবান। যিনি নিজের এলাকাসহ দেশের অর্ধশতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে বহুমুখী উন্নয়নে আলোকিত করেছেন। অসংখ্য দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থী তার মাধ্যমে পেয়েছেন শিক্ষার আলো, পেয়েছেন থাকার ঘর। অন্যের জীবন বাঁচাতে নিজের জীবন বাজি রেখেছিলেন বরগুনার জয়দেব দত্ত, যিনি উপকূলের নেভিগেশন লাইট হিসেবে খ্যাত ছিলেন। তিনি তার মূল্যায়ন সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, সাগরের তীরে তীব্র ঝড়ে যখন নিজের জীবন বাজি রেখে মানুষকে বাঁচাতে যাই, তখন মূল্যায়নের চিন্তা বা প্রচার চিন্তা করি না। যারা করে তারা ভ-, তারা পশু। গহের আলী-অন্যকে ছায়া দেওয়ার জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভিক্ষা করে তালের আঁটি সংগ্রহ করে নওগাঁর ভীমরুল গ্রামের সরকারি রাস্তার দুই পাশে ১৮ হাজারেরও বেশি তালগাছ লাগিয়েছেন। পলান সরকার-যিনি শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে হেঁটে হেঁটে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বই দান করেছেন। কিংবা অতি সম্প্রতি ইত্যাদিতে দেখানো ফেনীর মঞ্জিলা আক্তার মিমি, যিনি রাস্তা থেকে অসুস্থ-অসহায় এবং সদ্য প্রসূত শিশুদের নিয়ে এসে হাসপাতালে ভর্তি করে তার চিকিৎসা ও ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নেন। শুধু তাই নয়, রাস্তায় প্রসব করা মানসিক প্রতিবন্ধীদের সন্তানদের তিনি নিজ গৃহে পারিবারিক পরিবেশে নিজের সন্তানের মতো লালন-পালন করছেন। অথচ এরা কেউই মূল্যায়ন, স্বীকৃতি বা আত্মপ্রচারের জন্য কাজ করেননি। অথচ সমাজে যারা প্রতিষ্ঠিত বিত্তবান রয়েছেন, তারা দান করার আগেই ‘তিনি দান করবেন’ বলে পত্রিকায় আর চ্যানেলে সংবাদ প্রকাশিত হয়। টিভি ক্যামেরাগুলোও ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের দানের খবর প্রদানের জন্য। কী এক অদ্ভুত ‘দান তামাশা’। সম্প্রতি বঙ্গবাজারে দেওয়া কিছু কিছু মানুষের দান নিয়েও বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে। কেউ পোড়া কাপড় কিনছেন, কেউ লাইভে গিয়ে হাত বোঝাই করে বান্ডিল বান্ডিল টাকা দিচ্ছেন, কিন্তু এত বিপদেও ভুলছে না একখানা সেলফি তুলে সেই পোড়া কাপড় কেনার ছবিটি ফেসবুকে পোস্ট করতে কিংবা পত্রিকায় সংবাদ পাঠাতে। যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের অনেকেই সবাইকে জানিয়ে এভাবে অর্থ সাহায্য নিতে বিব্রতবোধ করাও অস্বাভাবিক নয়।

রমজান এলেই শুরু হয় ইফতার প্রচারণা, এবারও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। চ্যানেলে চ্যানেলে ইফতার প্রচারণা। কেউ এতিমদের সঙ্গে ইফতার করছে, কেউ ইফতারের প্যাকেট দিচ্ছে, কেউ লাইভে নিজে এসেই বলছে কোথায় কত টাকা দিয়েছে। আজকাল দলবেঁধে মধ্যরাতে পুরান ঢাকার বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে গিয়ে ‘সাহরি কালচার’ গড়ে উঠেছে। কিন্তু এদের মধ্যে অনেকেই রোজা রাখেন না। এরপর আছে পলিটিক্যাল ইফতার। এক এক দল ইফতার পার্টির আয়োজন করছে, নেতারা টুপি মাথায় দিয়ে বসে আছেন, কেউ বক্তব্য দিচ্ছেন, বিভিন্ন দলের লোকদের আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এসব পলিটিক্যাল ইফতার পার্টিতে বিদেশি কূটনীতিকদেরও দেখা যায়। যদিও বিদেশিরা রোজা রাখেন না, কারণ তাদের দেশ এবং ধর্ম দুটোই আলাদা। শুধু ইফতারই বা বলছি কেন, ইদানীং জাকাতও পলিটিক্যাল হয়ে গেছে। পার্টির লোক দেখে দেখে, ভোটার দেখে দেখে জাকাত দেওয়া হয়। আছে পলিটিক্যাল সেলামি। সেমাইতেও পলিটিক্স ঢুকে গেছে। কারণ পলিটিক্যাল বাড়ির দাওয়াত এবং সেমাই সবার ভাগ্যে জোটে না। নিজ দলের মানুষ ছাড়া অন্যরা দাওয়াত পায় না। ভেদাভেদ ভুলে প্রাণে প্রাণে মিলনের নাম ঈদ হলেও সমতার ভিত্তিতে মমতা নিয়ে হিংসা বিভেদ দলাদলি ভুলে কেউ কারও সঙ্গে কোলাকুলি করতে দেখা যায় না। কারণ কোলাকুলিও এখন পলিটিক্যাল। পলিটিক্সে সবাই যেন সবার শত্রু। মাঝে মাঝে মাঝরাতে টকশোগুলোতে কিছু চিহ্নিত ব্যক্তির শোরগোল শুনলে আর হাতের তেড়ে আসা কারুকাজ দেখলে মনে হয় এই বুঝি লাগল। কিছু কিছু টকশো দেখলে মনে হয়, এ যেন দর্শকদের জন্য আকর্ষণীয় বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান। উপস্থাপককে তড়িঘড়ি করে ওই চিৎকার-চেঁচামেচির মধ্যেই বলতে শোনা যায়, ‘আমাদের এই মহান টকশোতে অংশ নেওয়ার জন্য আপনাদের অসংখ্য ধন্যবাদ।’ সঙ্গে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হিসেবে চেঁচামেচি চলতেই থাকে। এসব টকশো দেখলেই ‘ভাঙা রেকর্ড’ নামক প্রচলিত উপমার সঠিক সংজ্ঞা পাওয়া যায়। যাকগে আমি রাজনৈতিক বিশ্লেষক নই। ওইসব ক্ষেত্রে আমার জ্ঞান খুবই সীমিত। আমার লেখার বিষয় মূলত দান, দাতা ও বিজ্ঞাপনদাতা নিয়ে। মানুষের বিপদে কিংবা দুঃসময়ে আমরাও আমাদের সাধ্য অনুযায়ী তাদের পাশে দাঁড়াতে চেষ্টা করি। তবে তা সব সময়ই থাকে প্রচারবহির্ভূত। আসলে মানুষ কী চান, কী চান না-তা তোয়াক্কা না করে কিছু কিছু মানুষ আপন গন্ডিতে গোল হয়ে নিজের ঢোল বাজাতে ব্যস্ত। আত্মপ্রদর্শন, আত্মপ্রচার বা আত্মপ্রশংসায় পঞ্চমুখ আত্মবিজ্ঞাপনদাতা।

অন্যের খবর প্রচার করার জন্য লাইসেন্সপ্রাপ্ত টিভি চ্যানেলগুলোও এখন নিজের খবর প্রচার এবং অনুষ্ঠানের নামে দেশ-বিদেশের নানান স্থান ভ্রমণ করতে গিয়ে ভ্রমণ অনুষ্ঠান বানিয়ে প্রোমোর পর প্রোমো চালিয়ে প্রচার করে থাকেন আপন আপন চ্যানেলে। কেউ কেউ আবার টকশোতেও নেমে পড়েছেন। তবে বক্তা নয়-উপস্থাপক হিসেবে। দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা লাইন ধরে ওখানে একটু কথা বলে ধন্য হতে আসেন। মালিক পক্ষের এসব অনুষ্ঠানের কোয়ালিটি নির্ধারণ করবে কে? কার সেই সাহস আছে? এর মধ্যে অনেকেই আবার চ্যানেলটিকে চাটুকারির কারখানা বানিয়েছে। এদের রাজনৈতিক চরিত্র বড় বিচিত্র। যখন যার তখন তার। মিডিয়ার ৪০ বছরের বিচরণে এদের নানারূপ স্বচক্ষে দেখা, এখনো দেখছি। তবে তখন এত চ্যানেল ছিল না। একটি মাত্র চ্যানেল ছিল, সুতরাং ইচ্ছা থাকলেও উপায় ছিল না। এখন তো এদের অনেকেরই চ্যানেল নামক চাটুকারির কারখানা আছে। পিক আওয়ারে নেমে পড়ে চাটুকারিতায়। তবে মাঝে মাঝে চাটুকারি করতে গিয়ে ন্যায়নীতি বিসর্জন দিয়ে এমন সব কর্মকান্ড করতে দেখা যায়, যা দেখে দর্শকও লজ্জা পায়। আর যাদের চাটুকারি করে এদের কারণে তাদেরও ভাবমূর্তি সংকটে পড়ে। আবার বিশেষ কোনো রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান হলে সেখানে রিপোর্টাররা খবর সংগ্রহের চেয়ে যার যার চ্যানেলের মালিক বা ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তির ছবি প্রচারে ব্যস্ত থাকেন বেশি। ফলে পর্দায় ঘন ঘন ভেসে উঠে তাদের চিত্র। ওনারা হাঁটছেন, খাচ্ছেন, বলছেন।

ছোট একটি দানের ঘটনা দিয়ে এই লেখা শেষ করব। ২০২২-এর ৩০ সেপ্টেম্বর প্রচারিত ইত্যাদিতে আমরা একজন ভ্যানচালককে দেখিয়েছিলাম, যিনি মাঝে মাঝে রিকশাও চালাতেন। নাম সৈয়দ আহমেদ। বাড়ি নোয়াখালী জেলার সুবর্ণচর গ্রামে। বর্তমানে কৃষিকাজ করেন। রিকশাচালক হয়েও তিনি এলাকার একটি কলেজের জন্য দান করেছেন নিজের ১০০ শতাংশ জমি। যা সবাইকে বিস্মিত করেছে। ১৯৯২ সালের দিকে ভ্যান চালানো শুরু করেন সৈয়দ আহমেদ। ভ্যান ছেড়ে পরে রিকশা ধরেন, যা পেতেন তাই দিয়ে কোনোমতে সংসার চালাতেন। সৈয়দ আহমেদের বয়স এখন ৬৬ বছর। শরীরে কুলোয় না বলে রিকশা চালনা ছেড়ে দিয়েছেন। এখন কৃষিকাজ করেন। তিন ছেলে ও চার মেয়ের জনক তিনি। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। ছেলেরা এখন পরিবারে কিছু সাহায্য করেন।

অনেক বিত্তশালী মানুষ রয়েছেন যাদের এই চরে শত শত বিঘা জমি রয়েছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় থাকলেও এই এলাকার ১০ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো কলেজ নেই। এ নিয়ে স্থানীয়রা বেশ উদ্বিগ্ন। ছেলেমেয়েরা ১০ কিলোমিটার দূরে গিয়ে কীভাবে কলেজ করবে? কলেজ না থাকায় বেশির ভাগ ছাত্রীকেই মাধ্যমিকের পর পড়াশোনার ইতি টানতে হয়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাধ্য হয়ে বসতে হয় বিয়ের পিঁড়িতে।

এই পরিস্থিতিতে একটি কলেজ স্থাপনের লক্ষ্যে জমি ও অর্থ সংগ্রহের জন্য ২৯ জুলাই ২০২২ সুবর্ণচরের থানারহাট বাজারে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানসহ এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি মিলে একটি সভার আয়োজন করেন। কলেজের জন্য কে দেবেন জমি-এই প্রশ্ন নিয়ে চলে আলোচনা। খবর পেয়ে রিকশাচালক সৈয়দ আহমেদ ছুটে আসেন। নিঃশব্দে একটি স্থানে দাঁড়িয়ে সবার কথা শুনছিলেন। জমিদাতা খুঁজতে খুঁজতে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হলো। সাড়ে ৪ ঘণ্টা আলোচনা করার পরও যখন কেউ এগিয়ে এলো না তখন ভিড়ের মধ্য থেকে সৈয়দ আহমেদ হাত উঁচু করে চিৎকার করে বলেন, কলেজের জন্য জায়গা তিনিই দেবেন। সৈয়দ আহমেদের কথা শুনে সভাস্থলে পিনপতন নিস্তব্ধতা নেমে আসে। কারণ জমিটির বর্তমান বাজারমূল্য ৫০ লাখ টাকা। একটু পরেই আবার মুহুর্মুহু করতালি দিয়ে জড়িয়ে ধরেন সৈয়দ আহমেদকে। এক সময় সৈয়দ আহমেদের জমিতে সাইনবোর্ড লাগানো হয়, ‘থানারহাট কলেজের জন্য নির্ধারিত স্থান। দাতা-সৈয়দ আহমেদ’। জিজ্ঞেস করেছিলাম সৈয়দ আহমেদকে, ‘এত কষ্ট করে কেনা জমি দিয়ে দিলেন কী চিন্তা করে?’

উত্তরে নিম্নস্বরে বললেন, ‘কোনো দিন স্কুলে যাইতাম পারি নাই। কলেজ হইলে সবার লাভ। এলাকার ছেলেমেয়ে শিক্ষিত হবে। হেইডাই তো বড় সম্পত্তি।’

জানতে চেয়েছিলাম, ‘বিনে পয়সায় জমি দান করায় আপনার স্ত্রী-সন্তানরা কেউ কিছু বলেনি?’

বললেন, ‘তাগো বুঝাইছি টিয়া-পয়সা দিয়া কী অইবো? আমার বাড়ির সামনে আমার জমিতে বিল্ডিং অইবো, পোলাপাইনে লেখাপড়া কইরবো, খেলাধুলা কইরবো, আমি চাই চাই দেখুম এর চাইতে আনন্দের আর কী আছে?’

লেখাপড়া না জানা বিত্তবান না হয়েও এই চিত্তবান মানুষটি প্রমাণ করে দিলেন ‘দান হয় মনে ধনে নয়’।

‘আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে, আসে নাই কেহ অবনী পরে/সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।’ এই কবিতাটি আমরা বাল্যকালে বহুবার পড়েছি, শুনেছি, ইত্যাদিতেও বলেছি কিন্তু প্রকৃতপক্ষে পরের তরে কাজ করার লোক ঘরে ঘরে পাওয়া যায় না। নিঃস্বার্থ, নির্লোভ, নিরহংকার, নির্ভেজাল মানুষ পাওয়া কঠিন। সৈয়দ আহমেদ এমনই একজন ব্যক্তি। যিনি নিজের সম্পদ নিজে ভোগ না করে নিঃস্বার্থভাবে অন্যের জন্য বিলিয়ে দিয়েছেন পরমানন্দে। যিনি তার এই দানের মাধ্যমে বলে গেলেন। নিজেকে প্রচার পণ্য না বানিয়ে, আসুন আমরা একে অন্যের জন্য ভেবে জীবন ধন্য করি। তার এই ত্যাগ ও নির্মোহ জীবনের আদর্শ যত বেশি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করবে, ততই আমরা এগিয়ে যাব আলোর পথে।

         লেখক : গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব পরিবেশ ও সমাজ উন্নয়নকর্মী

সর্বশেষ খবর