শিরোনাম
শনিবার, ৬ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

সারের মতো প্রাণিখাদ্যেও ভর্তুকির দাবি খামারিদের

শাইখ সিরাজ

সারের মতো প্রাণিখাদ্যেও ভর্তুকির দাবি খামারিদের

প্রাণিখাদ্যের দাম অনিয়ন্ত্রিতভাবে বৃদ্ধি নিয়ে খামারিদের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এবার কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেটের দ্বিতীয় আয়োজনে খামারিরা দাবি তুলেছেন প্রাণিখাদ্যে সরকারি ভর্তুকির। আর এ দাবিকে সমর্থন জানিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আবদুর রাজ্জাক।

২০২৩-২৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট সামনে রেখে কৃষি খাতে কৃষকের দাবি ও চাহিদা নিরূপণে এবারের দ্বিতীয় আয়োজন টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার গারোবাজার এলাকায়। স্থানীয় মহিষমারা কলেজ চত্বরে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কৃষকের উপস্থিতি ছিল। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আবদুর রাজ্জাক। এ ছাড়া সরকারের বিভিন্ন দফতরের কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন। সবার সামনে প্রান্তিক কৃষক গলা ছেড়ে নিজেদের দাবি-দাওয়া তুলে ধরেছেন।

ভূমিরূপ বিচারে এ অঞ্চল বৈচিত্র্যপূর্ণ। আছে পাহাড়ি লাল মাটি, আছে দীর্ঘ উর্বর সমতল। যমুনা নদীর এপারের সমতল ভূমি উর্বর। যুগ যুগ ধরে ধান ও পাট চাষে সমৃদ্ধ। আবার উঁচু জমিতে ফলের চাষ হচ্ছে। সেচ সমস্যার কারণে আগে উঁচু সমতল অঞ্চলগুলোতে এক ফসল হতো। এখন সেচ সুবিধা বেড়েছে। বেড়েছে ফসল বৈচিত্র্য। সেচের মাধ্যমে পাহাড়ি ভূমিতেও হচ্ছে ফল-ফসল ও সবজির চাষ। কৃষিতে অনেক দূর এগিয়ে গেছে এ অঞ্চল।

আনারস মধুপুরের অত্যন্ত লাভজনক এক ফল। এ ছাড়াও কলা, পেঁপে, কুল, মাল্টা, পেয়ারা, ড্রাগনসহ অন্যান্য ফলের চাষ বাড়ছে। আনারসের পর কলা চাষের জন্য এ অঞ্চলের গুরুত্ব বাড়ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে টাঙ্গাইল জেলায় ৪ হাজার ৬৬৭ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন জাতের কলা আবাদ করা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কলা চাষ হচ্ছে মধুপুরে।

টাঙ্গাইলের মধুপুরের বিখ্যাত আনারসের সুনাম দেশজুড়েই। তবে বছর দশেক আগে কিছু অসাধু ওষুধ কোম্পানির প্ররোচনায় চাষিরা অতি লাভের আশায় মাত্রাতিরিক্ত কেমিক্যাল ব্যবহার করে সুনাম হারিয়ে ফেলে। আনারস থেকে অনেকটাই মুখ ফিরেয়ে নিয়েছিল মানুষ। লাভ করতে গিয়ে লোকসানে পড়তে হয় আনারস চাষিদের। কৃষকরা বুঝতে পারে তাদের হারানো গৌরব ফিরিয়ে না আনতে পারলে আনারসের মিষ্টতা দেশের মানুষ পেতে চাইবে না। তাই তারা কেমিক্যাল ব্যবহার থেকে সরে আসে। ফলে ধীরে ধীরে আবারও মানুষ রসালো আনারসের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। বিশেষ করে ভয়াবহ করোনা এবং তীব্র দাবদাহে আনারসের চাহিদা বেড়ে যায়। আবারও লাভবান হয় কৃষক। তবে সম্প্রতি কীটনাশক ও সারের দাম বৃদ্ধি কারণে অনেকটাই হতাশায় রয়েছে আনারস চাষিরা। প্রয়োজন মতো সার না পাওয়ায় ক্ষতির আশঙ্কা করছেন তারা। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সুদৃষ্টি কামনা তাদের। পাশাপাশি পরিবর্তিত কৃষি বৈচিত্র্যের দারুণ উদাহরণ এ অঞ্চলের কৃষকরা তুলে ধরেন তাদের নানান দাবি ও প্রত্যাশার কথা। এক কৃষক বললেন, আনারস দিয়ে মধুপুরের পরিচিতি। এ আনারসকে আন্তর্জাতিক বাজারেও পরিচিত করে তোলা চাই। মৌসুমে আনারসের দাম পাই না। তাই আনারসের জন্য বিশেষায়িত হিমাগার চাই।

আরেক কৃষকের দাবি ছিল এলাকায় আনারস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের। বাজারে আনারস আনা-নেওয়ার মূল বাহন সাইকেল। বর্ষাকালে লাল মাটির পথে হেঁটে যাওয়াই কঠিন। সাইকেলে আনারস নিয়ে যাওয়া ভীষণ কঠিন হয়ে পড়ে। তাই সংযোগ সড়কগুলো পাকা করলে ভালো হয়।

এক মাল্টা চাষি বললেন, বাজারে বিদেশি মাল্টার দাম ২০০ টাকা আর আমরা বারি মাল্টা চাষ করি, কিন্তু আশানুরূপ দাম পাই না। একজন কৃষক বললেন, ভুট্টা উৎপাদন করে বাজারে বিক্রি করতে হয় ২৫ টাকা কেজি দরে। অথচ ভুট্টার বীজের কেজি ৭০০ টাকা। আমরা ন্যায্যমূল্যে বেচতে চাই, কিনতেও চাই। নদীগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। ফলে নদী থেকে সেচ দেওয়া সম্ভব হয় না। নদীর গভীরতা ফিরিয়ে আনার জন্য কর্মসূচি নেওয়া হোক। একজন বললেন, সরকার নির্ধারিত দামে সার পাই না। দোকানের পেছনের দরজা দিয়ে বেশি দামে সার বিক্রি হয়ে যায়। অন্য কৃষকরা তাকে সমর্থন জানালেন। তাদের দাবি, সারের ডিলার ইউনিয়নভিত্তিক করা হোক। দূর থেকে সার আনতে খরচ বেশি পড়ে। সারের ডিলার ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। খাসজমির জন্য সার বরাদ্দ দেওয়া হয় না। কিন্তু প্রচুর খাসজমিতে চাষাবাদ হচ্ছে। এ বিষয়টা নিয়ে সরকারকে নতুনভাবে ভাবতে পারে। এক কিষানি জানালেন আনারসের ভালো বাজার ব্যবস্থাপনা চাই। গারোবাজারে আধুনিক বাজার স্থাপন করা হোক। বাজারে বাজারে এটিএম বুথ চাই।

এ ছাড়াও যে বিষয়গুলো উঠে এসেছে : লোডশেডিংয়ের কারণে সেচের পাম্পগুলো জ্বলে যাচ্ছে। কৃষির জন্য বিদ্যুতের ইউনিট-প্রতি দাম ৩ টাকা আর ফিশারিজের জন্য ১৪ টাকা। কৃষি খাতে এ বৈষম্য দূর হোক। বিদ্যুতের দাম বাড়া, তেলের দাম বাড়া, সবকিছুর দাম বাড়া, সাধারণ মানুষ কীভাবে বাঁচবে? সরকার জিনিসপত্রের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার ভিতরে আনুক। বিএডিসির কন্ট্রাক্ট চাষিদের কাছ থেকে পুরো বীজ যেন তারা কিনে নেয়। হাইব্রিড বীজ নিয়ে আরও বেশি গবেষণা প্রয়োজন। সরকারি বীজ সময়মতো কৃষকের হাতে পৌঁছে না। মধুপুরে মাটি গবেষণা কেন্দ্রের দাবি। প্রাণিসম্পদ খাতে ভর্তুকি দাবি। ডেইরি খাতে আধুনিক যন্ত্রপাতিতে ভর্তুকি চান খামারিরা। দুধের আধুনিক বাজার ব্যবস্থা চেয়েছেন তারা।

খোলা মাঠে ফ্লাডলাইটের আলোয় প্রায় দুই ঘণ্টার বেশি সময় ধরে কৃষকদের দাবি-দাওয়াগুলো মনোযোগ দিয়ে শোনেন কৃষিমন্ত্রী। সব কৃষকের বক্তব্য শুনে কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘কৃষকের সব দাবি আমি নোট করে নিয়েছি। আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে সবগুলোই তুলে ধরব। আমি শাইখ সিরাজ ও চ্যানেল আইকে ধন্যবাদ জানাই এমন জবাবদিহিমূলক একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করার জন্য। আজ আমি মন্ত্রী, আপনারা কৃষকরা সরাসরি আমাকে প্রশ্ন করতে পেরেছেন, আপনাদের দাবি সরাসরি আমাকে জানাতে পেরেছেন, এমন চমৎকার উদ্যোগ আর হয় না। আনারস চাষিদের কথা আমি শুনেছি। আনারসের নতুন জাত আনার চেষ্টা করছি। আনারস বিক্রির টাকা দেখে আমি সোনালি ব্যাংকের শাখা এনে দিয়েছি গারোবাজারে। আপনারা এখন এটিএম বুথ চাচ্ছেন। আমি চেষ্টা করব প্রাইভেট ব্যাংকের একটা শাখা আনার। একজন কিষানি বললেন, আনারসের বাজারব্যবস্থা উন্নত করার। ইতোমধ্যে কাজ হাতে নিয়েছি। এ বছরের মধ্যে হয়ে যাবে। সারের ডিলার নিয়ে উচ্চ পর্যায়ে আলোচনা করব। খাসজমি বিবেচনায় নিয়ে সারের বরাদ্দ বাড়ানোর বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখব। সার বিক্রির মনিটরিং আরও বাড়াতে হবে। কৃষককে যেন নির্ধারিত দামের চেয়ে এক টাকাও বেশি দিতে না হয়। সবজি রপ্তানির জন্য আমরা কাজ করছি। আগামীর কৃষি উন্নয়নের জন্য রপ্তানির বিকল্প নেই। আমিও মনে করি প্রাণিসম্পদ খাতে ভর্তুকি দেওয়া প্রয়োজন। শাইখ সিরাজ সাহেবকে অনুরোধ করব এ বিষয়টি আরও জোরালোভাবে তুলে ধরার জন্য। সব শেষে শাইখ সিরাজ সাহেবকে ধন্যবাদ জানাব তার অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য। তিনি কৃষিকে অনন্য উচ্চতায় তুলেছেন। আজকে কৃষকের মর্যাদা বৃদ্ধি হয়েছে তার লাগাতার চেষ্টায়। এভাবেই শেষ হয় কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেটের দ্বিতীয় আয়োজন। জাতীয় বাজেট ঘোষণার আগে কৃষিমন্ত্রীকে সরাসরি নিজেদের সমস্যা ও প্রত্যাশার কথা জানাতে পেরে কৃষকরা সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন।

 

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব 

[email protected]

সর্বশেষ খবর