শনিবার, ৬ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

টানেলের শেষে ম্রিয়মাণ আলো

অধ্যাপক মালেকা আক্তার চৌধুরী

টানেলের শেষে ম্রিয়মাণ আলো

মধ্য সত্তর দশকের কিছু পরে তখন আমি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ি। ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি, দেশীয় রাজনীতিতে তখন প্রচ- অস্থিরতা বিরাজিত।  বলা চলে সেই শিশুকালে এতসব বোঝার মতো মনন মানসিকতা অনুভবের গভীরতা প্রখরতা তেমন ছিল না আমার। ঘরে বাবা ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী। তুখোড় মেধাবী এবং জগত্তারিনী গোল্ড মেডেলিস্ট বাবার মুখেই শুনেছি ‘কবর’ কবিতার আবৃত্তি, ‘আয় খুকু আয়’ গানটি আর শুনেছি বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী রাজনৈতিক জীবনের গল্প। শুনেছি সদ্য সাবেক প্রেসিডেন্ট মহামান্য আবদুল হামিদের কথা। আমার বাবা কিশোরগঞ্জের মানুষ। চাকরি সূত্রে জামালপুরে। আমার মা অল্প শিক্ষিতা হলেও বাবার মুখে রাজনীতির গল্প শুনতে শুনতে তিনিও তখন এই অঙ্গনের অনেকের নাম জানতেন, উপমহাদেশের নামকরা ইতিনেতি মননের মানুষগুলোর চালচিত্র বুঝতেও পারতেন। ভাইবোনদের মাঝে আমিই ছিলাম বাবা-মার বড় কন্যা। বাবা চাইতেন কন্যা তার বয়সের তুলনায় পড়াশোনায় ঢের এগিয়ে থাকুক। সেভাবেই সরকারি প্রাথমিকে ভর্তি হয়ে নতুন এক জগতের সঙ্গে অভিষেক ঘটল আমার। সেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মেয়ে বন্ধুদের সঙ্গে ছেলে বন্ধুরাও ছিল। জনাব হালিদা আপাকে পেয়েছিলাম প্রধান শিক্ষক হিসেবে। ছিলেন নারু স্যার, হরিবলা দিদি, বেলা আপা, আভাদিদি-হাইস্কুলে আরও অনেকের সঙ্গে ছিলেন লীলা দিদিমণি, রোকেয়া আপা, লতিফ স্যার, হরিপদ স্যার, বিষু স্যার, বাসু স্যারসহ আরও অনেকে। কাচারিপাড়া থেকে দয়াময়ীপাড়ার স্কুলের পথটি ছিল আমাদের আজন্ম বিচরণভূমি। হেলেদুলে, কলা বেণি দুলিয়ে, ক্রস করে ওড়না জড়িয়ে মন্দিরের ভিতর দিয়ে নিত্য আসা-যাওয়া ছিল ভারি আনন্দের। চেতনার জগৎ তখন আন্দোলিত হতো ক্লাস করা, পুজো দেখা আর নতুন মুক্তি পাওয়া ছবির রোমাঞ্চকর রিকশা মাইকিংকে ঘিরে। বাংলা ছায়াছবি দেখেছি নানান বাহানা সাজিয়ে। সিংহজানী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠ আর প্রাথমিকের বিস্তীর্ণ মাঠ ছিল একাকার। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঝমাঠে দুটো শতবর্ষী আম গাছ তার প্রকা- শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল। টিফিনের ফাঁকে কিংবা ছুটির পরে গাছ দুটিকে ঘিরে কলহাস্যে চলত আমাদের ছুঁয়োছুঁয়ি খেলা, বউছি খেলা। প্রায় পাঁচ দশক পর নিজেরাও মধ্য ষাটের কিনার বরাবর দাঁড়িয়ে পুরনো স্মৃতি ঘেঁটে, মলিন হয়ে যাওয়া, পুরু ধুলির স্তর জমে থাকা কম বয়সী সময়ের সুখ রোমন্থনে আবার মিলেছিলাম আমরা কজন বন্ধু সেই মায়াবী সময়ের খোঁজে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। হৃদয়ের টানে খুঁজে নিয়েছি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আমাদের দুই শিক্ষাগুরুকে। একজন শ্রদ্ধেয় সম্মানিত শ্রীমতী হরিবলা দিদি আর অন্যজন সম্মানিত শ্রীমতী লীলা দেব।

খুব ছোট্ট পরিসরে প্রায় ১৫-১৬ জন বন্ধুর সম্মিলনে ছিল আমাদের ক্ষুদ্র আয়োজন। আয়োজন ক্ষুদ্র হলেও এর ব্যাপকতা-গভীরতা-উষ্ণতা ছিল সব কিছুর বিবেচনায় কালোত্তীর্ণ। এর উদ্যোক্তা বন্ধু মুর্শিদা। পেশায় ব্যাংক কর্মকর্তা বলেই আন্তরিকতায় ঘাটতি ছিল না এতটুকুও। মুর্শিদা জামালপুরে না এসে ওভার ফোনেই যতটা পেরেছে সবাইকে কানেক্ট করেছে, দিনক্ষণ নির্ধারণ করে ম্যাডামদেরও উপস্থিত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। আন্তরিক ধন্যবাদ বন্ধু। বেবী জরুরি কাজে আসতে না পারলেও আমি এসেছি বাসে করে, সারা রাত জেগে। বন্ধু হেলেনকে আর কোহিনুরকে বলেছি বাসা থেকে আমায় নিয়ে যেতে। তিনজন একসঙ্গে রিকশা থেকে নামতেই বুকের মাঝে ধক করে একটা ধাক্কা অনুভব করলাম। সেই কিশোরীবেলায় ছেড়ে যাওয়া আনন্দ প্রাঙ্গণে আবার পা ফেলেছি জীবনের শেষবেলায়। কী অদ্ভুত শিহরণ! কত কথা কত স্মৃতি আনাগোনার অনুরণন। গেটে নেই আচারওয়ালী পশ্চিমা কালুর মা, চানাচুরওয়ালা, আইসক্রিম মামা।

দিনটা শুক্রবার। তাই চলমান শিক্ষার্থী আর শিক্ষকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটেনি। আমাদের সেই চিরচেনা পুরনো টিনের ঘরের লম্বা এল প্যাটার্ন ক্লাসরুম, অবারিত মাঠ, অফিসটিও আজ আর সেখানে নেই। থাকার কথাও নয়। স্মৃতি হাতড়ে জায়গাগুলো শনাক্ত করেছি, ঘুরেছি; বন্ধুদের দেখে উচ্ছ্বসিত হয়েছি, জড়িয়ে নিয়েছি। ইতোমধ্যে হরিবলা দিদি এবং লীলা দিদিমণি আমাদের মাঝে এসে উপস্থিত হয়েছেন। ছুটে গিয়ে পা ছুঁয়ে সালাম করতে করতে মনে হলো ভূস্বর্গের দেবীদের আশীর্বাদপুষ্ট হচ্ছি আমরা। সবাই মিলে একসঙ্গে কেক কেটেছি, ফুলেল শুভেচ্ছায় অভিষিক্ত করেছি, তুলেছি হাজারো ছবি। সে ছবি কথা কয়, সৃষ্টির আনন্দে আনে জয়। বক্তব্যে বলেছি শিশুবেলার না বোঝা অনেক কথা, অনেক স্মৃতি। জানতে চেয়েছি সেই সময়ে আমাদের সম্পর্কে ম্যাডামদের ভবিষ্যৎ ভাবনা কেমনটা ছিল। কল্পনার আকাশ প্রসারিত হয় মানুষ যখন অভিজ্ঞ হতে শুরু করে। শিশুবেলার কল্পনা থাকে সংগোপনে কুঁড়ির মতো গুটিসুটি হয়ে। সেই বিকশিত কুঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে দুজনেই বললেন নানান মনোমুগ্ধকর কথা। আক্ষেপও করলেন সামান্য। মাঝেমধ্যে বিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানাদিতে ওনাদের আমন্ত্রণ জানানো হলেও তাঁদের নিজ হাতে গড়া অসংখ্য ছাত্রছাত্রী আজ দেশে-বিদেশে সমাজের-রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। ব্যাচভিত্তিক অথবা সমন্বিতভাবে কেউ কাছে আসেন না, ডাকেনও না। এক্ষেত্রে ব্যর্থতা আমাদেরও কম নয়। অকপটে স্বীকার করেছি। ক্ষমা প্রার্থনা করেছি। তাঁরা আমাদের প্রাণভরে আশীর্বাদ করেছেন। আদ্রস্বরে আমাদের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। বলেছি, আপনাদের দেওয়া শিক্ষা ভাঙিয়েই জীবনের এই কঠিন পথ পাড়ি দিচ্ছি। আমাদের দুজন প্রিয় দিদিমণিই আবেগে আপ্লুত হয়েছেন। ভাবনার গন্ডিটা ওনাদের এতটা সম্প্রসারিত হবে তেমনটা ভাবেননি। এটাই আমাদের সম্মিলিত সার্থকতা। প্রিয় বন্ধু বুলু, শেবু, শিরিন, রেখা, সুতপা, মিতু, রুবি, লিপি, তোদের সঙ্গে জীবনের এই অবেলায় বৈচিত্র্যময় ভুবনে আবার দেখা হবে ভাবিনি। ঘর ছেড়ে, সংসার ছেড়ে, জীবনের নানান জটিলতা ভুলে আবার সবাই মিলে কলকলিয়ে হেসে উঠব সেটাও ভাবিনি। সেলিনা, ঊষা, ঝুমা, মুর্শিদা, কোহিনুর-মাঝে মাঝে তবু দেখা পাই; বিষয়টাতে আনন্দ ভৈরবী জাগে, ক্লান্তিকর অবসাদ কাটে। ননদ বন্ধু ‘হেলেন’ অব ট্রয় (রূপকার্থে) তো ঘরেই রয়েছে জাগ্রত; অতন্দ্র প্রহরী হয়ে তবুও মনে হয় বহুদূর।  মিস করেছি অনেক বন্ধুকে। আবার কোনো মাহেন্দ্রক্ষণে এমন মাধুর্যপূর্ণ ভুবনে হবে তো দেখা বন্ধুরা! থাকুক না এমন মিষ্টি একটা অপেক্ষা...।

লেখক : দর্শন বিভাগ সম্পাদক, শিক্ষক পরিষদ সরকারি তিতুমীর কলেজ, ঢাকা

সর্বশেষ খবর