মঙ্গলবার, ৯ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

মহান বীর মুক্তিযোদ্ধা নয়া মুন্সী

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

মহান বীর মুক্তিযোদ্ধা নয়া মুন্সী

মঙ্গলবার (২ মে) পত্রিকা বেরোয়নি তাই লেখা হয়নি। সোমবার ছিল পয়লা মে। সারা পৃথিবীর শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির দিন। যদিও শ্রমিকের মুক্তি আসেনি, মর্যাদা বাড়েনি। সারা বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলনে এক ধস নেমেছে। ৫০-৬০ বছর আগে পাকিস্তান আমলে শ্রমিক আন্দোলনের যে গুরুত্ব ও মর্যাদা ছিল এখন তার ছিটেফোঁটাও নেই। আমরাই দেখেছি ছাত্র-যুবক-কৃষক-শ্রমিক সব এক ছিল, মালিক ছিল আলাদা। কিন্তু এখন শ্রমিক-মালিক ঐক্য হয়, ছাত্র-জনতা হয় শত্রু। পথে পথে হাটে ঘাটে ছাত্র-শ্রমিকের লড়াই। আগে ছাত্ররা, যুবকরা ছিল সমাজের অহংকার। সবাই ছাত্র-যুবককে বুকে আগলে রাখার চেষ্টা করত। ছাত্র-যুবকরাও ছিল সাধারণ মানুষের বলভরসা। আমাদের আমলে একজন ছাত্রকেও ঠিকাদারি করতে দেখিনি, ব্যবসা-বাণিজ্য করতে দেখিনি। ছাত্র-যুবক-শ্রমিকরা মাঝেমধ্যেই নানা অনুষ্ঠানের জন্য লোকজনের কাছ থেকে চাঁদা নিত। সে চাঁদা ছিল ২-৪-৫-১০ টাকা। এখনকার মতো কেউ বাড়িঘর করতে গেলে এলাকার মাস্তানদের, ছাত্র-যুবকদের লাখ লাখ টাকা সেলামি দিতে হতো না। মুক্তিযুদ্ধের সময় সাধারণ মানুষের সে যে কি চারিত্রিক উন্নতি ঘটেছিল তা বলার মতো না। যারা পাকিস্তান চাইত তারা আমাদের হাতে ধরা পড়লেও পাকিস্তান চাইত। পাকিস্তানের দালালি আর বাংলাদেশের স্বাধীনতা কখনো একদণ্ডে অগ্রসর হয়নি। পাকিস্তান সমর্থক অনেকেই মনে প্রাণে বিশ্বাস করেই পাকিস্তান সমর্থন করত। আর আমরা যারা স্বাধীনতা চাইতাম মানুষের মুক্তির জন্য রক্ত দিয়ে রাজপথ পিচ্ছিল করতাম তারাও বিশ্বাস করেই কাজটি করতাম। এসবের কোনোখানে কারও কোনো ফাঁকিজুকি ছিল না। আমরা যেমন বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে চারিত্রিক বলে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষে পরিণত হয়েছিলাম, ঐক্যের শক্তিতে বলীয়ান হয়েছিলাম। এখন আমাদের রাস্তাঘাট, দালানকোঠা, ঘরবাড়ি সহায়সম্পদ যার যা-ই থাকুক হিংসা করার মতো সততা মানবতা শক্তি সাহস তেমন কিছুই নেই। কখনোসখনো মনে হয় আমরাই বুঝি সারা পৃথিবীর মধ্যে এখন দুর্বল মানুষ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের বিজয় সম্পর্কে পৃথিবীর অনেক পণ্ডিত ভাবতেই পারেননি। কারণ তারা পাকিস্তানের অস্ত্রের শক্তিকে বিবেচনা করেছেন, সেনাদের উন্নত প্রশিক্ষণ বিবেচনা করেছেন। কিন্তু বাঙালির আবেগ-ভালোবাসা, ত্যাগ-তিতিক্ষা কোনো বিবেচনায় আনেননি। যে কারণে আমরা মুক্তিযুদ্ধে সফলকাম হয়েছি। আমেরিকা-চীন-আরব দেশগুলোর সব শক্তি ছিল আমাদের বিরুদ্ধে। এমনকি স্বাধীনতার পর বাংলাদেশকে সহজভাবে স্বীকার করতে না পেরে আমেরিকার জাঁদরেল পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের কাছে এটা পাকিস্তানের পরাজয় নয়, এটা আমার ব্যক্তিগত কূটনীতির চরম পরাজয়।’ আজ আমাদের সেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাও নেই, পৃথিবীর লাখো কোটি শ্রমিকের শ্রমমর্যাদা ও আত্মশক্তিও নেই। আগে যার যত সম্পদই থাকুক কেন শিল্পপতি গর্ব করে কোনো মিটিংয়ে যেতে পারত না। সভা-সমাবেশে কেউই কোনো মঞ্চে স্থান পেত না। দু-চার জন স্থান পেলেও তারা কখনো শিল্পপতি হিসেবে, কোটিপতি হিসেবে পরিচয় দিতে পারত না। কিন্তু এখন বড় বড় সভা-সমাবেশে বিত্তশালীরা বড় বড় গাড়ি নিয়ে উপস্থিত হয়, মঞ্চেও তাদের বিত্তশালী শিল্পপতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। কোনো ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হয় না। বরং শিল্পপতিরা যখন মাইকের সামনে দাঁড়ায় নাদুসনুদুস চেহারা নিয়ে গাল ফুলিয়ে কথা বলে তখন বরং তারাই হাততালি বেশি পায়।

পরপারে যাওয়ার সংখ্যা এখন অনেক বেশি। প্রতিদিন শুনি কেউ না কেউ শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করছে। এই তো ৫ মে নাগরপুর সুটাইন চরের কমান্ডার জয়নাল আবেদীন আমাদের মায়া ত্যাগ করে চলে গেছে। ১৯৬৯-’৭০-’৭১-এ আমরা ছিলাম দুর্বার। সারা দেশকেই কেমন যেন আপন মনে হতো। ’৬৯-এ জেলের তালা ভেঙে শেখ মুজিবকে এনে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করার পর আমাদের কোথাও কোনো বড়সড় বাধা পেতে হয়নি। খবর পেলেই দূরদূরান্তে চলে যেতাম। নিরাপত্তার কথা একেবারেই ভাবতাম না আর ভাবতে হতোও না। এমনি একটি সময় ’৬৯-এর ফেব্রুয়ারি-মার্চে নাগরপুরের সুটাইন চরে এক ধর্মসভায় গিয়েছিলাম। রাত অনেক হয়েছিল। ধর্মসভায় বক্তৃতা করে কোনো এক বাড়িতে রাত কাটাতে গিয়েছিলাম। সেখানে সুটাইনের জয়নালের সঙ্গে হঠাৎই পরিচয়। বেশ ময়লা রঙের সুশ্রী মুখের এক যুবক। আমার চাইতে দু-চার বছরের বড়ই হয়তো হবে। প্রথম পরিচয়েই জয়নাল ভক্ত হয়েছিল। তারপর সব সময়ই সব আন্দোলনে জয়নালকে পেয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি হঠাৎ একদিন হেডকোয়ার্টারে কোম্পানি কমান্ডারদের তালিকায় সুটাইনের জয়নালের নাম দেখে ভীষণ খুশি হয়েছিলাম। অক্টোবরে নদীপথে চলাফেরার এক পর্যায়ে কেদারপুরে প্রায় দুই-আড়াই শ যোদ্ধাসহ জয়নালকে দেখি। এর আগে কাদেরিয়া বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার ফজলুর রহমান জয়নাল কোম্পানিকে বেশ কয়েক দিন নানা ধরনের প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। তাতে তাদের চলাফেরা, অস্ত্র নাড়াচাড়ায় প্রচুর উন্নতি হয়েছিল। সেই থেকে জয়নাল সব সময় একটা নির্ভরযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। সুটাইনের জয়নাল কোম্পানিকে নির্ভর করা যেত, তাকে দায়িত্ব দেওয়া যেত। মুক্তিযুদ্ধের মাঝে এক মারাত্মক ঘটনা ঘটেছিল। ব্যাপারটাকে দুর্ঘটনা, না ঘটনা বলব ভেবে পাচ্ছি না। জনাব খন্দকার আবদুল বাতেন করটিয়া কলেজের ভিপি ছিলেন। ছাত্রলীগ করতেন। তার সময় আমাদের সমর্থিত সোহরাব আলী খান আরজু সা’দত বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের জিএস ছিলেন। খন্দকার আবদুল বাতেন যেমনি মোটাসোটা কিছুটা হাবাগোবা, তেমনি আমাদের সমর্থক জিএস ভাতকুড়ার অতি দরিদ্র সোহরাব আলী খান আরজু ভীষণ চালাকচতুর, দুর্দান্ত বক্তা ছিলেন। করটিয়া কলেজের ছাত্র সংসদ ছিল ভিপিনির্ভর। কিন্তু বাতেন-আরজু পরিষদের জিএস সোহরাব আলী খান আরজুর কাছে ভিপি খন্দকার আবদুল বাতেন দাঁড়াতেই পারেননি। আমাদের দ্বন্দ্ব ছিল, কিন্তু আইয়ুব-ইয়াহিয়া বিরোধী আন্দোলনে তার কোনো বিরূপ প্রভাব পড়ত না। বরং প্রতিযোগিতা হতো। সেই খন্দকার আবদুল বাতেন মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে হঠাৎই আমার সঙ্গে গোলাবাড়ি ফরেস্ট ক্যাম্পে এসে দেখা করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ করতে চান। সঙ্গে ছিলেন বর্গার কাশেম মনিটর। আমি তাকে সব রকম সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছিলাম। শতাধিক গ্রেনেড, ৪০-৫০টি নানা ধরনের অস্ত্র পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। এরই দেড়-দুই মাস পর আমাদের কোম্পানি কমান্ডার লাবিবুর রহমান ও ছাত্রকর্মী জাহাঙ্গীর আলম তালুকদারকে খন্দকার আবদুল বাতেনের শিবিরে দাওয়াত করে লাউহাটি কেদারপুরের মাঝামাঝি উন্মুক্ত স্থানে অতর্কিত আক্রমণ করে হত্যা করে ধলেশ্বরী নদীতে ভাসিয়ে দেয়। সেই থেকে নাগরপুর অঞ্চলে এক গুমোট পরিবেশ সৃষ্টি হয়। খন্দকার আবদুল বাতেনের ৭০-৮০ অথবা ১০০ জনের একটি দল সেই থেকে যে পালিয়ে বেড়ায় স্বাধীনতা অর্জনের আগ পর্যন্ত এক দিনের জন্য তারা স্বাভাবিক আচরণ করতে পারেনি বা করেনি। স্বাধীনতার পরপর খন্দকার আবদুল বাতেনের দল নিয়ে আলমগীর খান মেনু মুজিব বাহিনী হিসেবে ঢাকায় যাওয়ার পথে কাদেরিয়া বাহিনীর হাতে আটক হয়। কারণ কাদেরিয়া বাহিনীর নিয়ন্ত্রিত এলাকায় অস্ত্র নিয়ে চলাফেরার কোনো সুযোগ ছিল না। কাদেরিয়া বাহিনীর হেডকোয়ার্টারে খবর এলে আলমগীর খান মেনুসহ প্রায় ৩০০ জনকে ৭০টি নানা ধরনের অস্ত্রসহ ঢাকা পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। বঙ্গবন্ধু ২৪ জানুয়ারি টাঙ্গাইল এসে কাদেরিয়া বাহিনীর অস্ত্র নিয়েছিলেন, ঠিক তেমনি ঢাকার পল্টন ময়দানে ৩১ জানুয়ারি ’৭২ মুজিব বাহিনীর হাত থেকে অস্ত্র নিয়েছিলেন। সেই অস্ত্র আমাদের মতো করে নয়, যেমন করে তারা দেবার দিয়েছিলেন। সেখানে সর্বজনাব শেখ ফজলুল হক মণি, তোফায়েল আহমেদ, আবদুর রাজ্জাক আরও কেউ ছিলেন। সে সময় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তেমন সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি বা যায়নি। হঠাৎ করেই বঙ্গবন্ধু আমাদের থেকে হারিয়ে গেলে জটিলতা আরও বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এই বিরাট সময় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তেমন কিছুই করা হয়নি। বরং মুক্তিযোদ্ধারা সব সময় ছিল একটা মারাত্মক হুমকির মুখে। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর কাছে মুক্তিযোদ্ধারা যা ছিল তার চাইতে খারাপ অবস্থায় পড়েছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কিছু দাবিদাওয়া এবং মুক্তিযুদ্ধ -বিষয়ক মন্ত্রণালয় চাওয়াতে নানান কথাবার্তা, গালাগাল শুনে একসময় আমি আওয়ামী লীগ ত্যাগ করেছিলাম। ২০০০ টাকা সম্মানি দাবি করায় সারা জীবন যে দল করেছি সে দলের কত নেতানেত্রী যা ইচ্ছা তাই গালাগাল করেছেন। বিএনপি সরকার এলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন করা হয়। তারপর আসে আওয়ামী লীগ। সত্যিকার অর্থে রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগ মুক্তিযোদ্ধার দল এটা অস্বীকার করা সত্যের অপলাপ। স্বাধীনতার পরপরই যুদ্ধাহতদের ৭৫ টাকা সম্মানি দেওয়া শুরু হয়েছিল। সেটা আস্তে আস্তে ২-৩ হাজারে উঠেছিল। কিন্তু পরে গত ১০-১৫ বছরে বোন হাসিনার নেতৃত্বে সত্যিই মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সম্মানজনক কিছু করার চেষ্টা করা হয়েছে, এখনো হচ্ছে। তবে এ ক্ষেত্রে বন্ধুর চাইতে শত্রুই বেশি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানির ব্যবস্থা করেন। খেতাবপ্রাপ্তরাও কোনো সম্মানি পেতেন না। তাদেরও একটা সম্মানির ব্যবস্থা করেন। বছরখানেক মুক্তিযোদ্ধা, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এবং খেতাবপ্রাপ্ত এ তিন ক্যাটাগরিতেই অনেকে ভাতা পান। কিন্তু হঠাৎ একসময় রাজাকারের ছেলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব হয়েছিলেন। তিনি হঠাৎই একটা নোট দেন, খেতাবপ্রাপ্ত, যুদ্ধাহত এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা এ তিন ক্যাটাগরির মধ্যে যে সম্মানি বেশি শুধু সে সেটাই পাবে। কিন্তু যিনি মুক্তিযোদ্ধা হয়েছেন, যুদ্ধ করতে গিয়ে আহত হয়েছেন এবং অনেক আহত যোদ্ধা খেতাব পেয়েছেন তাদের তিনটি সম্মানি পাওয়া উচিত এবং একসময় তা পেয়েছেন। এখন ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্র তিন ক্যাটাগরিতেই সম্মানি ভাতা দেয়। তাহলে একজন যোদ্ধা যুদ্ধাহত ভাতা পেলে মুক্তিযোদ্ধার ভাতা পান না। কারণ সাধারণ মুক্তিযোদ্ধার চাইতে যুদ্ধাহতের ভাতা বেশি। সেই যোদ্ধাই যদি খেতাবপ্রাপ্ত হয়ে থাকেন তাহলে খেতাবপ্রাপ্তের ভাতা পান না। যুদ্ধাহতের ভাতাই পান। এ ব্যাপারটা কোনো পণ্ডিতকে বোঝানো গেল না। মাননীয় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী একজন রাজনৈতিক মানুষ। তাঁকে বললে তিনি বোঝেন। বাকিরা তথৈবচ।

সবারই বয়স হয়ে গেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের তো বটেই। এখন যাওয়ার পালা। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িত আমার জীবনের সঙ্গে জড়িত অনেকেই ইতোমধ্যে চলে গেছে। লম্বা সিরিয়াল পড়ে আছে সামনে। সখিপুর পাইলট স্কুল মাঠে বেশ কিছু জানাজায় শরিক হয়েছি। তার মধ্যে মনে পড়ে গজারিয়ার লুৎফর রহমান বহুদিন আমার সঙ্গে কাটিয়েছে। খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্যে এবং সম্মান নিয়ে যেতে পারেনি। বীর মুক্তিযোদ্ধা লুৎফর রহমানের জানাজায় মন্ত্রী হিসেবে রাজা দীপঙ্কর তালুকদার এসেছিল। রাজা দীপঙ্কর ’৭৫-এর প্রতিরোধ যুদ্ধে জাতীয় মুক্তিবাহিনীতে ছিল। জানাজার সময় রাজা স্কুলের অফিস রুমে বসে ছিল। এরপরে হামিদুল হক বীরপ্রতীকের জানাজায় শরিক হয়েছিলাম। এই সেদিন ২৯ এপ্রিল আবদুল হামিদ নয়া মুন্সীর জানাজায় শরিক হয়েছিলাম। দেহমন ছিল ভারাক্রান্ত। কোনো কিছুই ভালো লাগছিল না। সখিপুরে আগাগোড়াই নানা ধরনের লোকের বাস। সখিপুর ছিল মুসলিম লীগের ঘাঁটি। শওকত মোমেন শাজাহানের বাবা মুক্তার আলী চেয়ারম্যান, মান্না তালুকদার, হিম্মত তালুকদার, বাদশা তালুকদার আরও অনেকেই ছিল মুসলিম লীগার। ঠিক সময় মুক্তিবাহিনী গড়ে না উঠলে সখিপুর হতো স্বাধীনতাবিরোধীদের সবচাইতে বড় ঘাঁটি। কিন্তু তা হয়নি। সখিপুর হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের তীর্থভূমি। হামিদুল হক বীরপ্রতীক, শওকত মোমেন শাজাহান, মকবুল হোসেন, আবদুল হালিম মাস্টার, আবু হানিফ আজাদ, ওসমান গনি এমনি ধরনের অনেক মানুষের সমাহারে সখিপুর হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের পীঠস্থান। এই কদিন আগে আমজাদ মাস্টারের ‘মুক্তিযুদ্ধে কাদেরিয়া বাহিনীর ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল’ পড়ে অনেকটাই অভিভূত হয়েছি। আমজাদ লেখাপড়া জানলেও বইপুস্তক লেখেনি। লেখা একটা শৈলী। তার পরও যা লিখেছে, যেভাবে সখিপুরের চিত্র সে ফুটিয়ে তুলেছে তা অসাধারণ। শওকত মোমেন শাজাহান আমাদের সঙ্গে ছাত্রলীগ করত। বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীর একেবারে একনিষ্ঠ কর্মী। মুক্তিযুদ্ধে সে আমাকে অনুসরণ করেছে। আগাগোড়া রাজনৈতিক মানুষ। আবদুল হামিদ নয়া মুন্সী মুক্তিযুদ্ধের এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। নয়া মুন্সী এবং উসমান গনি মাস্টার সখিপুরে না থাকলে মুক্তিযোদ্ধারা খাওয়াদাওয়া নিয়ে আরও অনেক কষ্ট করত। মায়ের কোলে যেমন শিশু দোলে ঠিক তেমনি নয়া মুন্সীর কারণে সখিপুরের মুক্তিযোদ্ধারা হেলেদুলে খেয়েছে। সখিপুরের ইতিহাসে শ ম আলী আজগরকে আমার অসাধারণ মানুষ মনে হয়েছে। আজ থেকে বছর বিশেক আগে সখিপুর পাইলট স্কুলের সভাপতি হিসেবে তার এক ভাষণ শুনেছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একসময়ের ভাইস চ্যান্সেলর আবু সাঈদ চৌধুরী ডিগ্রি প্রদান অনুষ্ঠানে বা কনভেনশনে অমন অসাধারণ ভাষণ দিয়েছেন। আমি তাজ্জব হয়েছিলাম যে একজন মানুষ কত জ্ঞানী হলে এমন অসাধারণ ভাষণ দিতে পারেন। এখন ওসব নেই। হামিদুল হক বীরপ্রতীক মুছে গেছে, শ ম আলী আজগর মুছে গেছে, আউয়াল সিদ্দিকীর খবর নেই, বড়চওনার ইদ্রিস কমান্ডার একেবারে ধরাছোঁয়ার বাইরে। কেউ কারও কথা মনে রাখে না, কেউ কাউকে নিয়ে কথা বলে না। সখিপুরে যেমন অসাধারণ ভালো মানুষের সমাহার তেমনি কিছু দালাল প্রকৃতির পরগাছাও আছে। পাকিস্তান আমলেও ছিল, বাংলাদেশেও আছে।

বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হামিদ নয়া মুন্সী এক অসাধারণ মানুষ। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার না হলেও ১০-১৫ বার দেখা হয়েছে। আমাদের সবার পীর শাহ সুফি সামানউল্যাহর মতো নয়া মুন্সীকেও বঙ্গবন্ধু অসম্ভব ভালোবাসতেন, গুরুত্ব দিতেন। স্বাধীনতার পর নয়া মুন্সী আমার কাছে একজন গুরুত্বপূর্ণ সম্মানি ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত হতেন। মুক্তিযুদ্ধে বহু লোকের বহু জনের বহু অবদান আছে। কিন্তু নয়া মুন্সী অসাধারণ। ২৫ মার্চের পর পাকিস্তানি হানাদাররা যেমন যাকে তাকে মেরে কেটে জ্বালাও -পোড়াও করে দিগ্বিদিক ছড়িয়ে পড়েছিল, ডিসেম্বরে আমরা যখন একের পর এক হানাদার ঘাঁটি দখল করে নিয়েছিলাম তখন অনেক পাকিস্তানি দলছুট হয়ে এদিক-ওদিক ছড়িয়ে পড়েছিল। সখিপুর-কালিহাতী-বাসাইলের নানা জায়গায় শত শত দলছুট হানাদার মুক্তিবাহিনীর হাতে অথবা সাধারণ মানুষের হাতে ধরা পড়েছে। সখিপুরে নয়া মুন্সীর হাতে এ রকম এক হানাদার ধরা পড়েছিল। লোকজন এদিক-ওদিক থেকে হানাদারটিকে সারেন্ডার করতে বললে সে তখনো হাত তোলেনি। একসময় খবরটি নয়া মুন্সীর কানে যায়। সে ছুটে যায় হানাদারটির কাছে। আস্তে আস্তে কাছাকাছি হয়। হানাদারটি চিৎকার-চেঁচামেচি করে, আরও কাছে গেলে সে গুলি করবে। এদিক-ওদিক দু-একটি গুলি করেও। কিন্তু নয়া মুন্সী তাতে ঘাবড়ে না গিয়ে সঙ্গে সঙ্গে চলতে থাকে। একসময় অস্ত্রধারী হানাদারটিকে সে জাপটে ধরে। কুস্তিগিরের মতো পাল্টাপাল্টি হতে থাকে। একসময় বহু লোক ছুটে গিয়ে হানাদারটিকে কাবু করে ফেলে। আমরা এ খবরটি যখন পাই তার আগেই সাহসিকতার জন্য আমাদের সুপারিশ প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানীর কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। নয়া মুন্সী প্রতীক পাননি। কিন্তু আমার কাছে তিনি সব সময় প্রতীকের চাইতেও সম্মানি ছিলেন। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট খুনিদের হাতে বঙ্গবন্ধু নিহত হলে কালিয়া ইউনিয়নের দেবরাজ থেকে হুজুর মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর কাছে নয়া মুন্সীকে দিয়ে এক পত্র পাঠিয়েছিলাম। যথাসময়ে পত্র নিয়ে তিনি সন্তোষে হুজুরের কাছে গিয়েছিলেন। এসব নিয়ে কত সময় কত কথা হয়েছে। সেই নয়া মুন্সী সেদিন চলে গেলেন। নয়া মুন্সী শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন রাত ১২টায়। জানাজা হয় পরদিন দুপুর ২টায়। কিন্তু সরকারিভাবে দাফন-কাফনের সুন্দর কোনো ব্যবস্থা হয়নি। আমি অনেক দিন আগে থেকেই বলে আসছি, মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় সালাম দিতে একটু যত্নশীল হওয়া উচিত। এ দুনিয়ায় আমরা যে যত বড়ই হই পরম করুণাময় দয়ালু আল্লাহর বিচারে সবাই সমান। তাই একটু হাদিস-কোরআন মেনে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে বিদায় জানানো উচিত। ইচ্ছামতো যা খুশি করা উচিত না। একজন মুর্দাকে গার্ড অব অনার দেবেন; একটু পাকসাফ হয়ে সালাম দিলে তেমন কী ক্ষতি? সেদিন সখিপুরে নয়া মুন্সীকে পুলিশের গার্ড অব অনারে কোনো যত্ন ছিল না। পাকসাফের তো প্রশ্নই আসে না। গার্ড অব অনারে নেতৃত্ব করেছেন সখিপুরের মহিলা ইউএনও। তিনি বলেছেন, সরকারি গার্ড অব অনার আর জানাজা এক নয়। ইউএনও আমার মেয়ের বয়সী একজন। আইনটি যখন হয়েছে তখন সেখানে অনেকবার আমি অনেক কথা বলেছি। আইনে মহিলা ইউএনও সালাম দিতে পারবেন না এটা লেখা নেই। আবার এটাও তো লেখা নেই পুরুষ লাশকে মহিলা কর্মকর্তা সালাম দিতে পারবেন। প্রশ্নটা ইসলামী শরিয়তের। নিশ্চয়ই মেয়েদের অনেক স্বাধীনতা থাকা উচিত, ক্ষমতা থাকা উচিত। কিন্তু শরিয়তও মানতে হবে। যে কাজটি সেদিন হয়েছে। জানি না কেমন কী হবে। আমি ১৯৬৮ সালে এক রিকশাওয়ালাকে স্যান্ডেল দিয়ে বাড়ি দিয়েছিলাম। ঘণ্টাখানেক পর আমার কেমন যেন অস্বস্তি লাগছিল। তার একটু পরই মনে হচ্ছিল আমি ভুল করেছি। আমি যদি কোনো ক্ষমতাবানকে মারতাম সেটা মানানসই হতো। কেন আমি একজন রিকশাওয়ালাকে মারলাম? অনেক খোঁজাখুঁজি করে বিকালে টাঙ্গাইলের নিরালা মোড়ে সেই রিকশাওয়ালার দুই পা চেপে ধরে ক্ষমা চেয়েছিলাম। রিকশাওয়ালা আমায় ক্ষমা করেছিল। সখিপুরের প্রথম উপজেলা চেয়ারম্যান ছিল শওকত মাস্টার। খুবই সাদাসিধে মানুষ। সেটা এরশাদের আমল। অবাধ্য ইউএনওর সঙ্গে উপজেলা চেয়ারম্যানের কী নিয়ে যেন মতান্তর হয়েছিল। বিকালেই তাকে সখিপুর থেকে জেলা সদরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সেদিন ইউএনও যা করেছেন কোনো সরকারি কর্মকর্তা অত উত্তেজিত হতে পারেন না। আমাদের অনেক বয়সী মানুষের সামনে দিয়ে তিনি যেভাবে সিংহীর মতো ফোঁস ফোঁস করতে করতে এদিক-ওদিক গেছেন কাজটা ভালো হয়নি। নয়া মুন্সীকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়েছে জানাজার পরে। মানব জীবনে মুসলমানের কাছে জানাজা একটি মস্তবড় জিনিস। তাই এসব ব্যাপারে সতর্ক থাকতে সরকারি প্রশাসনকে আমি অনুরোধ করছি। কিছু কিছু সরকারি কর্মচারী কর্মকর্তার কর্মকাণ্ড দেখে কেন যেন মনে হয় তারা সরকারের কল্যাণ নয়, অকল্যাণের চেষ্টা করছেন।

লেখক : রাজনীতিক

www.ksjleague.com

সর্বশেষ খবর