বুধবার, ১০ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ : ঠেকানোর পথ কী

তপন কুমার ঘোষ

ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ : ঠেকানোর পথ কী

গত ৩০ এপ্রিল মধ্যাহ্ণের ঘটনা। আগারগাঁও থেকে উত্তরা যাওয়ার পথে রাজধানীর কাফরুল থানার শেওড়াপাড়া এলাকায় মেট্রোরেল লক্ষ্য করে কে বা কারা ঢিল ছোড়ে। এতে মেট্রোরেলের জানালার একটি কাচ ফেটে যায়।  মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১০ লাখ টাকা। সর্বশেষ খবর, মেট্রোরেলে ঢিল ছোড়া হয়েছিল যে ভবন থেকে সেটি চিহ্ণিত করা হয়েছে। মেট্রোরেল পরিচালনাকারী সরকারি প্রতিষ্ঠান ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি আরও জানান, যে বা যারাই ঢিল ছুড়েছে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রসঙ্গত, মেট্রোরেলের আইনে এ ধরনের অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদন্ড ও সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান আছে।

চলন্ত ট্রেনে পাথর বা ঢিল নিক্ষেপের ঘটনা এটাই প্রথম নয়। দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রায়শ এমন ঘটনা ঘটছে। তবে মেট্রোরেলে এটাই প্রথম। এ ঘটনা লজ্জার, নিন্দার। চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনায় একদিকে যেমন ট্রেনের ক্ষতি সাধন হচ্ছে, চূর্ণবিচূর্ণ হচ্ছে ট্রেনের জানালার কাচ, অন্যদিকে গুরুতর আহত হচ্ছেন যাত্রী, ট্রেন চালক ও পরিচালকরা। কারও কপাল ফেটেছে। কেউ হারিয়েছেন চোখ। কারও মাথায় আঘাত লেগেছে। এমনকি যাত্রীর মৃত্যু পর্যন্ত ঘটেছে। সংবাদ মাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ২০১৩ সালে চট্টগ্রামে প্রীতিদাশ নামে এক প্রকৌশলী নিহত হন। ২০১৯ সালে নিহত হন রেলেরই এক পরিদর্শক। মনোবিদরা এ ধরনের ঘটনাকে ‘মনোবিকৃতি’ হিসেবে ব্যাখ্যা করছেন।

আরামদায়ক ও নিরাপদ ভ্রমণের জন্য ট্রেন দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ট্রেন ভ্রমণ সাশ্রয়ীও বটে। বিভিন্ন রুটে নতুন নতুন ট্রেন সার্ভিস চালু করা হয়েছে। পাথর ছোড়ার জন্য ট্রেন একটা সহজ লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠেছে। কে বা কারা এ ঘটনা ঘটাচ্ছে, শনাক্ত করা কঠিন। কেননা বেশির ভাগ ঘটনা প্রত্যন্ত এলাকায় বা রাতের অন্ধকারে ঘটেছে। এমন নয় যে, শুধু অবুঝ শিশুরাই এই কর্মটি করছে। প্রচলিত ধারণা হচ্ছে, রেললাইনের আশপাশে গড়ে ওঠা বস্তির লোকজন এটা করে থাকে। ভবঘুরে, টোকাই ও মাদক সেবনকারীরাও পাথর ছুড়ে থাকে বলে অনেকের অভিযোগ। টোকাইদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলে, কে কতটা টার্গেটে হিট করতে পারে।  মনোবিদরা বলছেন, এটা ‘অসুস্থ বিনোদন’।

এ প্রসঙ্গে ছোটকালে পড়া একটা গল্প মনে পড়ে গেল। প্রাইমারি স্কুলের দ্রুত পঠন বইয়ে এটা পড়েছিলাম। গল্পটা অনেকেরই জানা। তখন বর্ষাকাল। খাল-বিল-পুকুর-ডোবা বর্ষার জলে টইটম্বুর। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। ব্যাঙেরা আছে মহাআনন্দে। চারদিক থেকে ব্যাঙের ডাক কানে আসছে। উৎসবমুখর পরিবেশ! একদল দুষ্টুবালক বৃষ্টির মধ্যে খেলা করছিল। উচ্চৈঃস্বরে ব্যাঙের ডাক শুনতে পেয়ে তারা দলবেঁধে একটা পুকুরের পাড়ে গিয়ে হাজির হয়। পুকুরের জলে তখন অসংখ্য ব্যাঙ আনন্দে খেলা করছে। একজন বালকের মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি চেপে বসল। খেলার ছলে সে পুকুরে ঢিল ছুড়তে শুরু করে। তার দেখাদেখি অন্যরাও যোগ দেয় এই খেলায়। ঢিলের আঘাতে মারা যায় কয়েকটি ব্যাঙ, আহত হয় অনেক। তখন একটা মা-ব্যাঙ সাহস করে মাথা তুলে বলল, ‘ওহে বালকগণ! তোমরা আমাদের প্রতি এত নিষ্ঠুর আচরণ করছ কেন? আমরা তো তোমাদের কোনো ক্ষতি করিনি।’ এ কথা শুনে বালকদের মধ্যে একজন চিৎকার করে বলে উঠল, ‘আমরা পুকুরে ঢিল ছুড়ছি মজা করার জন্য। তোমাদের মারার জন্য নয়। এটা একটা মজার খেলা। আমরা ঢিল ছুড়ছি, তোমরা ডুব দিচ্ছ। কিছুক্ষণ পর আবার তোমরা ভেসে উঠছ। আমরা আবার ঢিল ছুড়ছি। এতে করে আমরা দারুণ মজা পাচ্ছি।’ তখন সেই মা-ব্যাঙটি বলল, ‘তোমরা কি জানো, তোমাদের জন্য যা খেলা, আমাদের জন্য তা মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের প্রতি সদয় হও। দয়া করে বন্ধ কর এই সর্বনাশা খেলা।’ গল্পটি এখানেই শেষ। বৃদ্ধ ব্যাঙের বাঁচার আকুতি শুনে দুষ্টু বালকদের মন গলেছিল কি না বা তাদের বোধোদয় হয়েছিল কি না, গল্পে তার উল্লেখ নেই। গল্পটা সেই কিশোর বয়সে মনে দাগ কেটেছিল। গল্পের সেই মর্মকথা আজও মনে গেঁথে আছে, ‘তোমাদের কাছে যেটা খেলা, আমাদের জন্য সেটা মৃত্যু।’ রূপক এ গল্পটা আমাদের কী শিক্ষা দেয়? আমাদের আনন্দ প্রকাশ যেন অন্যের বিরক্তি বা ক্ষতির কারণ না হয়। এ ব্যাপারে আমরা কতটা সচেতন? আমাদের সচেতনতা বলতে গেলে প্রায় শূন্যের কোঠায়। 

কিছুতেই রোধ করা যাচ্ছে না চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা। মেট্রোরেলে ঢিল ছোড়া সর্বশেষ ঘটনা। কে বলতে পারে, স্বপ্নের মেট্রোরেলের ক্ষতি সাধনের উদ্দেশ্যে এটা করা হয়নি! এতে কার লাভ আর কার ক্ষতি হবে, যে বা যারা এই কুকর্মটি করেছেন তাদের ভেবে দেখতে বলি। এ ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টি জরুরি। মানুষ যুক্তিবাদী। যুক্তি দিয়ে বোঝালে মানুষ যে বোঝে না, তা নয়। অন্ধভক্তদের কথা আলাদা। এই বোঝানোর দায়িত্বটা কার? আপনাকে আমাকে এগিয়ে আসতে হবে। দুর্বৃত্তদের চিহ্ণিত করে ধরিয়ে দিতে হবে।  স্থানীয়দের সহযোগিতা ছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে দুর্বৃত্তদের খুঁজে বের করা কঠিন।

ট্রেনে ভ্রমণ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠলে সংগত কারণেই ট্রেনে যাত্রীর সংখ্যা কমে আসবে।  এতে দেশের ক্ষতি, দশের ক্ষতি। এই বোধোদয় আমাদের কবে হবে?

 

                লেখক : সাবেক উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক, জনতা ব্যাংক লিমিটেড

সর্বশেষ খবর