‘ক্ষুধার্ত পাকিস্তান জ্বলছে রাজনীতির আগুনে।’ আনন্দবাজার পত্রিকার এই শিরোনামটি পাকিস্তান রাষ্ট্রের বর্তমান পরিস্থিতির সবটুকু বলে দেয়। একটি ব্যর্থ, সন্ত্রাসী রাষ্ট্রের পরিণতি কী হয় পাকিস্তান তার প্রমাণ। দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদরা প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে রাষ্ট্রকে কী ভয়াবহ পরিণতির দিকে নিয়ে যান, পাকিস্তান তার বড় বিজ্ঞাপন। পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রয়াত নেতা এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো বিবিসিকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানের রাজনীতির ভাগ্য বিধাতা সে দেশের জনগণ নয়, সেনাবাহিনী এবং পশ্চিমারা।’ পাকিস্তান সেনাবাহিনী যাকে পছন্দ তাকে সিংহাসনে বসায়। যাকে যখন খুশি সিংহাসন থেকে ফেলে দেয়। দেশটির ক্ষমতালিপ্সু রাজনীতিবিদরাও এটি ভালো মতোই জানেন। এ জন্য তাদের মূল লক্ষ্য থাকে সেনাবাহিনীর জেনারেলদের আস্থাভাজন হওয়া। প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে জনগণকে ধোঁকা দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়া। আর ক্ষমতায় গিয়ে বিপুল বিত্তের মালিক হয়ে ওঠা। পাকিস্তানে যারাই ক্ষমতায় গেছেন তারা জনগণের সম্পদ লুণ্ঠন করেছেন। বিদেশে অর্থ পাচার করে নিজেদের ভবিষ্যৎকে করতে চেয়েছেন নিরাপদ। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মূল লক্ষ্য হলো বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদকে লালন। বিশ্বে জঙ্গিবাদ, বিচ্ছিন্নতাবাদের মাধ্যমে অশান্তি সৃষ্টি। সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, পাকিস্তান নিজেদের উন্নতির জন্য যা ব্যয় করেছে তার চেয়ে তিন গুণ ব্যয় করেছে অন্য রাষ্ট্রের ক্ষতি করার জন্য।
তবে পাকিস্তানে গত ৯ মে থেকে যা হচ্ছে তা অন্য মাত্রার। পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী, ক্রিকেট কিংবদন্তি ইমরান খানের গ্রেফতারের পর বিক্ষোভে উত্তাল দেশটি। বিভিন্ন প্রদেশে জনগণ রাস্তায় নেমেছে, সেনানিবাস আক্রান্ত হচ্ছে। জনবিক্ষোভ সামাল দিতে পারছে না সেনাবাহিনীও। বিবিসি বলছে, বেনজির ভুট্টোর মৃত্যুর ঘটনার পর ইমরানের গ্রেফতারের ঘটনায় সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ দেখছে পাকিস্তান। তবে পাকিস্তান নিয়ে যারা গভীর বিশ্লেষণ করেন তারা বলছেন অন্য কথা। তাদের ধারণা, পুরো ঘটনাটি সাজানো নাটক। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে পাকিস্তানে নির্বাচন হওয়ার কথা। নির্বাচন বানচালের জন্য ইমরানকে গ্রেফতার করে, এই নাটক। ইমরান খানের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দেওয়া হচ্ছে। এসব মামলার একটিতেও যদি তিনি দণ্ডিত হন, তাহলে আগামী নির্বাচনের জন্য তিনি অযোগ্য হবেন। এর ফলে পরিস্থিতি আরও সহিংস এবং উত্তপ্ত হবে। অতঃপর আরেকজন জিয়াউল হক অথবা পারভেজ মোশাররফ মঞ্চে আরোহণ করবেন। পাকিস্তানে ভবিষ্যতে কী হবে তা সময়ই বলে দেবে। কিন্তু দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে থাকা দেশটির জন্য এই রাজনৈতিক উত্তাপ দেশটিকে ধ্বংসের ষোলকলা পূর্ণ করবে।
পাকিস্তানের ঘটনাপ্রবাহ একটি বিষয় সামনে এনেছে তা হলো ‘ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আন্দোলন।’ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সেখানে যতগুলো আন্দোলন হয়েছে তার পেছনে সেনাবাহিনী এবং বাইরের দেশের মদদ ছিল। এসব আন্দোলনের পরিণতি হিসেবে কখনো গণতন্ত্র আসেনি, এসেছে সামরিক শাসন। ইমরানের গ্রেফতারের পর আন্দোলন দেশটিকে আরেকটি সামরিক শাসনের শৃঙ্খলে বন্দি করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিএনপিও কি তেমন একটি অনির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় আনার লক্ষ্যে ব্যস্ত। লক্ষণীয় যে, বিএনপির কর্মসূচিগুলো যত না জনমুখী, জনগণকে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে পরিচালিত, তার চেয়ে বেশি কূটনীতিকপাড়ামুখী। বিএনপি নেতারা যতটা না জনগণের সঙ্গে সময় কাটান, তার চেয়ে বেশি ব্যস্ত থাকেন বিভিন্ন মিশনে, দূতাবাসে মধ্যাহ্ন এবং নৈশভোজে। পাকিস্তানি চেতনায় তারা ভালোভাবেই আবিষ্ট। এ কারণেই তারা মনে করেন, জনগণ না আসল ক্ষমতা হলো অন্য জায়গায়। ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদলের পাকিস্তানি তত্ত্বই যেন বিএনপি আঁকড়ে ধরে আছে এখনো। কিন্তু বিএনপির এই আইএসআই ফর্মুলায় মারাত্মক একটি গলদ আছে। প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের আইএসআই প্রেসক্রিপশনের মূল খেলোয়াড় সেনাবাহিনীর কিছু জেনারেল। কিন্তু শেখ হাসিনা গণতন্ত্রকে রক্ষার জন্য এই সুড়ঙ্গ বন্ধ করে দিয়েছেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে শেখ হাসিনা একটি পেশাদার রাজনীতি বিযুক্ত বিশ্বমানের বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলেছেন। রাজনীতি থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন করে জাতির সার্বভৌমত্বের প্রতীকে পরিণত করেছেন। ’৭৫ থেকে পাকিস্তানি বটিকায় রাজনীতিতে সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করা শুরু হয়েছিল। হত্যা, ক্যু ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সশস্ত্র বাহিনীকে বিতর্কিত করার পাকিস্তানি প্রবণতা সংক্রমিত হয়েছিল উদ্বেগজনকভাবে। সামরিক গোয়েন্দা সংস্থাকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক দল গঠন। বিরোধী দল থেকে নেতা ভাগানো ইত্যাদি পাকিস্তানি ধারা বাংলাদেশের পবিত্র সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে সঞ্চালিত করা হয়েছিল পরিকল্পিতভাবে। জিয়া-এরশাদ চালু করেছিলেন ‘মিলিটারি ডেমোক্রেসি।’ বেগম জিয়া এবং তার দল বিএনপিও জিয়া- এরশাদের এই ধারা অব্যাহত রাখেন। সশস্ত্র বাহিনীকে ক্ষমতায় থাকার হাতিয়ার হিসেবে বেগম জিয়া ব্যবহার করেছেন তার দুই মেয়াদেই। ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনা তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। ক্ষমতায় থাকার জন্যই বেগম জিয়া সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা এবং নিয়মনীতির বাইরে গিয়ে মইন ইউ আহমেদকে সেনাপ্রধান করেন। জেনারেল মইন সেনাপ্রধান হয়েছিলেন সাতজনকে ডিঙিয়ে। সেই পাকিস্তানি রীতির চর্চা! ২০০৮ সালে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে শেখ হাসিনা সশস্ত্র বাহিনীকে সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে নিয়ে আসেন। অন্যদিকে সংবিধানের ৭(ক) অনুচ্ছেদ সংযুক্ত করে অসাংবিধানিক পথে ক্ষমতা দখলের পথ চিরকালের জন্য বন্ধ করে দেন। সংবিধানের ৭(ক)-তে বলা হয়েছে :-
৭ক। (১) কোনো ব্যক্তি শক্তি প্রদর্শন বা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বা অন্য কোনো অসাংবিধানিক পন্থায়-
(ক) এই সংবিধান বা ইহার কোনো অনুচ্ছেদ রদ, রহিত বা বাতিল বা স্থগিত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে; কিংবা
(খ) এই সংবিধান বা ইহার কোনো বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে-
তাহার এই কার্য রাষ্ট্রদ্রোহিতা হইবে এবং ঐ ব্যক্তি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে দোষী হইবে।
(২) কোনো ব্যক্তি (১) দফায় বর্ণিত-
(ক) কোনো কার্য করিতে সহযোগিতা বা উসকানি প্রদান করিলে; কিংবা (খ) কার্য অনুমোদন, মার্জনা, সমর্থন বা অনুসমর্থন করিলে-
তাহার এইরূপ কার্যও একই অপরাধ হইবে।
(৩) এই অনুচ্ছেদে বর্ণিত অপরাধে দোষী ব্যক্তি প্রচলিত আইনে অন্যান্য অপরাধের জন্য নির্ধারিত দণ্ডের মধ্যে সর্বোচ্চ দণ্ডে দণ্ডিত হইবে।
সংবিধানের ৭(ক) আসলে গণতন্ত্রের জিয়নকাঠি। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের ‘পাকিস্তান’ হওয়ার পথ বন্ধ হয়ে গেছে চিরতরে। শেখ হাসিনা বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের পথ আলাদা করে দিয়েছেন। অর্থনৈতিকভাবে, সামাজিক এবং রাজনৈতিকভাবে। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বাংলাদেশ এখন পাকিস্তানের চেয়ে বহুদূর এগিয়ে। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল। আর পাকিস্তান হলো ব্যর্থ রাষ্ট্রের সবচেয়ে করুণ উদাহরণ। সব সামাজিক সূচকেও বাংলাদেশ এখন পাকিস্তানের চেয়ে অনেক এগিয়ে। তবে রাজনীতিতে এখনো পাকিস্তানের ফেরিওয়ালারা হাঁকডাক দেয়। বিএনপির সঙ্গে পাকিস্তানের রাজনীতির ধারার অসংখ্য মিল রয়েছে। আমি কয়েকটি উদাহরণ দিতে চাই। পাকিস্তানের সব প্রধান রাজনৈতিক দল (পিপলস পার্টি, মুসলিম লীগ, তেহরিক-ই-ইনসাফ) বিশ্বাস করে জনগণ তাদের ক্ষমতায় আনতে পারবে না। ক্ষমতায় আসার জন্য অন্য শক্তি লাগবে। সেনাবাহিনীর সমর্থন, বিদেশি সমর্থন। নওয়াজ শরিফের একটি উক্তি খুব আলোচিত। শরিফ বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানে কে ক্ষমতায় বসবে তা ভোটে নয় মার্কিন দূতাবাসে নির্ধারণ হয়।’ বিএনপিও পাকিস্তানি রাজনীতির শাখা সংগঠনের মতো এই তত্ত্ব বিশ্বাস করে। এ জন্য তারা দূতাবাস দূতাবাস ঘুরে বেড়ায়। বিদেশে নালিশ করে। জনগণকে অন্ধকারে রাখে। নওয়াজ শরিফের উক্তিটিই কি এখন মির্জা ফখরুলের হৃদয়ের কথা?
পাকিস্তানের রাজনীতিবিদরা মনে করেন, ক্ষমতা হলো টাকা উপার্জনের সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা। ক্ষমতায় যাও। টাকা বানাও। পাচার কর। এটাই হলো পাকিস্তানের রাজনীতির মূলমন্ত্র। ইমরান খান, এ পথে যাননি এ জন্যই তিনি জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য। কিন্তু ক্ষমতার আসল মালিকদের কাছে পরিত্যক্ত। বিএনপির রাজনীতিও এরকম। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত হাওয়া ভবন এবং তারেক জিয়া যে পরিমাণ রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠন করেছেন, তা একমাত্র পাকিস্তানের রাজনীতিবিদদের সঙ্গে তুলনীয়। পাকিস্তানের রাজনীতিবিদরা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য সবকিছু করতে প্রস্তুত। এমনকি রাষ্ট্র ও জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতেও তারা পিছপা হন না। বিএনপির রাজনীতি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে কি একই রকম মনে হয় না? ক্ষমতায় থাকার জন্য, বাংলাদেশকে সন্ত্রাসীদের অস্ত্র সরবরাহের রুট হিসেবে ব্যবহার করেছিল বিএনপি (১০ ট্রাক অস্ত্রের ঘটনা)। ক্ষমতায় থাকার জন্য গ্যাস বিক্রির মুচলেকা দিয়েছিল বিএনপিই।
পাকিস্তানের রাজনীতিবিদদের একটি বড় অংশ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বিদেশে পাড়ি দেন। লুণ্ঠিত সম্পদের সুরক্ষা এবং দুর্নীতির সাজা এড়াতেই তারা এটা করেন। প্রয়াত পারভেজ মোশাররফ তাই করেছেন। নওয়াজ শরিফ এখন অঢেল সম্পদ নিয়ে প্রবাসে বসে আরাম আয়েশে দিন কাটাচ্ছেন আর ষড়যন্ত্র করছেন। বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ নেতাও কি তেমনটি করছেন না?
পৃথিবীর একমাত্র দেশ ‘পাকিস্তান’ যেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রয়েছে। এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রধান লক্ষ্য হলো, নির্বাচনে কাকে ক্ষমতায় বসানো হবে তা আগে থেকেই নির্ধারণ করা। ক্ষমতার চাবি জনগণের কাছে নয়, যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত সেনাবাহিনীর কিছু জেনারেলের কাছে। ২০১৮-এর নির্বাচনে ইমরান খানের জয় ছিল অপ্রত্যাশিত এবং অস্বাভাবিক। ইমরানের জনপ্রিয়তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন ছিল না কারোই। কিন্তু সংগঠন হিসেবে পিটিআই দুর্বল। অন্তত সরকার গঠনের মতো না। কিন্তু তখন ইমরান ছিলেন পশ্চিমাদের পছন্দের ব্যক্তি। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ভোট আয়োজন এমনভাবে করে যেন ইমরানের তেহরিক-ই-ইনসাফের জয় নিশ্চিত হয়। পাকিস্তান প্রমাণ করেছে, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ আসলে ক্ষমতা বদলের ষড়যন্ত্রের এক মোক্ষম অস্ত্র। যে অস্ত্রের সুইচ থাকে সেনাবাহিনী ও পশ্চিমাদের হাতে। বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি কি একই লক্ষ্যে? জনগণের কাছ থেকে ক্ষমতা ছিনতাই করে সুশীলদের হাতে দেওয়ার জন্যই? পাকিস্তানে ইমরান খানকে নিয়ে উত্তপ্ত পরিস্থিতির পর বাংলাদেশে পাকিস্তানপ্রেমী দলগুলো তাই কি করবে? পেয়ারে পাকিস্তানের জন্য কাঁদবে নাকি পাকিস্তানের ভুল থেকে শিখবে?
লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত