শনিবার, ১৩ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

বেপরোয়া বাইকিং : মহাদুশ্চিন্তা

ফিরোজ আলম মিলন

বেপরোয়া বাইকিং : মহাদুশ্চিন্তা

বেপরোয়া বাইকিং এখন যেন জাতির জন্য মহাদুশ্চিন্তা হয়ে দেখা দিয়েছে। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় রোজ যত মানুষের প্রাণ যায়, সম্ভবত মরণব্যাধি ক্যান্সারেও এত বেশি প্রাণহানি ঘটে না। ঈদের ছুটিতে নগর ছেড়ে ঘরমুখী ছুটন্ত মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় পড়া এবং তাতে বাইক আরোহীর মৃত্যু নিয়মিত ঘটনা। প্রতি বছরের মতো এ বছর ঈদ মৌসুমেও দুর্ঘটনার শীর্ষে মোটরসাইকেল। ২২ এপ্রিল ঈদের দিন ১০ জেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১৪ জনের ১২ জনই বাইকার এবং দুর্ঘটনার কারণ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই চালক ছিলেন বেপরোয়া। একটি মোটরসাইকেলে চালকের বাইরে সর্বোচ্চ একজন আরোহী তোলার নিয়ম থাকলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা মানা হয়নি। চালক ও আরোহীদের বেশির ভাগেরই হেলমেট ছিল না। তাছাড়া যেসব হেলমেট ব্যবহার করা হয় তা শুধু পুলিশকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য। নির্মাণ শ্রমিকের ব্যবহার্য ক্যাপকে ‘হেলমেট’ বলে চালিয়ে দেওয়া হয়। অনেক ক্ষেত্রে বৈধ লাইসেন্সও ছিল না চালকের। সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিশোর-তরুণদের অনেকে নিয়ম না মেনে বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালায়, যা দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি করে। এ ছাড়া মহাসড়কে ধীরগতির যানবাহন চলাচল বন্ধ না হওয়া, চালকদের বিরতিহীনভাবে একটানা যানবাহন চালানো, ফাঁকা সড়কে বেপরোয়া গতি ঈদের সময় সড়ক দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ।

কয়েক বছর ধরে দেশে মোটরসাইকেলের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে দুর্ঘটনাও বাড়ছে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ২০২১ সালে ২ হাজার ৭৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটে। এতে মারা যান ২ হাজার ২১৪ জন, যা সড়ক দুর্ঘটনায় মোট মৃত্যুর ৩৫ শতাংশ। ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ৫০ শতাংশ এবং এই দুর্ঘটনাগুলোতে মৃত্যুর সংখ্যা ৫১ শতাংশ বেড়ে যায়। সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠনের গবেষণায় উঠে এসেছে- মহাসড়ক, আঞ্চলিক সড়ক ও গ্রামীণ সড়কে মোটরসাইকেল চালানোর ক্ষেত্রে অধিকাংশ চালক নিয়ম মানেন না। এক মোটরসাইকেলে দুজনের বেশি না ওঠার নিয়মটিও মানা হয় না। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে অনিবন্ধিত মোটরসাইকেলও অহরহ চলে। অনেকেরই মোটরসাইকেল চালানোর কোনো প্রশিক্ষণ থাকে না। শিক্ষানবিশ লাইসেন্স প্রদর্শন করলেই শোরুমগুলো বাইক বিক্রি করছে। বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, বেপরোয়া গতির পাশাপাশি মহাসড়কে কীভাবে চলতে হয় কিশোর-তরুণদের অনেকেই তা ভালোভাবে জানে না। আর আন্তজেলা বাহন হিসেবে মোটরসাইকেল চালানো বন্ধ করতে হবে। উচ্চ আদালতের নির্দেশনার পরও মহাসড়কে স্বল্পগতির যান চলাচল বন্ধ হয়নি। সড়ক পরিবহন আইনের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন ছাড়া দুর্ঘটনা কমানো ও সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব হবে না। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে সারা দেশে ১ হাজার ৩০২টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১ হাজার ৪৮৪ জন। এসব ঘটনায় আহতের সংখ্যা ২ হাজার ৪৮৫। সে হিসাবে প্রতিদিন গড়ে ১৪টি দুর্ঘটনা ও ১৬ জনের (১৬ দশমিক ৪৮) মৃত্যু হয়েছে। ৫২৭টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৫৭৯ জন। দুই চাকার এ ক্ষুদ্র বাহনে গড়ে প্রতিদিন নিহত হয়েছেন ৬ জনেরও (৬.৪৩) বেশি মানুষ। ঢাকার গণমাধ্যমকর্মীদের সংগঠন শিপিং অ্যান্ড কমিউনিকেশন রিপোর্টার্স ফোরামের (এসসিআরএফ) পর্যবেক্ষণ ও জরিপ প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় বাংলাদেশ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে অবস্থান করছে। প্রতি ১০ হাজার মোটরসাইকেলের মধ্যে বাংলাদেশে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে ২৮.৪টি। বাংলাদেশের পর কম্বোডিয়ায় ১১.৯, লাওসে ১১.৫, থাইল্যান্ডে ১১.২, ভারতে ৯, মিয়ানমারে ৮.৬, মালয়েশিয়ায় ৪.৪, ভিয়েতনামে ৪.১, ইন্দোনেশিয়ায় ২.৫ এবং ভুটানে ২.১টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশে মোটরবাইক চালকরা যে স্বেচ্ছাচার করছেন তা দমন করা কী কঠিন? না। মোটেই নয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আর সংঘবদ্ধ সচেতন নাগরিকরা সম্মিলিত অভিযানে অর্জন করতে পারেন কাক্সিক্ষত প্রতিকার। তাহলেই কঠোরভাবে জরিমানা এবং আইন লঙ্ঘনকারীর তাৎক্ষণিক আস্থা নিশ্চিতকরণ সম্ভব।

লেখক : সাংবাদিক

সর্বশেষ খবর